ক্লস্ট্রোফোবিয়া

ক্লস্ট্রোফোবিয়া

শুধু মাত্র একটু চুল শুকোনো, হাঁটু মুড়ে বসে চারটি বড়ি দেওয়া, টুকটাক গোলাপ টগরের টব, এই লোভেই ছাদের খোঁজ। বিয়েবাড়ির ঢালা বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা শেষ বাচ্চাটা যেমন এমাথা থেকে ওমাথা গড়ায় প্রায় তেমনই শহর থেকে গড়াতে গড়াতে শঙ্করী নোটনপাড়া, থানা বয়রা, বাস স্টপ নোনাহালিতে পৌঁছেছিল। বাড়ি ভাল, ছোট, কলি ফেরানো, ছাদখানা মাটিমাখা পালোয়ানের বুকের মত চওড়া চেটালো। হ্যাংলাপুটুর ল্যাজে এক ফালি ন্যাকড়া বেঁধে দিয়েছিল মাধববুড়ো। মাধবের ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে।

এ অসুখের নাম নোনাহালিতে কেউ বাপের জন্মে শোনে নি। ব্লকের ডাক্তারবাবুই বলছিল একদিন। হ্যাংলাপুটু শুনেছিল। তবে কুকুরের স্মৃতিশক্তি ভাল হলেও মুখে ভাষা তো নেই তাই কাউকে শেখাতে পারে নি। ডাক্তার বলছিল “মাধবদা, তোমার এই যে কেবল দম আটকে আসছে মনে হওয়া, এ এক রোগ। এর নাম ক্লস্ট্রোফোবিয়া। তাই তুমি তোমার কুকুরের গলাতেও বকলেস বাঁধতে পারনি। ল্যাজে ন্যাকড়া বেঁধে ছেড়ে দিয়েছ বেওয়ারিশ নয় বোঝাতে।শঙ্করীর পিছে পিছে হ্যাংলাপুটু বাড়ি অব্ধি গিয়েছিল কারণ ওর কোঁচরে কিছু মুড়ি রয়ে গেছিল যা সে বাসে আসার সময় খাচ্ছিল। নামার পর আঁচল থেকে মাঝেমাঝে মুড়ি ঝরছিল টুপটাপ। পুটু কখনও মুড়ির গাছ দেখেনি। অবাক বিস্ময়ে মুড়িগুলোকে উপেক্ষা করে গাছটির পিছনে হেঁটেছিল সে।

নোটনপাড়ার নোনাহালি আসলে মফস্বলের থেকেও এক দাগ কম মফস্বলী। এমন সব দুপুর পোড়া গা মোচড়ানি গোধূলি রাজপাট যে এখনও কত রয়ে গেছে তা একমাত্র সরকারী হাসপাতালের ডাক্তাররাই জানে। চারপাশে দগদগে পোড়া, গ্যাঁজলা ওঠা কষ, হাসপাতালের দোরগোড়ায় ভ্যানে শুয়ে থাকা জল ভাঙ্গা প্রসূতির কাতরানি, ঘোলাটে চোখ ফাটা পা নিয়ে গলায় দড়ের বাপ এই সবের মধ্যে এক কাপ সর-ভাসা চায়েই ডাক্তারের জীবন। তবে ডাক্তারের চাকরির দায় আর শংকরীর চুল শুকোনোর সাধ দুইই মিটিয়েছে নোনাহালি এ কথা শুধু হ্যাংলাপুটুই বোঝে ।শঙ্করী লাল শাড়ি কালো ব্লাউজ পরে ছাদের আলসেয় দাঁড়ায়।

নিচ থেকে ওর চোখ দেখা যায়। সে চোখের রং রোদের রঙের সাথে পালটায়। চড়া রোদে যখন এক পোয়া বিকেল মেশে তখন চোখের রং থাকে উদ্গ্রীব। যখন দু পোয়া বিকেল মেশে তখন রং হয় অপেক্ষা আর যখন তিন পোয়া বিকেল মেশে তখন রং হয় খুশি। ওই তিন পোয়া বিকেলেই ডাক্তার সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে একবার উপরের দিকে তাকায়। পুটুও তাকায়। ওর ল্যাজটা ঘনঘন নড়ে। ডাক্তার পকেট থেকে একটা বিস্কুট বার করে তারপর এক পা প্যাডেলে এক পা মাটিতে রেখে নিচু হয়ে ফেলে দেয় বিস্কুটটা। পুটু কিন্তু তখুনি বিস্কুটটা তোলে না। সে তো আসলে হ্যাংলা নয়। তাকিয়ে থাকাকে যদি হ্যাংলামো বল তো শংকরীও হ্যাংলা। বিস্কুটটা মাটিতে দেখে তাই প্রথমে পুটু কৃতজ্ঞতা জানায়। ওদিকে ডাক্তারের উদারতায় শংকরীর বুকে দুটি কুন্দ ফুটে ওঠে। আর শংকরীর চোখের আলো দেখে ডাক্তার ভাবে রাজপাটটি মন্দ নয়, শুধু যদি রান্নার লোকটির হাত একটু সরেস হত। কাপাসনরম বিকেলে তিন জোড়া চোখ তিনটি ভাবনা নিয়ে এক সরলরেখায় দাঁড়ায় একটি মুহূর্তমাত্র।

ইতিমধ্যে বর্ষা নামে। তখন নোনাহালির পথে সাইকেল চলে না। কাদার অমোঘ টানে চাকা মাটি মাটি চাকা হয়ে থেমে থাকে। ডাক্তার হড়কে পিছলে ডাকব্যাকের গামবুটে কাদা লেপে হাসপাতাল যায় আর আসে।

ওদিকে ছাদের শ্যাওলা শংকরীকে আলসে ঘেঁষে দাঁড়াতে মানা করে। হ্যাংলাপুটু মাধবফকিরের দেওয়া খিচুড়ি খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে শংকরীর দরজা অব্ধি যায় বটে কিন্তু বিস্কুটের আশা করে না কারণ কাদা থেকে বিস্কুট খুঁটে খাবার জন্য সে ক্লস্ট্রোফোবিক কথাটি শেখেনি। সন্ধ্যের পর একদিন হাতে আনাজের খোসার ঝুড়ি নিয়ে শঙ্করী দরজায় আসে। হ্যাংলাপুটু সরে দাঁড়ালে কাঁচা নর্দমায় আবর্জনাটা ফেলে দিয়ে আঁচলের গিঁট খোলে। ছোট দুটো বিস্কুট এগিয়ে দেয় মুখের কাছে। অবাক কৃতজ্ঞতায় বিস্কুটদুটো চিবোতে চিবোতে হ্যাংলা দেখে ভেতরে মোড়ায় ডাক্তার বসে আছে, হাতে চায়ের কাপ মুখে হাসি।

বিস্কুটের রকম বদলায় মাঝে মাঝে। মাঝেসাঝে দরজা খোলে না। ফিরে গিয়ে ফকিরের দাওয়ায় শোয়। সেই দিনগুলোতেই রাতের দিকে বাস থেকে দুজনে নামে একসঙ্গে। ফকিরের চা দোকানের বসা উনুনের ধার ঘেঁষে রাখা গরম কেটলি থেকে চা কিনে খায়। পুটু সেদিন নিজের ঘরের বিস্কুটই খায় ওদের হাত থেকে আর মনে মনে ভাবে এ জন্মে তবে তারও সংসার হল। মাধব ফকিরেরও হয়ত হত যদি না বাঁধনজনিত ক্লস্ট্রোফোবিয়াটুকু না থাকত। আহা ফকির জানলই না বাঁধনে কত সুখ।

মাঝে কটাদিন বৃষ্টিতে প্রায় বানভাসি হাল হয় নোনাহালির। চারপাশের আট দশ গাঁ থেকে ভ্যানে করে লোক আসছে। একা ডাক্তার আর সামলাতে পারে না। বিকেলে শঙ্করীর ঘরে আনাজের খোসা খুব বেশি থাকেও না। তাও সে দরজা খোলে। পুটুর দিকে তাকায়। একখানা বিস্কুট কি দুটো মুড়ি … এজন্য কী আসে পুটু! সে তো হ্যাংলা নয়। কিন্তু মানুষ আর কবে ভালোবাসা বুঝেছে। খাবারটা দিয়ে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দেয় শংকরী। তার মধ্যে ফাঁক দিয়ে শূন্য মোড়াখানা দেখে নেয় পুটু।

ওদিকে হাসপাতালে অতিরিক্ত চাপের কারণে একজন অস্থায়ী নতুন নার্স আসে যার কাজ করার মত ইচ্ছা, স্বাস্থ্য আর জ্ঞান তিনটেই আছে। উপরি একটি গজদাঁতও। ফলে ডাক্তারের ফেরার সময়ের ঠিক থাকে না। এদিকে আকাশটিকে শরৎ কব্জা করেছে অতএব শুকনো শ্যাওলায় পা রেখে শঙ্করী অনায়াসে ছাদের আলসে ঘেঁষে দাঁড়ায় আবার।

ডাক্তার ওই পথেই ফেরে। নার্সটি অস্থায়ী তায় তার থাকার জায়গাও ডাক্তারের বাড়ির কাছেই। স্বাভাবিকভাবেই সাইকেলে দুটো মানুষের ভারসাম্য সামলাতে গিয়ে ডাক্তারের পকেট থেকে বিস্কুট নামে না মাটিতে, চোখও ওঠে না ছাদের পানে।শঙ্করী অপেক্ষা করে চাহনিবিন্দু দিয়ে আঁকা সরলরেখাটির। পুটুও। কিন্তু শঙ্করী তা বোঝে না তাই ওরা চলে গেলে সে নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে একটু মুড়ি হাতে নিয়ে।

শঙ্করীর চোখ ভিজে। শঙ্করী চুল খোলা। শঙ্করীর ঠোঁট সাদা।
সে এক অদ্ভুত মায়ায় ডাক দেয় “নে, খাবি না?”

হ্যাংলাপুটুর ভেতরে হাহাকার ওঠে। ইচ্ছে করে সেই প্রথমদিনের মত শঙ্করী মুড়িগাছ হয়ে আঁচল থেকে মুড়ি ঝরাতে ঝরাতে হাঁটুক, পিছনে পিছনে হাঁটবে সেও। এই ভেজা চোখ এই সাদা মুখ নিয়ে তো শঙ্করী আসেনি নোনাহালিতে। দমবন্ধ লাগে হ্যাংলাপুটুর। প্রাণপণে আছড়ায় ল্যাজটা যেন ওই ন্যাকড়ার বাঁধনটা খুলতে পারলেই এই সব মানবিক দুঃখগুলো থেকে দূরে পালাতে পারবে। রাতে ফকিরের উঠোনে নিভন্ত গরম উনুনের পাশে শুয়ে হ্যাংলা ভাবে ক্লস্ট্রোফোবিয়া তবে একে বলে?

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত