এমনিতে সহজে মাথা গরম করিনা। কিন্তু Uber driver এমন ভাবে বলল “আরে দাদা দাঁড়ান না,এত তাড়া থাকলে cancel করে দিন, দশ মিনিট মিনিমাম লাগবে আমার”, শুনে মাথাটা গরম হয়েই গেল।তাড়া আমার নেই আসলে,ওটা বলতে হয়।কিন্তু তাও?
ভালো ভাবেও বলা যেত কথাটা,এরকম ব্যবহার কেন ভায়া? মনে মনে ভেবে নিয়েছি দু-খানা স্টার দেব রেটিং-এ,আর চোখ দিয়ে খুঁজছি 9599 দিয়ে শেষ হচ্ছে কোন গাড়ির নাম্বার।
শেষে সে এল। নামটা বলছিনা,কারণ আছে। দশ মিনিট পরেই এল। মুখের কথার নড়চড় হয়নি!
ভেতরে বসে দরজাটা একটু জোরেই লাগালাম,শুনিয়ে।
চাকা গড়াতেই প্রশ্ন করল সে,তখন গলা স্বাভাবিক।
-“কোথায় যাবেন?”
-“লোকেশনে দেখাচ্ছে দেখুন,ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ,চিত্তরঞ্জন”।
এসি-তে বসে আমিও একটু ঠান্ডা হয়ে গেছি ততক্ষণে। কি দরকার বাবা রাগারাগির,কয়েক মিনিটের ব্যাপার, তারপর আর দেখা-সাক্ষাত হবে না কোনোদিন।
একটু পরে কথা বলল সে,
-“দাদা,রাগ করবেন না, আসলে খুব সমস্যায় আছি দাদা, তখন মাথাটা এত গরম ছিল আপনার যখন ফোন এল, সরি দাদা”।
-“আচ্ছা,ও ঠিক আছে,হতেই পারে”।
-“দাদা আপনি কি ডাক্তার?”
-“না না,হতে বাকি আছে,পড়ছি সবে,সেকেন্ড ইয়ার”।
-“সেকেন্ড ইয়ার?কোনটা নিয়ে পড়ছেন?”
-“কী?”
-“মানে কী নিয়ে পড়ছেন? হার্ট না…”
-“না না,ওসব না,এই কবছর সবার একই পড়া”।
-“ওহ,আচ্ছা আচ্ছা, সেকেন্ড ইয়ার না আপনার? মানে যদি প্রবলেম বলি তাহলে ওষুধ বলতে পারবেন?”
মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের এককথায় ‘পারবনা’ বলতে সম্মানে লাগে,ঘুরিয়ে বললাম,
-“কী প্রবলেম?”
-“প্রবলেম একটা আছে দাদা। মানে তুমি ডাক্তারি পড়ছ,তাই তোমাকে বলা যায়। ‘তুমি’ বললাম কিছু মনে করোনা দাদা”।
-“আরে না না,কী প্রবলেম বল”।
-“ব্যাপারটা একটু..মানে..তুমি ডাক্তারি পড়ছ তাই বলছি,খারাপ ভাবে নিওনা দাদা…একটু সেক্সের সমস্যা”।
-“হুম, কী সমস্যা?”
-“ওই একটু টাইমের সমস্যা। তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
ক্যাবের ভেতর অন্ধকার বেশি। ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। কথাগুলো বলতে বলতে গলা আটকে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম।
-“কবে থেকে হচ্ছে এরকম?”
-“এই এক বছর হল প্রায়।”
-“হটাত??? নেশা কর কিছু?”
-“না দাদা,তোমাকে তাহলে প্রথম থেকে বলি দাদা…
আমার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হল। একটা মেয়ে আছে তিনবছরের। শুরুতে সব ভালো ছিল খুব। বউ ভালোবাসত আমায়, সব ভালো ছিল। আমি সেই তখন থেকেই গাড়ি চালাই। সংসারটা বড় করব এই ভেবে ওভারটাইম করতাম,বাড়তি টাকা জমাতাম। টাকা জমিয়ে ফ্রিজ কিনলাম, তারপর একটা ইলেক্ট্রিকে চলে ওই ওভেনগুলো কিনলাম। সব ভালো চলছিল। মেয়েটা হল। আরও খুশি বাড়ল। মেয়েটাকে ভালো স্কুলে দেব বলে আরও খাটতে লাগলাম।…”
আমাকে বলতে বলতে যেন নিজেও একবার মেমোরি-লেন দিয়ে যাত্রা করছিল,গলার tone -এ প্রকাশ পাচ্ছিল সেটা। আমি একবার ভালো করে দেখে নিলাম গাড়িটা ঠিকঠাক চালাচ্ছে কিনা, আবেগে ভেসে গিয়ে আমায় সমেত ঠুকে না দেয়।যায় হোক,ও বলছে ওদিকে…
“…সব ঠিক এগোচ্ছিল, সেসময়ই এই এক বছর আগে থেকে এই সমস্যাটা শুরু হল। আর এই সমস্যাতে আমার সংসারটা গেল দাদা। যে বউ একসময় কত ভালোবাসত, সেও পালটে গেল। এই গত একবছরে আমার সব হারিয়ে গেছে। একটা রাত সুখ-শান্তি নেই। রোজ রাতে ঝগড়া,কান্নাকাটি। ছোট মেয়েটা আছে,ও ভয় পেয়ে যায় দাদা। কি করব? তাই এখন বেশিরভাগ রাত ফিরিনা। গাড়িতে কাটিয়ে দিই,বন্ধুদের কাছে চলে যাই।গেলেই সেই ঝগড়া…”
এতটা বলতে বলতে গলাটা যে কান্নায় ভিজছে ওর,বুঝতে পারলাম। খারাপ লাগতে লাগল।
কী বলব, বলে ফেললাম,
-“সমস্যাটা এখনও আছে এটা বুঝছ কি করে? বাড়িই যদি না ফেরো,দুজনে যদি সময়ই না কাটাও..”
-“ওসবে আর লাভ নেই দাদা,শরীরটাই তো সব না। ওটার জন্যেই ঝামেলা শুরু হয়েছে মানছি,কিন্তু এখন আর ভালোবাসাটাই নাই,শরীর ফিরিয়ে কী করব জানিনা, আদৌ আর সব ঠিক হবে কিনা। জানো দাদা, যখন প্রথম প্রথম সমস্যাটা বুঝলাম, তখন বউ কিছু বলত না, বলত ঠিক হয়ে যাবে। এক-দু মাস পর জানলাম অন্য ছেলের সাথে সময় কাটাচ্ছে দুপুরে…”
বলতে বলতে গাড়িটা রাস্তার ধারে side করালো। রাস্তার একটা আলো কাঁচ পেরিয়ে ওর মুখে এসে পড়ছে। পরিষ্কার দেখলাম চোখে দিয়ে জল গাল বেয়ে পড়ছে। কষ্ট-লজ্জা-ব্যর্থতা সব মেশানো তাতে।
-“sorry দাদা। এরকম ভাবে তোমায় নিয়ে গাড়ি চালাব না তাই একটু দাঁড়ালাম”।
-“আমার তাড়া নেই। তুমি একটু জল খাও। কেঁদোনা।”
জল খেয়ে দু মিনিট একটু বাইরে দাঁড়িয়ে আবার স্টার্ট দিল গাড়ি।
-“তোমায় অনেক জ্বালাচ্ছি দাদা”
-“কিচ্ছু জ্বালাওনি,তুমি কী বলছিলে বল”।
-“ও ছাড়ো,ওসব আর কী বলব। তুমি বল ওই সমস্যাটা সারবে কি না?”
-” সারবে,তুমি তার আগে বল যেটা বলছিলে, কাউকে বলেছ আগে?”
-” কাউকে না দাদা, লজ্জায় বলতে পারিনা। একটা বন্ধু জানে, ওই যার কাছে মাঝে মাঝে রাতে থাকি। আর এই তোমায় বললাম।”
-” তুমি চাইলে বলতে পার যা ইচ্ছে, বললে হালকা হবে একটু।”
-“নিজের বউকে আমি সামলাতে পারিনি,এটা বললে কি হালকা হওয়া যায় দাদা? সেদিন আমি কিচ্ছু বলতে পারিনি ওকে,সব জানি। কী বলব? নিজেরই তো ক্ষমতা নেই আমার। বলব কী?
অনেকবার ভালোভাবে বুঝিয়েছি। কিছু বলতে গেলেই এক কথা দিয়ে খোঁটা দেয়। এই যে এত খাটি সংসারের জন্যে,ওরা ভালো থাকবে তার জন্যে এক্সট্রা ডিউটি করি,এগুলোর কোনো দামই নেই। এখন তো আবার রেল-লাইনে চলে যায় ঝগড়া হলেই, সে ধরে-বেঁধে আবার ঘরে আনি,পায়ে পড়ে ক্ষমা চাই,বলি বাবা তুমি থাকো তোমার ঘরে,আমিই যাচ্ছি। এভাবেই চলছে দাদা। বন্ধুরা বলে ছাড়াছাড়ি করে নিতে,আমি পারিনা। এখনও ভালোবাসি দাদা। এখনও মাঝে মাঝে ভাবি সব হয়ত ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি অবাক হয়ে শুনছি। যখন কোলকাতা আসি,সবাই বলেছিল ‘বড় শহর,কত লোক কত অভিনয় করবে নিজের ধান্দায়’, কিন্তু এও কি অভিনয় হতে পারে? আমি জানি পারেনা। আবার চোখ ছলছল করছে দাদাটার।
-“এই যে তুমি ফোন করলে তখন,তার আগেই বউকে ফোন করেছিলাম রাতে মেয়ে কিছু খাবে কিনা,নিয়ে যাব তাহলে। সে এত গালাগাল করল ফোনে,যেন আমি ফোন করেছি ঘরে আর কেউ আছে কিনা সেই
সন্দেহে,উল্টোপাল্টা ভাষায় গালাগাল দেবে। রাগে ফোন কেটে দিলাম,মাথাটা গরম হয়েছিল, তুমি ফোন করে বললে তাড়াতাড়ি আসতে,তোমার সাথে খারাপ ভাবে কথা বলে ফেললাম..”
-“ও কোনো ব্যাপার না দাদা,তুমি এই যে এতকিছু বললে, কেউ আমায় নিজের এতটা গোপন কথা বলল, এটা ভেবেই ভালো লাগছে আমার”।
-“এখানে তো দাদা?”
দেখলাম কলেজের গেটে চলে এসছি।
-“হ্যাঁ,এখানেই রাখো। আর তুমি কাল কলেজে এসো,এখানে ডাক্তার দেখিয়ে দেবো।”
-“এখানে? তুমি থাকবে?”
-“আমি ব্যাবস্থা করে দেব। টিকিট করিয়ে।”
টাকা দিচ্ছি,হাত দুটো চেপে ধরল। তখনও চোখ ভিজে।
-“তুমি এত কথা শুনলে দাদা। অন্য কেউ হলে এতক্ষণ গাল দিয়ে শেষ করে দিত।”
আমি হাসতে গিয়েও আর হাসতে পারলাম না।”কাল এসো,নাম্বার তো আছেই,ফোন কোরো এসে” বলে নেমে গেলাম।জানলার কাঁচটা নামাল ও।
-“থ্যাংক ইউ দাদা,তুমি খুব ভালো।”
-“সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমাকে দাদা বোলো না।” এবার একটু হাসলাম। দিয়ে হাঁটা দিলাম বাড়ির দিকে। কতরকমের গল্প থাকে আমাদের আশেপাশে, আমাদের বাস্তব জীবনেই,সিনেমাও হার মানে সেখানে। ওই যে বলেনা ‘ Life is larger than cinema’, বা এরকমই কিছু একটা বলে, ঠিকই বলে।
ফোনে দেখলাম Uber খোলা আছে। ট্রিপ কম্পলিট।
how was your evening trip with ***?
নীচে পাঁচখানা তারা,আঙুল দিলেই কালো হয়ে যাবে তারাগুলো। এই তারাগুলো কালো হলে কি অন্য কোথাও,অন্য আকাশে তারা জ্বলে?
আজ হাওয়া নেই,গুমোট গরম!