মায়ের ভাগ

মায়ের ভাগ

আমি পারবো না,মা কি একা আমার! তোদের বুঝি কোন দায়-দায়িত্ব নেই।যতটা সম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে উত্তেজিত ভঙ্গিতে! বললেন আসগর সাহেব।

তারা তিনভাই-বোন আজ জমায়েত হয়েছেন, মায়ের দায়িত্ব কে নিবে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে,দায়িত্ব নিতে আসলে কেউই রাজী নয়,সবচেয়ে ভাল হতো যদি, তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা যেতো।কিন্তু,বৃদ্ধাশ্রমে রাখলে আত্মীয়-স্বজনদের ছিঁ-ছিঁ রব পড়বে।তাদের যেন মা-বাপ নেই,যত্তসব! আসগর সাহেবের দুই ছেলে-মেয়ে।স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিঃঝঞ্চাট সংসার,মাকে তাদের সাথে রাখা মানে সংসারে ঝামেলা আনা। মা,বৃদ্ধ সেকেলে মানুষ, আসগর সাহেবের স্ত্রীর রুচির সাথে তিনি খাপ খান না।এছাড়া,তাঁকে দেখাশোনার একটা ব্যাপারও আছে। এতসব, ঝামেলার মধ্য দিয়ে আসগর সাহেব যেতে চান না।তার এক কথা,এতদিন তার মা তার কাছেই ছিলো, তিনি যথেষ্ট করেছেন,তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।

আসগর সাহেবের যুক্তি শুনে খেঁকিয়ে উঠলেন ছোট ভাই আজমল “কি বল্-লা, মাকে তুমি রাখছো মানে! তিন-মাস ই না রাখছো,এমন ভাব করতোছো,মনে হচ্ছে,সারাজীবন তুমিই রাখছো” আসল কাহিনী হচ্ছে আসগর-আজমল সাহেবের মা পালাক্রমে দুই ছেলের বাসায় থাকেন,আজ এর বাসায় এক মাস,তো কাল অপর ছেলের বাসায় আরেক মাস থাকেন।মাঝে-মধ্যে মেয়ে সাথীর বাসায় তিনি বেড়াতে যান, সেখানেও বেশ কিছুদিন কাটিয়ে আসেন।এখন,সমস্যা হচ্ছে,ছোট ছেলে আজমলের স্ত্রী প্রেগন্যান্ট, এ সময়ে তার নিজেরই সেবা-যত্নের প্রয়োজন,সে কিভাবে শাশুড়ির সেবা করবে? এ কারণে,তিনি আসগরের বাসায় টানা তিন-মাস ধরে আছেন।যদিও সখিনা বানু এখনও নিজের কাজ নিজে করতে পারেন, বাড়তি কোন সেবার তাঁর প্রয়োজন হয় না।বরঞ্চ,তিনি তাদের গৃহাস্থলীর কাজে যথেষ্ট সাহায্য করেন।

তাও যেন তিনি কারো মন জয় করতে পারেননি।বড় ছেলের বাসায় আজ তিনি তিন মাস ধরে আছেন,এই তিন মাসেই তাঁর উপর যেন সবাই বিরক্ত।বড় বৌয়ের এক কথা-আজমলের বৌ আজকে পেটে বাচ্চার অজুহাত দিচ্ছে,কালকে অজুহাত দিবে বাচ্চা ছোট,এসব কারণ দেখিয়ে সব দায়-দায়িত্ব আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। অপরদিকে, আজমল ক্ষণে ক্ষণে মেজাজ হারাচ্ছে,ভাইয়া লাই না দিলে ভাবী এত্ত সাহস পায় কোথা থেকে, কত বড় সাহস! তার বৌ সম্পর্কে বাজে কথা বলে! তার বৌ কি এতদিন মায়ের দেখাশোনা করেনি?

দুইভাইয়ের ঝগড়া,চেঁচামেচির শব্দ ছাড়াও মাঝেমধ্য মিহি সুরের কান্নার শব্দ শোনা যায়।সখিনা বানুর ছোট মেয়ে সাথী থেকে থেকে কান্না করছে।আহা,আজ সে মেয়ে বলে! ছেলে হলে সে ঠিকই মাকে নিজের কাছে রাখতো।সাথীর কান্নার শব্দ তার ভাইদের মনে সহানুভূতির বদলে বিরক্তির উদ্রেগ করে।দুই ভাই একইসাথে খেঁকিয়ে উঠে, চাইলে তো, তুইও মাকে রাখতে পারস, তোর তো ঝামেলাও নাই,তোর জামাই বিদেশ থাকে,তুই একা ফ্ল্যাটে থাকস, শুশ্বরবাড়ীর ঝামেলাও নাই।ভাইদের প্রস্তাব শুনে সাথী আতঁকে উঠে,তার মোটা মাথার ভাইয়েরা মেয়ে হয়ে জন্মাবার কস্ট কি বুঝবে? তারা কি জানে না! একটা মেয়ে কোন কিছু নিজের ইচ্ছায় করতে পারে না! এখন,মাকে তার কাছে রাখলে জামাই এর ও কাছে সে ছোট হবে।তার বর ভালো মানুষ, কিছু হয়তো বলবে না,কিন্তু,মনে মনে তো ঠিকই ভাববে,ছিঃ,দুটা ছেলে থাকার পরও মেয়ের কাছে থাকে।নাহ্ জামাই এর কাছে সে কিছুতেই ছোট হতে পারবে না।

সখিনা বানু এতক্ষণ, নিশ্চুপ হয়ে বসে বসে তাঁর তিন ছেলেমেয়ের কথা শুনছিলেন।তিনি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন,তাঁর তিন ছেলে-মেয়ে তাঁর দায়িত্ব ভাগ-বাটোয়ারা করার জন্য জমায়েত হলেও কেউ তার দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।সখিনা বানুর চোখের কোণে পানি জমে।

তাঁর তিন ছেলে-মেয়ে তা দেখলেও কেউ বিশেষ গা করলো না।কারণ,বৃদ্ধামানুষের চোখে সমস্যা থাকলে এমনিতেই চোখে পানি আসে।হঠাৎ,সখিনা বানু,ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “তোরা, তোরা না,ছোটবেলায় কে আমার সাথে ঘুমাবি,তা নিয়ে ঝগড়া করতি! আর আজ….” এতটুকু বলেই সখিনা বানু ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।মায়ের সাথেসাথে সাথী ও কেঁদে উঠলো “মনে আছে,আজমলতো প্রায়ই তোমার সাথে ঘুমাতো, মেয়ে ছিলাম বিধায় আমিই সবচেয়ে কম আদর পেয়েছি, তুমি তো আজমলকে বেশি আদর করতা।” বোনের কথা শুনে আজমল চেঁচিয়ে উঠলো “আমাকে বেশি আদর করতো মানে? কোন মা-বাবা আছে যে নিজের ছেলে-মেয়েকে আদর করে না?”

“আম্মু,আম্মু” এমন শব্দে সবার মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটলো,সবাই প্রায় একইসাথে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো, আসগর সাহেবের সাড়ে চারবছরের জময দুই ছেলে-মেয়ে তাদের মায়ের দিকে দৌড়ে আসছে, দুজনেরই আবদার তাদের কোলে নিতে হবে।আসগর সাহেবের বৌ,একটু চমকৃত হলেন, কপট হাসি হেসে দুজনকেই দুই হাতের সাহায্যে কোলে নিলেন।মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্য দেখে প্রত্যেকেই যেন চমকৃত হলো।মনের অজান্তেই ছোট বৌ নিজের পেটে হাত রাখলো।

নিজের বৌয়ের দিকে তাকিয়ে আজমল সাহেব একটু হাসলেন,তারও দিন আসছে! তিনিও বাবা হবেন।আসগর ও আজমলের পরিবারের উপর যেন সাথীর একটু হিংসাই হলো,উফ্, তার যে কখন বাচ্চা হবে!
সবার দৃষ্টিতে দৃশ্যটা স্বর্গীয় মনে হলেও, সখিনা বানু যেন তার নাতি-নাতনীর মধ্যে তাঁর ছেলে-মেয়ের ছায়া খুঁজে পেলেন।এ সাদৃশ্য তাঁকে আনন্দিত করলো নাকি, আতন্কিত করলো তা ঠিক বুঝা গেলো না।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত