জানালা

জানালা

এ মাসে আবার ইলেক্ট্রিসিটি বিল অনেক বেশি এসেছে। আহেলীকে বললেও শোনে না। নির্ঘাৎ আবার সেই হু হু ঠাণ্ডা এসি চালিয়ে শুয়ে থাকছে সারাদিন!

পুকাইটারও মাঝখান থেকে বদভ্যাসটি গেড়ে বসেছে, একটু গরম হলেই সে একেবারে অস্থির করে দেয়! শীত পড়ে গেছে, এখন আদৌ আর এসি না চালালেও চলে – কিন্তু কে সেটা বোঝাবে এদের! মা আর ছেলে দুজনেই নাকি ঘেমে নেয়ে যায়!

গত সেপ্টেম্বর থেকে পুকাই বাড়ির পাশেই একটা প্লে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে৷ ফলে একা ঘরে শুয়ে বসে আয়েস করার অঢেল সময় পাচ্ছে আহেলী এখন।

হাতে ধরা চিঠিগুলোয় আলগা চোখ বোলাচ্ছিল দেবজিৎ। আজ সারাদিন অফিসে পরের পর বোরিং কিন্তু ক্রিটিকাল মিটিং করতে হয়েছে। মাথার পাশগুলো টিপটিপ করছে। কিন্তু প্রতিদিনের কাজ দিনের দিন সেরে ফেলাটাই ওর অভ্যেস, ফেলে রাখা পোষায় না। আজ বেশ অনেকগুলো চিঠি এসেছে তো, আহেলির অ্যাড-অন কার্ডের বিলও এসেছে। বাকিগুলো কাজের কিছু নয়, হেল্প এজ ইন্ডিয়ার কার্ড একটা আর দুটো বিজ্ঞাপনী খাম। বিজ্ঞাপনগুলো পরে দেবজিৎকেই খুলে দেখতে হবে আবার, আহেলী তো ঠিক করে না দেখেই ফেলে দেয়! অনেক সময়েই ভালো অফার বা ডিস্কাউন্ট ক্যুপন থাকে ভিতরে।

বড়লোকের বিটিকে বিয়ে করার এই জ্বালা। খালি নিজের আয়েস আর সুখ চেনে, সেসবের জোগান যে কোথা থেকে আসে তা ভাবে না। এই যে এত লোন নিয়ে ফ্ল্যাটটা কিনল দু বছর আগে, তার ই এম আই দিতে মাসে মাসে কতরকম ফন্দিফিকির করতে হচ্ছে দেবজিৎকে, সে খবর রাখে কেউ?

এই ফ্ল্যাট বুক করা নিয়েও কত ঝগড়া তখন। সবথেকে নিচের ফ্লোর নাকি মোটেও পশ নয়, উপরের দিকের ফ্লোরে নিতে হবে। এদিকে তখন সাততলা অবধি আর খালি নেই কিছু, সব বুক হয়ে গেছে অলরেডি। তার ওপরের ফ্ল্যাটগুলো আবার আরো অনেকটা বেশি কার্পেট এরিয়া। অতিরিক্ত স্কোয়্যার ফুট প্লাস ফ্লোর রাইজ মিলিয়ে সেগুলোর দাম এর চেয়ে রীতিমত বেশি।

আহেলীর বায়নাক্কায় পাত্তা দেয়নি দেবজিৎ, এটাই বুক করে দিয়েছে এসে। তাছাড়া, শুনতেই একতলা, নিচের পার্কিং লট ধরলে তো দোতলাই হয় তো, কলকাতায় আহেলীর বাবার বাড়িও তো তাই-ই!

একবারই শুধু কিছুক্ষণের জন্য দেবজিতের মনে হয়েছিল ফ্ল্যাটটা কেনা ভুল হয়েছে। ফ্ল্যাটটা নামী বিল্ডারদের নয়, ফলে হাই ফাই কম্পাউন্ড নেই। তা দেবজিৎ মফস্বলের ছেলে। গাছপালা, কুকুর বিড়াল, ইঁদুর বাদুড় কিছুই তার চোখে অড লাগে না। পিছনদিকের পাঁচিলের ওপারের ঝোপঝাড় ঢাকা পোড়ো জমির দিকে দুবারও তাকায়নি সে। কিন্তু পাঁচিলের ফুটো গলে যে একটা সাপ এপারে চলে আসতে পারে তা ও-ও ভাবতে পারেনি। সন্ধে হয় হয়, ওরা তিনজনে ফিরছিল মুভি দেখে। তখন বেশিদিন হয়ওনি শিফট করে। হঠাৎ, একদম পায়ের সামনে কিলবিলে শরীরটা।

পুকাইয়ের কান্না, আহেলির আর্তনাদ, নিজের আতঙ্ক – সব মিলিয়ে কিছু ভাবারও আগে এক ঝটকায় পাশ থেকে থান ইটটা তুলে মাথাটা থেঁতলে দিতে দু সেকেন্ডও ভাবেনি দেবজিৎ। আওয়াজ শুনে গার্ডগুলো ছুটে আসতে আসতেই খাল্লাস। গার্ডগুলোর ওপর খুব রাগারাগি করেছিল আহেলি, পরদিনই পাঁচিল মেরামত হয়েছিল তার ফলে। না হলে, অশান্তির চোটে টিকতে পারত না সে আর।

তবে হ্যাঁ, গত ছমাসে একটু একটু করে ফ্ল্যাটটা সাজিয়েছে আহেলী খুব সুন্দর করে। নরম ক্রীম রঙের দেওয়ালের বসার ঘরে সেলফ প্রিন্টেড ট্যান কালারের ভারি, খানদানি জেল্লার পরদা, পরদার সঙ্গে ম্যাচিং সোফাসেটে উজ্জ্বল কালো রঙ দিয়ে ওরলি পেইন্ট করা সোনালি কুশন, সিলিং এ ছোটর মধ্যে পদ্ম শেপের ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি। শোবার ঘর, গেস্ট রুমেও তেমনি রুচিসম্পন্ন সাজ। অফিস থেকে এসে এমন একটা ঘরে পা রাখলেই মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যায়।

কার্ডের বিলটা খামের মুখ ছিঁড়ে বার করতে যাচ্ছিল দেবজিৎ। অস্বস্তিটা তখন শুরু হল।

নাম না জানা, প্রচণ্ড বাজেরকমের অস্বস্তি একটা।

কেউ যেন অদৃশ্য ছুঁচ ফোটাচ্ছে ওর সারা গায়ে।

চারদিকে চোখ চালায় দেবজিৎ। সব যেমন থাকে অন্যদিন অবিকল তাই আছে। বাঁদিক ডানদিক ঘুরে সামনে তাকানোর সময়ে মুখটা একটু ওঠাতেই এক ঝটকায় ফ্রিজ করে গেল সে।

দূর হলেও, কাচের ওপারে, অবয়বটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। একহারা তাগড়া জোয়ান চেহারার একটা লোক। এদিক ফিরেই দাঁড়িয়ে। ন্যাড়ামাথা, গায়ে গলাবন্ধ কালো জামা বা সোয়েটার। মুখটা পরিষ্কার দেখা না গেলেও, এটা বোঝা যাচ্ছে যে লোকটা চেয়ে আছে সরাসরি এই দিকেই।

চোখের ভুল ভাবার চেষ্টা করল দেবজিৎ। কিন্তু না, লোকটা একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আহেলী এখন পুকাইকে নিয়ে ভিতরের বেডরুমে ঘুম পাড়াচ্ছে জানে সে।। দরজা বন্ধ, এসি চলছে। চেঁচিয়ে গলা চিরে ফেললেও কিছু শুনতে পাবে না।

পোডিয়াম লেভেলটায় বাচ্চাদের খেলার জায়গা আছে মূলত। এটাও পার্কিং এর ওপরে বানানো, তাই ওদের ফ্ল্যাটের একদম মুখোমুখি। এত রাত্রে, সেখানে আর কেউ নেই। লোকটা এতক্ষণ জানলা থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, এবার হঠাৎ বড় বড় পায়ে এগিয়ে এল জানলার একদম সামনে। কাচের গায়ে মুখটা প্রায় ঠেকিয়ে ফেলেছে যেন, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভোঁতা নাক, নির্মম বাঁকা মুখ। পাশের ফ্ল্যাটের আলো পড়ছে নাকি, চোখগুলো অমন লাল রঙের জ্বলছে যে?

দেবজিতের সমস্ত শরীর কোন মন্ত্রবলে অসাড় হয়ে গেছে। সম্মোহিতের মত চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারছে না সে।

লোকটা এবার আরো ঝুঁকে পড়ে চোখ চালাতে লাগল এদিক ওদিক। দেবজিতের দিকেও তাকাল কি একবার?

চিঠিগুলো কখন দেবজিতের হাত থেকে খসে গিয়ে পায়ের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। টের পাচ্ছে কুলকুল করে ঘাম বেরোচ্ছে সারা শরীরে, মাথা দশমণি পাথর, জিভ ঠোঁট সব শিরিষ কাগজের মত খরখরে, বুকে দড়াম দড়াম করে হাতুড়ির বাড়ি। কখন থেকে চেঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সে, কিন্তু একফোঁটা শব্দ আসছে না গলায়।

ফ্ল্যাটগুলোর লেটার বক্সও এই পোডিয়ামে। দশ মিনিট আগে ডিনারের পর নিচে নেমেছিল দেবজিৎ, একেবারে সিগারেট খেয়ে লেটার বক্স চেক করে আসবে বলে। এখন তার চোখের ঠিক সামনে, সামান্য ওপরের লেভেলে তার ফ্ল্যাটের জানলা।

জানলার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে বসার ঘরের ঝাড়বাতি আলো, ক্রিম দেওয়াল, দামী পর্দা।

আর লোকটা। জানলার কাচের ওপারে।

ন্যাড়া মাথায় চাকা চাকা দাগ, টকটকে লাল চোখ, ধারালো শ্বদন্তদুটো ঠোঁটের বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

যেন বিষদাঁত।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত