পাশাপাশি দুটো দেশ মাঝখানে একটা বিশাল দরজা। তার দুদিকে সাত হাত লম্বা ছিটকিনি আর সতেরোটা বাঁশ দিয়ে তৈরি খিল, সর্বদা আঁটা থাকে। পুবের দিকের দেশটার নাম রোজ আর পশ্চিমদিকেরটার নাম অলিভ। রোজের লোকেরা একটু বেশি পড়াশোনা জানে তাই তারা অল্প হাসে আর বেশির ভাগ সময় নাকের সামনে বই ধরে থাকে এবং নিজেদের যন্ত্র ভাবতে বেশি ভালোবাসে। এই যেমন ধরো প্ল্যাটফর্মে এক অফিসযাত্রী কলার খোসায় পা হড়কে পড়ে গেল, পাশে দাঁড়ানো ক্লাশ সিক্সের ছেলেটা কিন্তু হাসবে না বরং সে গম্ভীর মুখ করে তাকে হাত বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে, প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে দেবে এবং গুডমর্নিং বলবে। ওদিকে অলিভের লোকেরা খুব হাসিখুশি, তারা ছোটখাট ব্যাবসা করে আর যখন তখন আড্ডায মেতে ওঠে, তখন খাওয়ার কথাও ভুলে যায়।
রোজ দেশটাতে আছে অনেক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসর আর আছে প্রাকৃতিক সম্পদ। ওরা মাথা খাটিয়ে সেই সম্পদকে ব্যবহার করে দিন দিন বড়োলোক থেকে আরো বড়োলোক হচ্ছে। কিন্তু এই করতে গিয়ে ওদের মনটা ক্রমশ ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। রোজের লোকেরা সারাক্ষণই চিন্তা করে কী করে সবকিছুতেই অলিভকে টেক্কা দেওয়া যায় এবং তার জন্য তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।
ওদিকে অলিভ কিন্তু বেশ সাদাসিধে বেশি ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। দেশটাও মরুভূমি আর পাহাড়-পর্বতে বোঝাই। ফলে ওদের বেশ পরিশ্রম করে চাষবাস করতে হয়। প্রাকৃতিক সম্পদও দুর্লভ। তাই শিল্পও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। মানুষগুলো অল্পেতেই খুশি। ওরা রোজকে হিংসে করে না বরং ওদের উন্নতি দেখে নিজের ছেলেমেয়েদের শেখার কথা বলে। কিন্তু রোজ সর্বদা অলিভের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে আর পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে মারামারি করে। তার থেকে কখনও কখনও যুদ্ধও শুরু হয়ে যায়। তবে অলিভ কিন্তু একবার রেগে গেলে তাকে শান্ত করা মুশকিল।
এহেন দুদেশেই একটা করে মাত্র স্কুল। রোজের স্কুলের নাম ওয়েলকাম ফ্রেন্ডস আর অলিভের স্কুলের নাম গুডমর্নিং চিলড্রেন। স্কুলগুলো দিনরাত খোলা থাকে। ছেলেমেয়েরা বাড়ির থেকে স্কুলে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। ওয়েলকাম ফ্রেন্ডস স্কুলের পোশাকের রঙ হলুদ আর গুডমর্নিং চিলড্রেনের গোলাপী। মেয়েরা স্কার্ট কামিজ গাউন ফ্রক শাড়ি ঘাঘড়া সারং ইত্যাদি ইত্যাদি আবার ছেলেরা পরে প্যান্ট শার্ট ধুতি পাঞ্জাবী স্যুট কাউবয় এইরকম আর কি।
তবে দুটো স্কুলে পড়াশোনার বিষয় কিন্তু একেবারে আলাদা। রোজদেশের ছেলেমেয়েরা পড়ে শুধু বিজ্ঞান। মহাকাশবিজ্ঞান ওদের সবচেয়ে প্রিয়। এবং লক্ষ্য বৃহস্পতিকে নিজেদের কব্জায় আনা। অলিভরা আবার ইতিহাস ভূগোল সাহিত্য পড়তে খুব ভালোবাসে। ওরা মনে করে বিজ্ঞান পড়লে মানুষ মারকুটে হয়ে যায়। যতসব ভয়ংকর ভয়ংকর অস্ত্র বানায় আর কথায় কথায় যেখানে সেখানে অ্যাটম বোম ছুঁড়ে মানুষ মেরে ফেলে। তারচেয়ে গল্প উপন্যাস কবিতা চর্চায় স্কুলের দিনগুলো কত আনন্দে কাটে। প্রকৃতির সঙ্গে ইতিহাসের সঙ্গে ওদের গলায় গলায় ভাব।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল দুটো স্কুলেই সারাবছরে একটা মাত্র পরীক্ষা আর সেটাও কিন্তু বই দেখে লিখতে হবে। না দেখে লেখা চলবে না। যে না দেখে মুখস্ত করে লিখবে তাকে ফেল করানো হবে। আরো একটা ব্যাপরে দুটো স্কুলেরই দারুন মিল। সেটা হল খেলা খেলা খেলা। দুদেশের ছেলেমেয়েরাই ইনডোর গেম আউটডোর গেম দুটোতেই ওস্তাদ। স্কুলগুলোতে রয়েছে বিশাল বড় বড় মাঠ, রয়েছে গ্যালারি তাতে একসঙ্গে দশলক্ষ মানুষ আর পাঁচলক্ষ জীবজন্তু খেলা দেখতে পারে। সে এক বিশাল ব্যাপার।
এই তো ঠিক তিন মাস পরেই দুটো স্কুলের মধ্যে বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল ম্যাচ হবে। এর জন্য ওরা সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নেয়। রোজ গতবছর সেরা টিম তৈরি করতে খরচ করেছিল দশ হাজার মিলিয়ন ডলার। অথচ গরীব অলিভ খরচা করতে পেরেছিল মাত্র দশহাজার ডলার। কিন্তু এত খরচা করেও রোজ ট্রফিটা ওদের ঘরে তুলতে পারেনি। তাই ওরা রাগে ফুঁসছে। এবার রোজ ডবল খরচা করবে, কোথাও কোন খামতি রাখবে না। জিতলে পরে টিমের সবাইকে হিরে দিয়ে মুড়ে দেবে আর স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে মঙ্গল গ্রহে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
আজ সেই গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক টুর্নামেন্টের প্রস্তুতির উদ্বোধন। এই উদ্বোধনে আসার জন্য শুধু ছাত্রছাত্রীরাই নয়, তাদের বাবা মা ঠাকুমা দাদু সকলেই যে যার টিমের জার্সি কিনেছে কারণ সকলেই তো একসময় না একসময় এই স্কুল থেকে পাশ করেছেন! বুঝতেই পারছ সারাদেশে একটাই স্কুল। ফলে সবাই নিজের স্কুলটিমের অন্ধ সাপোর্টার। দেশ স্কুল ভালোবাসা খেলা জেতা হারা ছোট বড় সব মিলেমিশে সে এক জগঝম্প ব্যাপার। হাজার হাজার ড্রাম গিটার বাঁশি ভুভুজোলা সঙ্গে বাঘ সিংহ ময়ূর টিয়া শিয়ালের চিৎকারে মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে, পাশের সুইমিং পুলের জল দশতলা সমান উঁচু হয়ে উঠেছে। নিজের চোখে না দেখলে তোমরা ভাবতেই পারবে না ওদের উৎসাহের বহরটা।
টুর্নামেন্টের দিন যত এগিয়ে আসছে রোজদেশে উত্তেজনার পারদ ততই চড়ছে। দুটো স্কুল থেকে ছটা করে মোট বারোটা টিম খেলবে। যত বেশি সংখ্যক স্টুডেন্টকে সুযোগ করে দেওয়া যায় আরকি। ওয়েলকাম ফ্রেন্ডস স্কুলের টিচার থেকে শুরু করে গার্জিয়ান পর্যন্ত সকলেই প্লেয়ারদের নিয়ে তটস্থ। কেউ যেন অসুস্থ হয়ে না পড়ে। পড়াশুনো প্রায় বন্ধ, কোন ইনজুরি হলে একজন প্লেয়ার পিছু প্রায় দেড়শো জন তার সেবায় লেগে পড়ছে। যে যার বাড়ি থেকে ফল দুধ ডিম মাংস স্কুলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই তিনমাস প্লেয়াররা রুটিনের বাইরে কিছু খেতে পারবে না তাই স্কুলের সমস্ত স্টুডেন্টদের ওপরেই জাঙ্কফুড আর রেস্টুরেন্টের খাবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
দেখো দেখি, কী অদ্ভুত ব্যাপার! ওদেশের এত এত স্টুডেন্ট এই হিটলার ফতোয়া বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের স্কুলকে জেতানোর জন্য। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কঠোর অনুশীলনের পর কিছুটা পড়াশুনা তারপর ডিনারে শিডিউল অনুযায়ী চাররকমের আইটেম। প্রত্যেকটায় কার্বোহাইড্রেট, মিনারেলস, প্রোটিনের পরিমান স্ট্রিকটলি মেনটইন করা হয়েছে। গল্পের বই পড়া, টিভি দেখা, চ্যাট, ভিডিও গেমস সবকিছুই সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। রাত দশটায় শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশাল বিশাল স্ক্রিনে আগের বছরগুলোর ভুল শট, ভুল পাস এমন আরো কত কী বারবার করে দেখান হয়। দেশের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা কীভাবে ব্যর্থ হতে হতে সাফল্যকে কবজা করে ফেলেছেন তা তারা পর্দায় নিজের মুখে প্লেয়ারদের শোনান। কীভাবে রোজদেশটা আর পাঁচটা গ্রহের মধ্যে সেরা হয়ে উঠল, কোথায়ই বা রয়েছে তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি তা শেখানোর কাজ চলতেই থাকে।
কিন্তু এতকিছুর পরেও ওয়েলকাম ফ্রেন্ডেস যেন একটু ঝিমিয়ে আছে। প্লেয়াররা সব ঘুমিয়ে পড়লে কোচ আর মেনটররা মিলে সারারাত ধরে মিটিং করে। আসলে হয়েছে কী রোজদেশের বাবা মায়েরা চাকরী কাজ পড়াশুনো নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে সবসময় ঘরে রান্না করে উঠতে পারে না। তাই ওরা জাঙ্কফুড খেতে খুব অভ্যস্ত। তোমাদের সবার মতোই চিপস ওদের খুব প্রিয়। তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, ছেলেমেয়েরা বেশ মোটাসোটা হয়ে গেছে। ওয়েট ঝরিয়ে গ্যারেথ বেলের মতো স্পিড তোলা এই তিনমাসে প্রায় অসম্ভব। তবু প্লেয়াররা অমানুষিক চেষ্টা করে চলেছে নিজেদের ফিট করে তুলতে। বোর্ডের মেম্বার কোচ মেন্টররা বেশ চিন্তিত। টুর্নামেন্ট শুরুর দিন প্রায় এগিয়ে আসছে- ওরা গোপনে শলাপরামর্শ শুরু করে দিয়েছে।
অন্যদিকে অলিভ দেশে এই তিনমাস একেবারে উৎসবের মেজাজ। এমনিতেই পাহাড় পর্বত মরুভূমিতে বোঝাই ওদের দেশ। ছোট থেকে চড়াই উতরাই ভেঙে ভেঙে ওদের শরীর ফুটবল খেলার জন্য এক্কেবারে ফিট, আলাদা করে বেশি প্র্যাকটিসের প্রয়োজন পড়ে না। সেই ছোট্ট থেকেই বাবা মায়ের সঙ্গে মাঠে যায়, চাষের কাজে হাত লাগায়, গোয়াল পরিষ্কার করে, তাঁত চালায় এমন আরো কত কী। বছরের এই তিনমাস ওরা সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে বাড়ির সকলে মিলে ফুটবলের আনন্দে সামিল হয়। ওদের স্কুল মানে গুডমর্নিং ফ্রেন্ডস এ আলাদা করে কোন ট্রেনড কোচ বা মেন্টর নেই। যে যখন সময় পায় সেই একটু কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। যেমন ধরো ওদের হিস্ট্রি টিচার বলেন হেরে গেলে ভেঙে পড়ার কিছু নেই বরং পরের বার জেতার আগ্রহ আরো আনন্দটা দ্বিগুণ করে পাওয়া যায়।
আবার কোন এক ফাঁকে ল্যাংগুয়েজ টিচার এসে শোনাতে লাগলেন ফুটবলের ইতিহাস। ‘তোমার কি জানো, এ খেলাই পারে পৃথিবীর সবকটা দেশকে হাসি কান্নায় মিলিয়ে দিতে?’
ওদের যে গেমস টিচার সে কেবল ফুটবলই খেলায় না, ছাত্রদের নিয়ে যায় গভীর জঙ্গলে। বনের ভিতর দিয়ে সরু এবড়োখেবড়ো যে পথটা উঠে গেছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টায়, ঠিক সেইখানে। প্রচণ্ড জল তেষ্টায় আর অক্সিজেনের অভাবে যারা চূড়োয় পৌঁছাতে পারে না, তাদের কিন্তু কেউ বকাবকি করে না। অথচ পরের দিন ওরা আবার হাঁটা শুরু করে একেবারে প্রথম থেকে। এ-ছাড়াও পাহাড়ে ঘেরা শান্ত সবুজ লেকের জলে ওরা বাইচ প্রতিযোগিতায় নামে। জানো তো, ওই বড় বড় নৌকোগুলো ওরা নিজের হাতেই তৈরি করে। আর ফুটবল বলতে ওরা প্রতিদিন দেড় ঘন্টার ম্যাচ প্র্যাকটিস করে। এভাবেই হাসি মজায় চলছিল অলিভ দেশের ফুটবল প্র্যাকটিস।
টুর্নামেন্ট শুরুর দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ওদিকে রোজ দেশের কোচ আর মেন্টাররা পড়েছে মহাচিন্তায়। এত চাপে প্লেয়াররা মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলতে পারছে না। একই ভুল বারবার করছে। কিছুতেই গোলের সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। বেশি প্র্যাকটিস করে প্লেয়াররা আর একশ ভাগ ফিট নেই। ওদের মনও ভালো নেই, কতদিন বাড়ি যায় না। প্রায় তিন মাস হতে চলল ভালো ভালো খাবার খাওয়াও বন্ধ। খালি সেদ্ধ আর বেকড খাবার খেতে খেতে ওদের আর ভালো লাগছে না।
এই যখন অবস্থা তখন বোর্ডের মেম্বাররা মিটিংয়ে বসল। গোল কিপিং ডিফেন্স মিডফিল্ড উইংস ফরোয়ার্ড – এই সমস্ত দিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করে বোর্ডের সদস্যরা দেখল, ওদের টিমের মূল সমস্যা হল, ভাল স্ট্রাইকার নেই। ওদিকে রোজের গুপ্তচররা খবর এনেছে – অলিভ টিমের সবচেয়ে বড় শক্তিই হল ওদের স্ট্রাইকার রবিন ডিসুজা। রবিনের পায়ে জাদু আছে। সে বলে পা ছোঁয়ালেই গোল। এখন একটাই উপায়, ওই রবিনকে কিডন্যাপ করে অলিভ টিমের ছন্দ নষ্ট করে দিতে হবে। আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি ভেঙে দিতে হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হল। সাতজনের একটা টিম ছদ্মবেশে রওনা দিল অলিভের উদ্দেশ্যে। সেই তেরো হাত লম্বা দরজার একটা অংশ চুপিচুপি ভেঙে ফেলা হল রাতের অন্ধকারে। তারপর সাতজন মিলে ঢুকে পড়ল ‘গুডমর্নিং চিলড্রেন’ স্কুলের হস্টেলে যেখানে রয়েছে অলিভের দুর্দান্ত সব প্লেয়াররা।
তখন রাত প্রায় আড়াইটে। প্লেয়াররা রাত নটা পর্যন্ত বিচ ভলিবল খেলেছে। ভীষণ ক্লান্ত, অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রোজের গুপ্তচররা একের পর এক ঘরে ঢুকছে। নাহ্ কোত্থাও তো নেই রবিন। ওরা যখন প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছে, তখনই দেখতে পেল তিনতলার একেবারে শেষের ঘরে রবিন! রবিন তখনও ঘুমোয়নি। সে মোবাইলে চ্যাট করছে। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা অতগুলো লোককে রাত দুপুরে ঘরে ঢুকতে দেখে রবিন তো হতচকিত, তাও আত্মরক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করল, সে যে কুংফু চ্যাম্পিয়নও বটে।
কিন্তু সাতজনের সঙ্গে একা কি আর পেরে ওঠা যায়? ফলে যা হওয়ার তাই হল। অজ্ঞান অবস্থায় রবিনকে চ্যাংদোলা করে ওরা নিয়ে এল রোজ দেশের প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে। সে এক বিশাল প্রাসাদ। ভিতরটা একেবারে ভুলভুলাইয়া। চারিদিকের দেওয়ালে বিভিন্ন সাইজের আয়না ফিট করা। অনেকগুলি ঘর। এরই মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভেদ্য একটা ঘরে রবিনকে ওরা আটকে রাখল।
এদিকে রবিন বেশ খোশ মেজাজেই আছে। কোন টেনশন ফেনশন নেই। মাঝে মাঝে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এসে গল্প করে যাচ্ছে। আর বারে বারেই রবিনকে বলছে রোজ দেশের সিটিজেন হয়ে যেতে। তারজন্য ও যা চাইবে তাই দেওয়া হবে। রবিনের তো এই ভি.আই. পি ট্রিটমেন্ট পেয়ে মজাই লাগছে আর মনে মনে ভাবছে যদি প্রাণ যায় যাক তবু সে কিছুতেই নিজের দেশ ছাড়বে না। রবিন এটাও ভালো করে জানে, অলিভের মনোবল অত ঠুনকো নয়। সে নেই তো কী হয়েছে? ওর জায়গায় প্রাণ ঢেলে খেলে দেবে এডোয়ার্ড, সাদ্দাম, ফেং শি, মিশেল, সুরিন্দর, স্টিফেন, ওমেন যে কেউ। একজনকে কিডন্যাপ করে ওরা অলিভের জেতা আটকাবে! এটা ভাবলেই রবিনের খুব হাসি পাচ্ছে।
পরদিন সকালবেলা হৈ হৈ কাণ্ড অলিভ দেশে। রবিন কোথায়? রবিন কোথায়? স্কুলের প্রিন্সিপাল তড়িঘড়ি করে মিটিং ডাকলেন। ড: কেবিন বললেন, “দেখুন বন্ধুরা, আমরা ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নই। আমাদের ছেলে রবিন এখন কোথায় আছে, কেমন আছে , তার ওপর কোন অত্যাচার করা হচ্ছে কিনা সেটা দেখাই আমাদের এখন প্রধান লক্ষ। এবং যতক্ষণ না আমরা রবিনকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাবো, ততক্ষণ টুর্নামেন্টে অংশ নেব না। আর একঘন্টা পরেই আমাদের প্রেসিডেন্ট দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তব্য রাখবেন। মাত্র ষোলো বছরের ঝকঝকে কিশোর রবিনকে আমাদের ফিরে পেতেই হবে। আপনারা মাইকে প্রচার শুরু করুন, সমস্ত দেশবাসী যেন সেন্ট্রাল স্টেডিয়ামে একঘন্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট আসার আগেই জড়ো হয়ে যায়।
অনারেবল প্রেসিডেন্ট মিসেস মোনিকা তারাসোভা ডায়াসে তাঁর বক্তব্য রাখছেন, “বন্ধুরা, আমাদের ছেলে রবিন কাল থেকে নিখোঁজ। এতক্ষণে এই খবর আপনাদের কাছে পৌঁছে গেছে, তা আমি জানি। এও জানি, ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে আপনারা চিন্তিত নন, আপনারা ভাল করেই জানেন খেলায় হার জিত আছে। আর সেটা সহজভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা যে অলিভ দেশের প্রতিটি মানুষের আছে তা আপনারা বারবার অতীতে প্রমাণ করেছেন।
“আপনাদের কাছে দেশের প্রশাসন চির কৃতজ্ঞ। আপনাদের এই শুভবুদ্ধির কাছে আমার বিনীত আবেদন, আপনারা ধৈর্য্য হারাবেন না, ক্রোধ সংযত রাখুন। আজই আমরা আলোচনার জন্য রোজ দেশে দূত পাঠাচ্ছি। এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তের কথা আপনাদের জানাই – যদি রবিনকে কেন্দ্র করে রোজ দেশ যুদ্ধের দিকে এগোয়, তবে আমরা মানে অলিভিয়ানরা কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে নামব না। খেলাকে কেন্দ্র করে একটি প্রাণও যেন আমাদের হারাতে না হয়। তেমন হলে আমরা চিরদিনের জন্য ফুটবল খেলা ছেড়ে দেব।”
আকাশের দিকে ঝড় তুলল মেক্সিকান ওয়েভ, প্রতিটি মানুষ চিৎকার করে তাদের সমর্থন জানাল, “আমরা শুধু রবিনকে চাই, ফুটবল চাই না, যুদ্ধ চাই না।”
ইতিমধ্যে রবিন রোজের প্রেসিডেন্টকে কথা দিয়েছে সে রোজের সিটিজেন হতে রাজি এবং পরের বার থেকে সে রোজের হয়েই খেলবে। ওদিকে রবিন প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে এক বেয়ারাকে বন্ধু করে নেয়। তারপর সেই বেয়ারার হাত দিয়ে অলিভের স্কুলের প্রিন্সিপাল ড: কেবিনের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে।
চিঠি পেয়ে ড: কেবিন মুচকি হাসলেন। গোটা স্কুলে একসঙ্গে বেজে উঠল বিউগল স্যাক্সোফোন গিটার ভুভুজোলা ড্রাম আর আকাশ ফাটান ছাত্রদের চিৎকার, “আমরা খেলবো।”
তিনদিন পরই শুরু হচ্ছে টুর্নামেন্ট। দু’দেশের স্টেডিয়ামে মিলিয়েমিশিয়ে খেলা হবে। আর ফাইনালটা হবে রোজ দেশে। রোজ দেশ যেন স্বপ্নপুরী হয়ে উঠেছে। চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। সবকটা পাব-এ তুমুল গানবাজনা চলছে। দেশের সমস্ত রাস্তা লাল আর সোনালী কার্পেটে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই নতুন জার্সি কিনেছে। এমনকি বাড়ির পোষ্যের জন্যও নতুন খাঁচা বকলস, এ-সবও কেনা হয়েছে। প্রচুর শ্যাম্পেন মজুত করা হয়েছে। জেতার পর ও-গুলি খোলা হবে। দেশজুড়ে সে এক এলাহি ব্যাবস্থা। যদিও টেনশনে রোজারিয়ানদের মুখ শুকিয়ে গেছে।
অন্যদিকে অলিভ হল গিয়ে গরিব দেশ। কোনমতে দু’বেলার খাবার যোগার হয়। এমন কি স্কুল কতৃপক্ষ প্লেয়ারদের জন্য জুতো কিনে উঠতে পারছিল না। অথচ রোজের প্লেয়ারদের অত্যাধুনিক জুতোর সামনে খালি পায়ে খেলা কোন মতেই সম্ভব নয়। এই কথা জানতে পেরে মঙ্গলগ্রহের স্পোর্টস একাডেমি অলিভের জন্য জুতো পাঠিয়ে দিয়েছে। তারপর অনেকটা নিশ্চিন্তি। অলিভের রাস্তাঘাট রঙবেরঙের বেলুন, ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে। যেটুকু ওদের ক্ষমতা তার মধ্যেই ওরা ঝলমল করছে।
শুরু হয়ে গেল টুর্নামেন্ট । অলিভের নিজেদের মধ্যে তিনটে খেলা। অন্যদিকে রোজের নিজেদের মধ্যে তিনটে। দু’দেশের স্টেডিয়ামই কানায় কানায় ভরে গেছে। কত অদ্ভুত সব টুপি পড়েছে দর্শকরা। এক এক জনের হাতে এক এক রকমের বাজনা। বিচিত্র সুরে গান গাইছে তারা। বাড়ির কুকুর বেড়াল ঘোড়া ময়না ময়ূর সবাই এসেছে। ওরাও তারস্বরে পছন্দের টিমকে সাপোর্ট করছে। এত আনন্দে মাটি কাঁপছে, বাতাস হাসছে , আকাশ দু’চোখ ভরে দেখছে।
এমনি করেই কেটে গেল গোটা একটা সপ্তাহ। অলিভ থেকে ফাইনালে উঠল রাইজিং স্টার টিম। রোজ থেকে উঠল ওয়েভেন ইউনাইটেড। আজ ফাইনাল। রোজের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম পিঙ্ক হেভেনে খেলা শুরু হল সন্ধ্যে সাতটায়। গোটা স্টেডিয়াম যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। খেলা শুরু হয়ে গেছে। প্রথম আট মিনিটের পর থেকে অলিভ মানে রাইজিং স্টার ঝড় তুলে দিল মাঠে। ওয়েভেন ইউনাইটেড যেন কিছুটা হতভম্ব। ওরা হতোদ্যম হয়ে পড়ছে। একের পর এক আক্রমণে উঠে আসছে অলিভ। রোজের ডিফেন্স ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। আরে, সাতনম্বর জার্সির ছেলেটা কে? ও পায়ে বল ছোঁয়ালেই গোল! কীঊ ব্যাপার? জার্সিতে কোন নাম নেই কেন? প্রথম হাফেই চারটে গোল হয়ে গেল। সবকটা গোলই এসেছে ওই সাতনম্বর ছেলেটার পা থেকে।
সেকেন্ড হাফে অন্তত হাফ ডজন প্লেয়ার বদল করেও রোজ খেলায় ফিরতে পারল না। ওদিকে অলিভকে কখনও এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে আগে দেখা যায়নি। ওরা শেষ দশ মিনিট অল আউট খেলল। গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছে একেবারে। ওই ছেলেটা এগারো নম্বর গোলটা করতেই খেলা শেষের বাঁশি বেজে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা এক টানে খুলে ফেলল ওর ইনভিজেবল মাস্ক। আরে, এই তো রবিন!! আমাদের রবিন!! অলিভিয়ানরা তখন আনন্দে আত্মহারা, ছুটে আসছে মাঠের ভিতর, ভেঙে যাচ্ছে সমস্ত ব্যারিকেড। অবাক ঘটনা, রোজারিয়ানরাও রবিন রবিন করে আনন্দে চিৎকার করছে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, এ বছরের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পাচ্ছে রবিন ডিসুজা। গোটা স্টেডিয়ামে যেন সমুদ্রের গর্জন উঠছে।
রবিন প্রাইজ নিতে এসে সলজ্জ মুখে জানাল, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের বেয়ারা রাধাকৃষ্ণন যদি সাহায্য না করতে তাহলে আজ তার খেলা হত না , বন্দি হয়ে কাটাতে হত প্রাসাদের দুর্ভেদ্য ঘরে। আর পুরো পরিকল্পনার কথা সে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল অলিভের স্কুলের প্রিন্সিপাল ড: কেবিনকে।
এবার ঘোষণা হচ্ছে টুর্নামেন্টের বিজয়ী দল অলিভের রাইজিং স্টারের নাম। বাজির আলোয় সারা আকাশ যেন হীরের কুচিতে ভরে গেছে। মাঠের মাঝখানে একে একে প্লেয়াররা এসে দাঁড়াচ্ছে রবিনকে ঘিরে। পুরস্কার তুলে দেওয়ার জন্য ডাকা হল অলিভের প্রেসিডেন্ট মিসেস মোনিকা তারাসোভাকে।
কিন্তু মঞ্চে এসে মিসেস মোনিকা বললেন, “এই পুরস্কার গ্রহণ করতে আমরা অপারগ। যে খেলাকে কেন্দ্র একটি ষোলো বছরের বালককে কিডন্যাপ করতে হয়, অসততার সাহায্য নিতে হয়, জটিল পরিকল্পনা করতে হয় – সেই পুরস্কারের সম্মান অলিভ দেশ স্বীকার করে না। আপনারা আমাদের ক্ষমা করবেন। এবং পরের বছর থেকে আমরা আর কোন রকম প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশ গ্রহণ করব না। যে প্রতিযোগিতা অসুস্থ মানসিকতার জন্ম দেয়, আমরা তার অংশীদার হতে পারব না। অলিভ দেশের মানুষ এসবের থেকে অনেক দূরে এক রূপকথার জীবন ভালোবাসে।”
প্রেসিডেন্টের সমর্থনে প্রতিটি প্লেয়ার হাত মুঠো করে ছুঁড়ে দিল আকাশের দিকে। গোটা স্টেডিয়াম থেকে ভেসে আসছে একটাই শব্দ, “আমরা এক, আমরা মানুষ।”
রোজের প্রেসিডেন্ট মি: লরেল ট্রাম্প্ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মি: এল কিম হতবুদ্ধি হয়ে দেখছে, রোজের মানুষরা অলিভিয়ানদের গলা জড়িয়ে ধরেছে আর অলিভের মানুষগুলো রোজারিয়ানদের কাঁধে তুলে আনন্দে নাচছে।