বিচ্ছেদ বেদনা

বিচ্ছেদ বেদনা

আর তিন দিন পর অনুজার বিয়ে। তারপর অনুজা আমাকে একলা করে নতুন একটা জীবনে পাড়ি দেবে। তার ওই নতুন জীবনে আমার আর আগের মতো কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে না। একটু হলেও অনুজার প্রতি আমার যে অধিকারবোধ টা কমে যাবে তাতে কোনরকম সন্দেহ নেই। ব্যাপার টা আমার মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই ভীষণ করে সত্যি। এটাই বাস্তব। অনুজার সঙ্গে যে ছেলেটার বিয়ে হবে সে যথেষ্ট স্মার্ট। হ্যান্ডসাম। চাকুরীজীবী। ডান হাতে ঘড়ি পড়ে। অনুজার পাশে সে উপযুক্ত এবং মানানসই। এতে কোনরকম ‘কিন্তু’ নেই। এই যে তাদের দুজন কে পাশাপাশি খুব মানাবে, মানানসই তে কোনরকম ঘাটতি থাকবে না, এই ব্যাপার টায় আমার হৃদয়ে ক্ষতের কারণ হয়ে উঠছে। ভালোবাসার সংজ্ঞা অনুযায়ী যাকে ভালোবাসা হয় তার সুখে নিজেকে সুখী ভাবা লাগে। তার ব্যথায় নিজেকে ব্যথিত হতে হয়। আর এসব কিছু না হলে বুঝে নিতে হয় যে তার প্রতি ভালোবাসা আসতে এখনো বাকি আছে কিমবা আসেনি। অনুজা কে নিয়ে আজ আমি ভীষণ স্বার্থপর।

কেননা অনুজার সুখের কথা ভেবে আমি নিজেকে আজ সুখী ভাবতে পারছি না। ওর সুখ ব্যাপার টা মেনে নিতে বড্ড সমস্যা হচ্ছে আমার। ওর সুখে নিজেকে আমার দুঃখী লাগছে আজ। আমার মনে হচ্ছে অনুজা আমার পাশেই থাকুক। ও যেনো আমাকে ছেড়ে না যাক। হাজার কষ্ট হলেও ও যেনো আমার কাছেই থাকে। আমার জন্য কাঁদুক। হাজারও বাধা বিপত্তির দেওয়াল গুলোকে ও ছোট করে রাখুক। অনুজার প্রতি যে আমার এতো ভালোবাসা আছে অনুজার বিয়ে টা ঠিক না হলে হয়ত বুঝতে পারতাম না। কত গুলো বছর একসঙ্গে কাটালাম তবু একবারও বলতে পারলাম না তোকে আমার ভালো লাগে। তোকে আমি ভালোবাসি। নিজের ক্যারিয়ার আর ফ্যামিলি টাকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে অনুজা আমার জীবন থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছে অথচ টের পাইনি। গুরুত্ব দিইনি। আজ হঠাৎ করে আমার মনে হচ্ছে অনুজা ছাড়া এজীবন আমার বৃথা। আমার ক্যারিয়ার গড়ার সব স্বপ্নগুলো ওকে ছাড়া প্রাণহীন, উদ্যমহীন। ওর মতো মেয়েকে বন্ধু হিসাবে পাওয়া একটা ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। তবুও ওকে আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু আজ হারাতে চলেছি। ধরে রাখতে পারলাম না ওকে। এই মুহূর্তে আমি ওর জন্য একটা গাছের ছায়ার নিচে একটা বেঞ্চে বসে আছি।

ও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছে আজ। কাছের বন্ধু বলতে ওর আমিই আছি। আমারও কাছের বন্ধু বলতে ও-ই আছে। লু এর কারণে ঘামে অতিরিক্ত ভিজে গেছি। জামার উপরের দিকে দুটো বোতাম খুলে দিলাম। ভিতরে একটু হাওয়া ঢুকিয়ে ঠান্ডা করবার জন্য। একটু স্বস্তিও হল। কষ্টও হচ্ছে ভীষণ এটা ভেবে যে এটাই হয়ত আমাদের শেষ দেখা। এরপর সবকিছু অন্যরকম অন্যভাবে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়াই পড়াশোনা করে বড় হবার স্বপ্ন টায় দেখে এসেছি। প্রেম ভালোবাসা টাকে কোনদিনও গুরুত্ব দিইনি। তবে আজ কেন যেন মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। এযাবৎ অনুজা আমাকে টাকাপয়সা, বইখাতা, কলম ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। অনুজা আমার মায়ের সঙ্গে মেয়ের মতো পরিচিত। অনুজা আমাদের বাড়ি নিয়ম করে আসতো। মায়ের সঙ্গে গল্প করতো। এসমস্ত কিছু আমি আগেভাগে মিস করতে লাগছি। আমাদের বাড়িতে ওর অনুপস্থিতির সংখ্যা টা এবার ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। অনেকক্ষণ ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করার পর অবশেষে অনুজাকে আমি দেখতে পেলাম আমার কাছে এগিয়ে আসতে।

আমি একদৃষ্টি তে ওর হেঁটে আসাটা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। ভাবতেয় অবাক লাগছে আজকের পর ও আমার সঙ্গে আর এভাবে দেখা করতে আসবে না কোনদিন। এলাকা ছাড়িয়ে বহুদূর.র.র অনুজা চলে যাবে কোন দালান বাড়ির এক বড় সংসারের হয়ত বড় বউ কিমবা মেজবউ হয়ে। নানান কাজ, নানান দায়িত্ব ওকে ঘিরে ধরবে আর আমাকে অপ্রয়োজনীয় ভাবে ওর দায়িত্ব গুলো আমাকে ভুলিয়ে দিতে বাধ্য করাবে। ভাবতেয় আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস নিই। ততক্ষণে অনুজা আমার কাছে চলে এসেছে। আমার পাশে এসে বসেছে।

আমি অনুজার দিকেই তাকিয়ে আছি চোখের পলক পড়ছে না। তারপর অনুজা ওর ব্যাগ থেকে কতগুলো দুহাজার টাকার নোট বের করে আমাকে দিল। তারপর বলল “কাকিমার ওষুধ গুলো শেষ হয়ে গেছে বলিসনি তো আমাকে। আর পড়ছিস তো? মনযোগ দিয়ে পড়। যখন যে বইটার প্রয়োজন বোধ করবি তখন সেটা কিনে নিবি। আর তো তোর সঙ্গে সেভাবে দেখা হবে না আমার। তাই নিজেকেই এবার নিজের দায়িত্ব টা নিতে হবে।” আমি টাকা গুলো নিচ্ছি না। চুপচাপ বসে আছি। মুখ থেকে আওয়াজও বের হচ্ছে না আমার। অনুজা বলল “কি হলো?” তারপর হঠাৎ আমি অনুজার হত দুটো ধরলাম। আমার চোখ থেকে জল টপ টপ করে পড়ছে আমার। তারপর বললাম “অনু বিয়েটা ভেঙে দে রে। আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি তোকে কখনওই বলিনি যে আমি তোকে ভালোবাসি। বাট আমি বাসি। তোকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। তোর মতো আমি আর কাউকে পাবো না। প্লিজ।” এর আগে আমি এভাবে কোনদিন কাঁদিনি। কখনো প্রয়োজন পড়েনি কাঁদার। কিন্তু আপন কাউকে হারিয়ে ফেলার যে কি কষ্ট সেটা আমি টের পাচ্ছি। অনুজা কোন উত্তর করে না।

তারপর বলে “টাকা গুলো ধর।”
আমি বলি আমার টাকার প্রয়োজন নেই আমার তোকে প্রয়োজন।
– এটা আর সম্ভব নয়। বিয়ের কার্ড পৌঁছায়নি এমন আর একটাও আত্মীয়ের বাড়ি বাকি নেই। এখন যদি বিয়েটা ভেঙে দিই তাহলে এই দুটো বাড়িতে কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছিস একবারও? মান সম্মান বলে আর কিছু থাকবে?
আমার চোখের জল থামে না। আবেগে ভেসে যাই। বলি আমি ওসব কিছু বুঝিনা। আমার তোকে দরকার। তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না। অনু আবার আমাকে বোঝায়। চোখ মুছিয়ে দেয়। চুপ করতে বলে। তারপর আমি কোন কথা না বলে রাগ করে বাড়ি চলে আসি।

বাড়ি ফিরে নিজের রুমেই শুয়ে থাকি। চোখ থেকে জল পড়া বন্ধ হয় না আমার। মা কে বলতে পারি না কিছুই। অনুজা ফোন করলে ফোন তুলিনা। রাতেও কিছু খাইনি। পরেরদিন সকাল হলে বুঝতে পারি অনুজা এসেছে। আমার রুম থেকে শুনতে পাই অনুজা মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম কিন্তু অনুর গলার আওয়াজ পেয়ে তড়িঘড়ি আমি টেবিল থেকে একটা বই উঠিয়ে নিয়ে পৃষ্ঠা উলটাতে থাকি। একটু পরেই অনু আমার ঘরে আসে। আমার কাছে এসে বসে। তারপর ধীরে ধীরে কাঁপা গলায় বললো “বাচ্চাদের মতো কেন এমন করছিস বলতো? তোকে দেখে তোর থেকেও আমার কষ্ট বেশী হচ্ছে। এইটুকু ধৈর্য নিয়ে জীবনে বড় হওয়া যায় না। তুই নিজেকে আমার জায়গায় রেখে দেখ আমি কতটা চাপের মধ্যে আছি।” কথা বলতে বলতে অনুর চোখদুটো ভিজে আসে। অনু দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে নিজের চোখ দুটো মুছতে থাকে। আমার এবার মায়া হয় অনুকে দেখে। আমি বলি ঠিক আছে রে। চুপ কর। তারপর অনু বললো টাকা গুলো কাকিমা কে দিয়ে দিয়েছি।

আজ অনুজার বিয়ে। মাঝের দুটো দিন ঝড়ের গতিতে পার হয়ে গেলো আমার। এক্সাম হলের তিন ঘন্টা যেভাবে পার হয়ে যায় কিচ্ছু বোঝা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে দুটো দিন পার হয়ে গেলো। দুদিন একটা বারের জন্যও বই খোলা হয়নি আমার। শুধু অনুজা কে মনে পড়ছিল বারবার। পড়াশোনায় মনোযোগ আসছিল না। বিকেল হলে খেলার মাঠে হাজির হই। নিজে না খেলে দর্শকের মতো বসে বসে ক্রিকেট খেলা দেখি। সন্ধ্যা হলে সবাই এক এক করে বাড়ির দিকে রওনা হয়। আমি বাড়ি ফিরি না। সন্ধ্যার পরও একা বসে থাকি মাঠে।

সন্ধ্যা টা পেরিয়ে রাত হয়ে যায়। আমি মাঠেই শুয়ে থাকি। আকাশ দেখি। ফোন টা হাতে নিয়ে অনুজার ফোন এসেছে কিনা যাচাই করি। কাঁদি। অনুজার সঙ্গে কাটানো আমার স্মৃতিময় মুহূর্ত গুলো আকাশের বুকে ভেসে ওঠে ছবির মতো। আমি সেগুলো দেখতে পাই। রাত টা আমি খোলা আকাশের নিচেও কাটাতে পারি না। অস্বস্তি তে ছেয়ে যায় সময় গুলো। একফোঁটাও ঘুম অনুভব করি না চোখে। মাঠের মাঝখানে শুয়ে থেকেই আমার ভোর হয়ে যায়। তবু চোখ থেকে জল পড়া বন্ধ হয় না। তারপর সকাল হবার আগেই বাড়ি ফিরি। মা কৈফিয়ত চায় কোথায় ছিলাম আমি সারারাত। আমি বলি একটা বন্ধু দের বাড়িতে ছিলাম মা। আমি বুঝতে পারি মা-ও সারারাত ঘুমায়নি। আমি মাকে আর কিছু বলি না। সম্পূর্ণ সকাল হলে অনুজা আমাকে মেসেজ করে। আমি উত্তেজিত হয়ে ওর মেসেজ পড়ি।

লেখে “কি করছিস?” আমি বলি কিছু না। তুই? অনুজা বলে “আমি এই স্নান করলাম।” আমার রাগ হলো খুব। তারপর লিখলাম কাল সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। প্যাঁচার মতো জেগেছিলাম। এই জীবনে আমার আর বোধহয় ঘুমও আসবে না। আর হ্যাঁ তুই স্নান কর।

অনু আর কোন মেসেজ করে না। ওর কোন উত্তর না পেয়ে আমি ত্রিশ মিনিট পর আবার মেসেজ করলাম সরি রে অনুজা। ভালো থাকিস। মেসেজ টা পাঠিয়ে টেবিলের উপর ফোন টা আমি রেখে দিই। তারপর জানালার ধারে এসে দাঁড়াই। একটু পর মা এসে আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলে এটা কাল বিকেলবেলা পিওন এসে দিয়ে গেছে দেখ তোর কিছু দরকারি হবে হয়ত। আমি অনাগ্রহের সঙ্গে খাম টা হাতে নিলাম। তারপর খাম টা খুলে একটা আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে মাকে বললাম মা তোমার ছেলে একটা সরকারি চাকরি পেয়েছে।

[ সমাপ্ত ]

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত