তোমায় পেয়ে

তোমায় পেয়ে

ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় মাকে হারিয়েছেন অলক। মায়ের স্মৃতিটা খুব ফিকে এখন। তবে কখনো কখনো মায়ের হাতের ঠান্ডা স্পর্শটা মনে এসে কেমন এলোমেলো করে দেয় সবটুকু। মা মারা যাবার পঞ্চাশ বছর পরেও মায়ের হাতের ঐ ছোঁওয়াটা এখনো মাঝে মাঝে এত স্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে যায় কিভাবে? যতবার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেন , ততোবারই খুব অবাক লাগে অলকের! এই কথাটা অনেকবার ছোট ভাই অশোককে বলতে চেয়েও বলতে পারেননি অলক ।মা মারা যাবার সময় অশোক সদ্য জন্মেছে। ওকে জন্ম দিতে গিয়েই মা মারা যান। ও বেচারার তো মায়ের সম্পর্কে কোনোও স্মৃতিই নেই। অলকের বাবা বেঁচে নেই যে -তার সঙ্গে এই কথা গুলো আলোচনা করে একটু শান্তি পাবেন অলক। অলক- অশোক দুই ভাইকে একা হাতেই মানুষ করেছেন বাবা।

অলকের একটিই সন্তান – মৌবনী। অলক -‘মাম’ বলে ডাকেন। ছোট থেকেই মামের খেলার একনিষ্ঠ সঙ্গী ওর বাবা। বাবা আর মেয়ের সবচেয়ে প্রিয় খেলাটা ছিল – ‘ডাক্তার ডাক্তার।’ অলক অসুখের ভান করে পড়ে থাকতেন। মাম খুব যত্ন নিয়ে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। আর সবশেষে হাত রাখত কপালে। সঙ্গে সঙ্গে অলক চেঁচিয়ে বলতেন – থ্যাঙ্ক ইউ ডাক্তার বাবু ,আমি সেরে গেছি। ”

ছোট্ট মাম বাবার কোলে উঠে, আরো যত্ন নিয়ে বাবার কোলে উঠে বাবার কপালটা হাতিয়ে দিত। বাবা মেয়ের খেলা দেখে – স্মিত হাসি হাসতেন অলকের স্ত্রী মধুজা।

আজ অলক অবসর নিচ্ছেন অফিস থেকে। অফিসে আজ সন্ধ্যেবেলা একটি বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে অলকের জন্য। সহকর্মীরা বারবার বলে দিয়েছেন মধুজাকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে অনুষ্ঠানে। অলকের মেয়ে মৌবনীকেও ওরা ভীষণভাবে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু উপায় নেই। মৌবনী দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে এই মুহূর্তে ইন্টার্নশীপের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যস্ত ডাক্তার বাবু। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই দু দিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি মেয়ে। তাই ভীষণ ইচ্ছে থাকলেও, বাবার জীবনের এই বিশেষ দিনটাতে বাবার সাথে বাবার আদরের মাম থাকতে পারবে না।

অবসর নেবেন বলে বেশ কিছুদিন ধরেই অলকের মনটা খুব ভারাক্রান্ত। জীবনের খুব মহার্ঘ বত্রিশটি বছর ওই অফিসে কেটেছে অলকের। জীবনের সমস্ত সুখ- দুঃখের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল অফিসটা। চেনা পরিবেশ, চেনা লোকজনদের ছেড়ে অবসর জীবনটা কিভাবে যে কাটাবেন -তাই নিয়ে মনে মনে ভীষণ ভেঙে পড়েছেন অলক। স্ত্রী মধুজা আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করলেও নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছেন না অলক। মধুজা ফোনেও মেয়ে মৌবনীকে বারবার বলেছেন – এই সময়টা দুদিনের জন্য হলেও ও কলকাতায় থাকলে, অলকের ভালো লাগতো খুব। মৌবনী বারবার একই উত্তর দিয়েছে ওর মাকে -‘কিছুতেই দু দিনের জন্য ছুটি ম্যানেজ করে কলকাতা আসা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।’

অবসরের দিন সন্ধ্যেবেলা অলকের অফিসে ‘ বিদায় সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানটা খুব সুন্দর হল। অফিসের গাড়িতে দুজন সহকর্মী সমেত স্ত্রী মধুজাকে নিয়ে অলক ফিরে এলেন বাড়িতে। প্রচুর উপহার পেয়েছেন অলক। সহকর্মী দুজন কিছুক্ষণ বসে থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সেই তীব্র মন খারাপটা একেবারে যেন সাঁড়াশির মতো আক্রমণ করে

ফেললো এবার অলককে। মাথাটা যেন যন্ত্রনায় ছিঁড়ে পড়ছে। মধুজা তাড়াতাড়ি চা করে দিলেন। চা -টা খেয়ে ও অস্বস্তিটা কিছুতেই যাচ্ছেনা অলকের।

জামা কাপড় ছেড়ে চুপচাপ শোবার ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন অলক।
হঠাৎ! কি আশ্চর্য আরাম! সেই অসম্ভব মধুর শীতল স্পর্শ! সেই এক লহমায় ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া মায়ের হাতের সুখানুভূতি মেশানো স্নেহের ছোঁওয়া! আনন্দে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল অলকের। বিড়বিড় করে বললেন অলক- “মা তুমি এতদিন পরে আবার এলে? কতবার তোমাকে খুঁজেছি মা আমি। আজ সারাদিন মনে হচ্ছিল -একটিবার যদি তুমি ছুঁয়ে দিতে আমার কপাল! খুব কষ্ট হচ্ছে মা আমার। ”

মাকে স্পর্শ করবার জন্য চোখটা খুলেই হতবাক হয়ে গেলেন অলক! সামনে কে বসে আছে?
মা কোথায়? এ তো মৌবনী !তার আদরের মাম! কি আশ্চর্য মামের হাতের ছোঁওয়া যেন ভুলে যাওয়া সেই একই সুখানুভূতি জাগিয়ে দিল আজ অলকের মনে! মায়ের হাতের ছোঁওয়া আর মেয়ের হাতের ছোঁওয়া -কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল! কি করে সম্ভব এটা?
অবাক হয়ে অলক শুনলেন মেয়ে বলছে –

” আমি তো তোমার আর একটা মা। তাই আজ আমার হাতের ছোঁওয়াটা তোমাকে তোমার মায়ের হাতের স্পর্শটা মনে করিয়ে দিলো। ঠিক বললাম বাবা? আমি তোমার আরেকটা মা হই না? ”

আনন্দে ,আবেগে -জুড়িয়ে গেল সমস্ত শরীর অলকের! কি কষ্ট করে ছুটি ম্যানেজ করে যে মেয়েটা এসেছে – আজকের দিনে বাবার মন খারাপটা দূর করতে ,সেটা তো বেশ ভালই বুঝতে পারছেন তিনি। কিন্তু সেই সব কিছু ছাপিয়ে সব থেকে বেশি আনন্দ হচ্ছে এটা ভেবে যে – আজ সত্যি সত্যি এতদিন ধরে দেখে আসা স্বপ্নটা সত্যি হলো। এতদিনে মাকে যেন আবার ফিরে পেলেন অলক। মাম এতদিন ছিল শুধুই সন্তান। আজ সবকিছু ছাপিয়ে শুধুই মা হয়ে গেল ।মেয়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে সজল চোখে বললেন অলক

-” মাগো তোমায় পেয়ে ধন্য আমি। তোমার কোলে -কত শান্তি, কত ভালোবাসা…! ”

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত