বেনারসি

বেনারসি

আমি প্রায় রাতেই স্বপ্নে দেখতাম বিড়ালচোখী এক তরুণীকে আমি চুমু খাচ্ছি, মেয়েটা বেশ হ্যাংলা।তার মুখটা চুমু খাবার পরমুহূর্তেই স্মিত হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। লোকাল বাস,রেলওয়ে স্টেশন,শপিং মলে হ্যাংলা মেয়ে দেখলে আমি মুখের দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে তাকে খুঁজতাম।মেয়েটাকে কোথাও খুঁজে পাইনি। তাকে খোঁজাখুঁজির পর্বটা স্বপ্নতেই থেমেছিল যেদিন ফেসবুকের সাজেস্ট ফ্রেন্ড অপশনে মেয়েটাকে দেখেছিলাম। মেয়েটার আইডিতে ঢুকে দেখি “রিমেম্বারিং ” লেখা।প্রোফাইল পিকচারের ছবিটাতে মেয়েটার মুখে স্মিত হাসি লেগে আছে।

আমার প্রেমিকা এক যুবকের সাথে নোংরা অবস্থায় ছিল, আমার দেখা স্বপ্ন মিথ্যে হয়েছে তার একটা উদাহরণও আমার এই চব্বিশ বছরের জীবনটা দেখাতে পারবেনা। প্রেমিকাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কারো সাথে ফিজিক্যাল রিলেশনে গিয়েছে কিনা তখন সে খানিকটা ঝগড়াঝাটি করে আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিল “স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন, এই সেঞ্চুরিতে একটা স্মার্ট ছেলের এমন আ্যচিচিউড নাকি বড্ড হাস্যকর “।

তবে আমি তো আমায় জানি,স্বপ্ন আমায় কখনো মিথ্যা দেখায় না৷ একসময় প্রেমিকার গোমর ফাঁস হলো,স্বপ্নে দেখা ছেলেটার সাথে তার অন্তরঙ্গ মুহুর্তগুলোর স্থিরচিত্র আমার ইমেলেই কেউ একজন পাঠিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল আমার স্বপ্নগুলো মিথ্যে নয়। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে খুব করে চাইতাম আজ যেন কোন স্বপ্ন না দেখি।স্বপ্নের এমন বিচিত্র ধরন বুঝতে পারার পর স্বপ্ন ছাড়া একটা রাতও কাটেনি। কোনদিন হয়ত দেখেছি মাছ কাটতে যেয়ে মায়ের আঙুল কেটে গলগলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আবার কোনদিন দেখেছি আব্বা গণিতে ফেল করার কারণে বকাঝকা করছেন অথবা নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনাগুলো দেখেছি যা অক্ষরে অক্ষরে মিলেছে।

ভবিষ্যত গুলো আশায় মোড়ানো থাকে যেখানে কিছু প্রত্যাশা থাকে। থাকে কিছু একটার অপেক্ষায় সময় পার করার বিনিদ্র উদ্যম। আমার বেলায় হয় তার উলটো। কেননা ভবিষ্যতগুলো আমার স্বপ্নে এসেই রোজ ধরা দিতে লাগল।

আমার বিয়ের জন্য চারদিকে পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছে সালেক মামা। মামা একদিন ভর দুপুরে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির।কৈ মাছের ঝোল দিয়ে পাতের অর্ধেক ভাত মাখাচ্ছি। মামা এসে টেবিলের বসতে বসতে মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,আপা মেয়ে পাওয়া গেছে।মেয়ে ইকনমিক্স এর ছাত্রী,ইডেনে পড়ে। চোখের সামনে গত রাতের স্বপ্নটা ভেসে উঠল,ইকনমিক্সে পড়ুয়া এক মেয়েকে বিয়ে করার পরদিন বাবা মারা গিয়েছেন।ভাত মুখে তুলতে পারলাম না।মাথা ঘোরাতে লাগল,বিদ্যুৎবেগে শরীরে ঘাম দিয়ে গেল।

কোনমতে টেবিল থেকে উঠে এলাম। দিন দুয়েক পর মা এসে বললেন,মেয়ে অসম্ভব সুন্দরী। আমি যেন পাকা কথা দেবার আগে মেয়ের সাথে কথা বলে আসি।আমার বারবার স্বপ্নে দেখা বাবার মরা মুখটা চোখে ভাসছিল।কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাইনি।বারবার মনে করার চেষ্টা করলাম গতরাতে কোন স্বপ্ন দেখেছি কিনা,না কোন স্বপ্নই দেখিনি। ঘোর কাটল দরজার টোকায়।মা বাইরে থেকে বললেন, বাবার শরীরটা নাকি ভালো না।ডাক্তার ডেকে আনতে যেতে বললেন।আমি হুড়মুড় করে দরজা খুলে কাঁপা গলায় বললাম,মা আমি এই মেয়েকে বিয়ে করব না৷ কেন করব না,জিজ্ঞেস করোনা।তোমার দুটো পায়ে ধরি,এই বলে মায়ের পায়ে পড়েছিলাম।মা ঘটনার আকস্মিকতা না বুঝতে পেরে খানিক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

দিন চারেক পর বাবা হুট করেই মারা গেলেন।শেষ রাতের দিকে মায়ের চিৎকারে হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বাবার ঘরে যেয়ে সবটা বুঝে নিতে বেশি দেরি হয়নি। অবিরাম কেঁদেছিলাম। বাবার জানাযার নামাজের মাঝেই চোখের সামনে গতরাতের স্বপ্নটা ভেসে উঠেছিল।ইডেনের সেই মেয়েটা লাল টকটকে বেনারসিতে আমার দু বাহুর মাঝে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।

মাঝে মাস দুয়েক কোন স্বপ্ন দেখছিনা।
স্বপ্নের এমন বিচিত্রিতা নিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম তিউনিসিয়া, অকল্যান্ডে এমন দুজন অদ্ভুত মানুষ আছেন যাদের স্বপ্ন হুবহু মিলে যায়।বিজ্ঞান বলছে, এই স্বপ্নের পেছনে রয়েছে মনোজগতের মিথস্ক্রিয়া। মানুষ নিজেকে ব্যতিক্রম ভাবতে পছন্দ করে,এই ব্যতিক্রমীতার পরিধি হরেকরকম। মানুষ অবচেতনভাবেই নিজের মনকে এক সক্রিয় শক্তিশালী সত্তা হিসেবে আবিষ্কার করে।মনোজগতে তখন বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলো মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টি করে। আর মন তখন মানুষকে বিশ্বাস করতে শেখায় সে যা ভাবছে, যা কল্পনাতে দেখেছে তা ই সঠিক।

তবে আমার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের এই মতাদর্শ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ধরে নিলাম প্রেমিকার অন্য কারো সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তর স্বপ্নটা তাকে মনে মনে অবিশ্বাস করার ফলে হয়েছে,ইমেইলে যে স্থিরচিত্র এসেছে সেটা কেউ নিজের স্বার্থেই করেছে কিন্তু বাবার মৃত্যু? বিড়ালচোখী সেই মেয়েটা? এছাড়া নানান স্বপ্নগুলো মোটেই শুধু কল্পজগতের ব্যাপার না। আবার কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেবার অবকাশ নেই,তাছাড়া আমার অবচেতন মন কখনো এমন বিক্ষিপ্ত ঘটনা কোনদিন ভেবেছে কিংবা কোন ঘটনা দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে পড়েনা।তবে আমার বেলায় স্বপ্নের এমন বিচিত্রিতাকে কেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যেতে হচ্ছে?

শহরের নামকরা সাইকোলজিস্ট দাউদ মুহাম্মদ এর সামনে বসে আছি। ভেবেছিলাম তার কাছে সব খুঁটিনাটি বলে দিব কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন গলাটা চেপে ধরেছে।দাউদ মুহম্মদ একজন চেইন স্মোকার।তাকে জানানো হয়েছে আমার দেখা স্বপ্ন মিলে যায়, যা দরুন মানসিক অশান্তিতে আছি।দাউদ মুহম্মদ তিন নম্বর সিগারেট শেষ করে মাথা ঝুকে বললেন,আপনার এমন স্বপ্নের পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে।প্রথমটা আপনার অবচেতন মন টুকরো ঘটনাগুলোকে নিজের মত করে সাজিয়ে নেয়।টুকরো ঘটনাগুলো ডালপালা মেলে বিশাল আকৃতি ধারণ করে।আর ঘটনাগুলো বেদনাদায়ক হয়, পীড়াদায়ক হয়।কেননা আপনি হয়তো অতীতে পীড়াদায়ক, বিয়োগান্তক কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছেন যার কারণে টুকরো ঘটনাগুলোরও পীড়াদায়ক এক অবয়ব তৈরি করে আপনার অবচেতন মন।খেয়াল করে দেখবেন,আপনার সবসময় স্যাড সং,ট্র‍্যাজেডি এন্ডিং নোভেল, ট্র‍্যাজিক ঘটনাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালো লাগে। তাই না?

না।আমার ট্র‍্যাজিডি,স্যাড সং ভালো লাগেনা।আমি হ্যাপি এন্ডিং খুঁজি সবসময়। আমার সম্পর্কে আপনার অবজারভেশনে ভুল। আপনি দুই নম্বর কারণটা বলুন।

দাউদ মুহাম্মদ খানিকটা দমে গেলেন।গোল্ড-লিফ সুইচে টান দিয়ে বললেন,সামনের মাসে আসুন।দুই নম্বর কারণটা সামনের মাসে বলব।

দাউদ মুহাম্মদের চেম্বার থেকে উঠে আসার সময় উনি পেছন থেকে ডেকে বললেন, জাফর সাহেব আপনি সামনের মাসে না আসার জন্য মনস্থির করেছেন।সেটা না করলেই খুশি হব।

কৃত্রিম হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম দাউদ মুহাম্মদের এই অবজারভেশনটা সঠিক।

বাইরে বেশ গরম পড়েছে।চিটচিটে রোদে ঘেমে একাকার।বাড়ি ফিরতেই মা এক গ্লাস ঠান্ডা পানিয়ে এগিয়ে দিয়ে কেমন করে যেন তাকালেন।গত চব্বিশ বছরে মায়ের এমন চাহনি দেখিনি। ভয় লাগানো এক অদ্ভুত শান্ত চাহনি। মা আঁচল দিয়ে আমার কপালটা মুছে দিতে দিতে বললেন, কিছু জিনিসকে ছেড়ে দিতে হয়।আকঁড়ে ধরে থাকলেই জগৎটাকে অচেনা মনে হবে।মা আমার উত্তরের আশা না করে বেরিয়ে গেলেন।

পরদিন সকালবেলা মা লাল মলাটের একখানা ডায়েরি আমার হাতে দিয়ে বললেন,তোমার বাবারও এই অদ্ভুত ক্ষমতাটা ছিল। তোমার দাদার থেকেই তোমার বাবা এই ক্ষমতাটা পেয়েছিল।আমাকে বিয়ে করার আগে তোমার বাবা স্বপ্নে দেখেছিলেন আমাকে বিয়ে করার পরদিন তোমার দাদা মারা যাবে।

তোমার বাবা কিন্তু তোমার দাদার মৃত্যুর পরেও আমায় বিয়ে করেছিলেন। আমি চাই তোমার মামার দেখা মেয়েটাকে তুমিও বিয়ে কর।ডায়েরিটার প্রথম দিকটায় তোমার দাদা তোমার বাবার জন্য লিখে গিয়েছিলেন, পরের দিকটায় তোমার বাবা লিখে গিয়েছেন তোমার জন্য,এবার তোমার লেখার পালা।আমি যেন চোখের সামনে এক অপরিচিতাকে দেখছি! তাকে যেন আমি চিনিনা।

আমার গলা শুকিয়ে এসেছে,চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।ক্রন্দন সুরে বললাম,মা এমনটা টা হবার কারণ কি? আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। মা মাথায় হাত রেখে শান্ত গলায় বললেন,সব রহস্য ভেদ করতে নেই।পৃথিবী কিছু রহস্য গোপনে পুষে রাখে।যেমন চলছে চলতে দাও।

ইডেনের ইকনমিক্সে পড়া মুনতাহাকে বিয়ে করেছি।মুনতাহার চোখ দুটো বিড়ালের মত।লাল টকটকে বেনারসিতে সে আমার দু বাহুর মাঝে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত