বৃষ্টিভেজা গাধামানব

বৃষ্টিভেজা গাধামানব

ফুফু বাবার সামনে বসে আছেন।বাবার মাথা প্রচণ্ড গরম। বাবা বললেন,”তোর জামাইটা তো দিন দিন বিশাল বেকুব হচ্ছে।আমাকে বলে কী না আমি রাজনীতি বুঝি না।সামান্য ভদ্রতা শিখে নি।” ফুফু আহত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোনো মেয়েই তার স্বামীর অপমান সহ্য করতে পারে না। তিনি কিছু বলছেন না ঠিকই,কিন্তু তার চোখে জল ছলছল করছে। তিনি রাগ করে এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেও কিছু করার থাকবে না। কিন্তু বাবার মনে তিনি কষ্ট দিবেন বলে মনে হয় না;যদিও বাবা উনার আপন ভাই না,চাচাতো ভাই।তবুও উনি বাবাকে নিজের ভাই থেকে বেশি সম্মান করেন।এর একটা কারণও আছে অবশ্য।

কারণ পরে বলবো। আগে আমাদের সবার পরিচয় দিয়ে দিই। বাবার নাম সাজ্জাদ হোসেন। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। এখন সারাদিন শুয়ে বসে বই পড়েন। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসংগীত শুনেন।এসবের পরও তিনি সারাক্ষণ রেগে থাকেন। ফুফুর নাম আছমা হক। ২২ বছর ধরে ব্রিটেনে থাকেন।বিয়ের পরপরই চলে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন আগে তার স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। ফুফুর স্বামী মানে আমার ফুফা সাহেবের নাম জামাল ভূঁইয়া। উনি ব্রিটেনের প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন বিজনেসম্যানের মধ্যে একজন।তাই বাবার কথামতো ফুফাসাহেব এতোটা বেকুব না সেটা নিশ্চিত।

ফুফুর মেয়ের নাম নিতু। ১৯ বছরের তরুণী। শেষ দেখেছিলাম ৬ বছর বয়সে।১৩ বছর পর আবার দেখছি। অনেক বড় হয়ে গেছে। চেহারায় বিদেশী ভাব একদমই নাই। এত ফর্সাও না,খানিকটা শ্যামলা। তবুও চেহারায় মায়াবী ভাব আছে। যদিও বাংলা উচ্চারণে যথেষ্ট দূর্বল। আমি সাফাত। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি হাইয়ার সেকেন্ড ক্লাসে।এখনো বেকার।মাঝেমধ্যে চাকরির ইন্টার্ভিউ দেওয়া ছাড়া আমার তেমন কোনো কাজ নেই।বাবার মতে আমি নিম্নশ্রেণীর গাধা;উচ্চশ্রেণীর গাধা হওয়ারও যোগ্যতা আমার নাই।

ফুফুর বাবা মা যখন এক্সিডেন্টে মারা যান তখন উনার বয়স ৩ বছর। এরপর আমার দাদার কাছে বড় হোন। দাদা যখন মারা যান তখন উনার বয়স ৭ বছর।এর পর বাবাই ফুফুকে নিজের বোনের মত বড় করেন। তারপর তাকে বিয়ে দেন জামাল সাহেবের কাছে। ফুফাসাহেব মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো।বাবাকে অনেক সম্মান করেন। তবুও বাবা কেনো যেনো ইদানীং উনাকে দেখতে পারেন না। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে ফুফা বললেন, “সাফাত,কালকে তোমার ফুফু আর নিতুকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাবো।তুমিও চলো,দিনে দিনেই চলে আসবো।”

“এই গাধাকে নিয়ে কী হবে,গাধাকে দিয়ে হালচাষ হয়?” সবার সামনে অতি সাধারণভাবে কথাটি বললেন বাবা।
আমিও স্বাভাবিকভাবে খেতে থাকলাম,নিতু খাওয়া বন্ধ করে বাবার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলো।এত বড় ছেলেকে কেউ এরকম কথা বলতে পারে তা মনে হয় বিশ্বাস করতে পারছে না। ফুফু বললেন “এত বড় ছেলেকে গাধা বলছেন কেনো ভাইজান?কিরকম দেখায় না ব্যাপারটা?” “গাধাকে গাধা না বলে ছাগল বলবো?কোন ব্যাপার কীরকম দেখায় সেটা আমি বুঝি না?” উত্তেজিত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন বাবা। সবাই চুপ করে গেলেন। বাবাকে রাগানোর কোনো মানে হয় না। খাবার টেবিল থেকে উঠে ফুফু আমাকে বললেন,”নিতুকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারবি?একা একা ঘরে বসে বোর হয়ে যাচ্ছে।”

-“আমি কেম্নে ঘুরাবো?কী দেখাবো ঘুরিয়ে?”
-“এটাও শিখিয়ে দিতে হবে?ভাইজান তো তোকে এমনি গাধা বলে না।”
-“আমি গাধা থেকেও অধম ফুফু। আমি তো পিঠে করে ভারও বইতে পারি না।”

ফুফু দুঃখী চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি মজা করছি না সিরিয়াস সেটা বুঝার চেষ্টা করছেন মনে হয়। নিতু আর আমি রিক্সায় বসে আছি। ফুফু রাগ করবেন তাই বাধ্য হয়ে নিতুকে নিয়ে বের হয়েছিলাম।ভেবেছিলাম হেঁটে হেঁটে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাসায় চলে আসব। কিন্তু বের হওয়ার পর বিপদ টের পেলাম। সে রিক্সা দেখেই পাগল হয়ে গেলো রিক্সায় চড়বে,অনেক বছর নাকি রিক্সায় উঠা হয়নি। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম রিক্সায় উঠা সম্ভব না। তখন সে প্রায় কেঁদে দেয় অবস্থা। জগতের কোনো পুরুষের সাধ্য নেই তরুণী মেয়ের কান্না সহ্য করতে পারে,সে আমার মত নিরস বা গাধা শ্রেণির পুরুষই হোক না কেনো। তাই জগতের নিয়ম মেনে এখন আমরা রিক্সায় বসে আছি। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর নিতু বলল, “এই ড্রাইভারের গা থেকে তো ঘামের স্মেল আসছে।” আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে রিক্সাচালকের দিকে তাকালাম,ব্যাটা মনে হয় শুনে নাই অথবা শুনলেও না শুনার ভান করছে।

আমি বললাম,”এগুলা হালাল পরিশ্রমের ঘাম, এসব ঘামের গন্ধকে স্মেল না বলে সেন্ট বলাই বেটার।” নিতু এই কথায় তেমন পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না।সে রাস্তার পাশে একটা মানুষের জটলার দিকে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর আমাকে জিজ্ঞেস করলো,”এত মানুষ এখানে কী করে?” “এরা সবাই লেবুর শরবত বানানোর প্রক্রিয়া দেখছে।”আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম। “এতে আবার দেখার মতো ইন্টারেস্টিং কী আছে?স্ট্রেইঞ্জ ব্যাপার।” নিতু যথেষ্ট অবাক হয়ে কথাগুলো বললো। “এই ব্যাপার বুঝতে হলে খাঁটি বাঙ্গালি হতে হয়। আমাদের কাছে সবই ইন্টারেস্টিং। আমরা জাতিটাই ইন্টারেস্টিং।” খানিকটা গর্বের সাথেই বললাম কথাগুলো।

নিতু আর কথা না বাড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলো। আকাশে অনেক মেঘ করেছে,যেকোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে।এমন সময় আশপাশের পরিবেশ নিতুকে মুগ্ধ করে তুলেছে। সে খুব করে চাচ্ছে বৃষ্টি হোক।বৃষ্টি হলে আজ সে ভিজবে,অনেকক্ষণ ভিজবে,সাফাতকে সাথে নিয়ে ভিজবে। “আমি আর যাইতে পারুম না। বৃষ্টিতে আমি চোহে দেহি না।” রিক্সা রাস্তার পাশে থামিয়ে কথাগুলো বললো রিক্সাচালক।

“এটা কেমন কথা?বৃষ্টিতে আবার কেম্নে কেউ চোখে দেখে না?আর এখান থেকে ফিরব কেম্নে আমরা?গাড়িও তো পাওয়া যাবে না এখানে।” কিছুটা রাগান্বিত স্বরে আমার মুখ থেকে কথাগুলো বের হলো। “আমি দেহি না। তো কী করবেন আমারে?মারবেন?” উদাস মুখে কথাগুলো বললো রিক্সাচালক। “সমস্যা নাই।চলেন হেঁটে বাসায় ফিরি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাব।” কিছুটা খুশি হয়েই বাক্যগুলো বললো নিতু। আর কিছু বলা বৃথা। তাই বিনা তর্কে রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। নিতু আমার সামনে হাটছে,ফাঁকা রাস্তা হওয়ায় ভালোমতোই বৃষ্টিতে ভিজছে সে। এই প্রথম লক্ষ্য করলাম মেয়েটা লাল শাড়ি পরেছে,সাথে লাল কাচের চুড়ি,লাল লিপস্টিক, লাল টিপ। একটা মেয়ের সাথে এতক্ষণ ধরে ঘুরছি অথচ সে যে শাড়ি পরেছে তা দেখি নাই। আমি আসলেই গাধামানব। নিতু কিছুক্ষণ পর বললো,”সাফাত ভাই,আপনিও আমার সাথে ভিজেন।ইট ফিলস রিয়েলি গুড।”

একটা তরুণী মেয়ের সাথে বৃষ্টিতে ভিজলে মায়ায় জড়িয়ে পড়তে হয়। সেই মায়া ভাঙ্গার ক্ষমতা জগতের কোনো পুরুষের নেই। তবুও আমি নিতুর কথামত ছাতা বন্ধ করে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর নিতু আমার হাত ধরলো। বাঙ্গালী যুবক হিসেবে এই অবস্থায় লজ্জায় চুপসে যাওয়ার কথা,আমি এই নিয়মের বাইরে এসে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,”সামনে একটা রিক্সা আসছে,চলো ঐটাতে উঠি।তাড়াতাড়ি চলে যাব।” নিতু মন খারাপ করলেও কিছু বললো না,শুধু হ্যা সূচক মাথা নাড়লো। নিতুকে রিক্সায় তুলে দিয়ে আমি উল্টোদিকে হাটতে লাগলাম।নিতু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো, কিছু বললো না।

আমি বৃষ্টির পানি গায়ে লাগিয়ে হাটতে লাগলাম। তরুণী মেয়েরা খুব সহজেই মোহে পড়ে,কিন্তু সেই মোহ ভাঙ্গতেও বেশিদিন যায় না। তাই শুরুতেই মোহ কাটিয়ে দেওয়ায় নিজেকে মুক্ত মুক্ত মনে হলো,গাধামানব হিসেবেও গর্ব হলো নিজের উপর।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত