শায়লার সাথে যখন বিয়ে হয়, তখন হাতে ছিলো ছয় হাজার টাকা, পুরোনো আমলের নকিয়া ফোনটা, আর এক প্যাকেট সিগারেট। অবশ্য সিগারেটও সবগুলো ছিলো না…৯ টার মতো ছিল।
আর যোগ্যতা? ওইটা সার্টিফিকেটের আড়ালেই চাপা পড়ে গিয়েছিল…পাব্লিকের বাড়ান্দায় বুক ফুলিয়ে হাটলেও কর্পোরেটের দুনিয়ায় আর মুখদর্শন হয়নি।
প্রেমের বিয়ে ছিলো আমাদের। না না, ভুল বললাম। ভালোবাসার বিয়ে।
প্রেম, সে তো বড়লোকদের একচ্ছত্র সম্পত্তি। আমরা ভালোবেসেছিলাম, একদম সত্তর দশকের সিনেমাগুলোর মতো!
দেশের দুই প্রান্তে দুইজন…তবুও কখনো মনে হয়নি ওর থেকে এতটুকু দূরে আছি। বুকের বামপাশের ছোট্ট জায়গাটা দখলের জন্য ওর ভুবনভোলানো হাসিটুকুই যথেষ্ট ছিল।
বছরে দুইবার দেখা হতো আমাদের। সে হিসেবে মোট বারোবার দেখা হয়েছে। খুব কম, তাইনা? অথচ প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমার এই সম্পত্তি দখল করতেই হবে ।
ও বারবার বলতো, বাসা থেকে বিয়ে না দিলে, ও পালিয়ে বিয়ে করতে পারবেনা। ওর লাল বেনারশি চাই, ঝলমলে ঝালরবাতি চাই, ফটোসেলন চাই…আরো কত কি!
অথচ কি আশ্চর্য…দুই মাস আগে যখন ওর বিয়ের প্রস্তাব আসলো, পালাবার প্রস্তাব ও ই প্রথম দিলো। জিজ্ঞেস করেছিলাম ” এই বিয়েতে তো ঝালরবাতি থাকবেনা…খটখটে শুকনো টিউবলাইটের আলোয় সাইন করা লাগতে পারে। চলবে তো?”
স্মিত হেসে ফোনের ওপাশে উত্তর দিয়েছিল “রাজপ্রাসাদে অভ্যার্থনা না পাওয়া যাক, রাজপূত্র তো পাওয়া যাবে!”
বিয়ের আগের দিন ই পালিয়ে এসেছিলো ঢাকার বাস টার্মিনালে। ওই জীর্ন একটা কাজি অফিসেই বিয়ে করতে হলো…তাও আবার হাজার টাকা মোহরানা ধরে!
ওই অফিস থেকে বাস টার্মিনালে যেয়ে সোজা উত্তরবঙ্গ।
লাইফের সবচেয়ে স্মরণীয় জার্নি ঐটা…তা কি আর বলতে হয়! আমার কাধে এলিয়ে দেয়া ওর মুখ…প্রথম ভোরের আলো ওই অনিন্দ্যসুন্দরে এসে পড়ছে।
আবার…আবার প্রেমে পড়েছিলাম ঐদিন…ঠিক প্রথম দিনের মতো!
শুরুর দিনগুলো মোটেই সহজ ছিলোনা। টিউশনি করে আর যাই হোক, বউ পালা যায়না। ঔদিকে শায়লার বাপের বাড়ি, আমার বাপের বাড়ির আশাও ততোদিনে শেষ। আমার বাপ বিয়ের খবর শুনেই বলে দিয়েছিলেন ” নিজে নিজে বিয়ে করেছো…সংসারও নিজে নিজেই চালাও বাপু। আজ থেকে আমরা ভারমুক্ত”
ওইদিকে শায়লা ঢাকায় থার্ড ইয়ারে পড়তো…ওর লাইফ ক্যারিয়ার সব বাদ দিয়েছিলো আমার জন্য…সব!
আর এইদিকে আমি? বাসা ভাড়া আর সংসারের খরচ সামলাতেই হিমসিম খাচ্ছিলামম। তবুও…সাড়াদিন ক্লাস…টিউশনি করে রাতে এসে ওর মুখটা দেখেই ক্লান্তিগুলো কোথায় যেন উবে যেত।
হ্যা…সবকিছুর অভাব ছিলো…শুধু ভালোবাসার অভাব ছিলনা আমাদের এই লাল-নীল সংসারে।
ওই চার হাজারের টিউশনি থেকে শুরু করে আজকের এই ডুপ্লেক্স বাড়ি…সব কিছুতেই একটা হাত সবসময় পাশে ছিলো…শায়লার হাত! ”
নিজের লেখা ডায়রি পড়ে কখন যে রাফাত সাহেবের চোখ ভিজে উঠেছে, টেরই পাননি। চোখের জল মোছার চেষ্টাও করেননি অবশ্য!
ওইদিকে আবার উনার ডাক শোনা যাচ্ছে “বাপ-ছেলে দুজনকেই ডাকছি…কারো খাওয়ার নাম-ঠিকানা নাই। তোমরা কি খেতে আসবে…না সব ফেলে দিব?”