শেষের চিঠি

শেষের চিঠি

প্রিয় বিট্টু,
এই হোয়াটস্যাপের যুগে এটাই হয়তো আমার প্রথম চিঠি।
এবং নিশ্চিতভাবে এটাই আমার শেষ চিঠিও।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস।
এটা আমার সুইসাইড নোট।
গত এক মাস আমার ওপর দিয়ে যে কি ঝড় গেছে তা তো তুই সবই জানিস।
কিন্তু, যেই গল্পটা মিডিয়াকেও বলতে পারিনি, সেটাই আজকে তোকে বলে যেতে চাই।
সেই গল্পটা হলো আমার গল্প।

তোর নিশ্চয় মনে আছে যে, আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে আমাদের নিউজ চ্যানেলের হয়ে আমি আর আমাদের ক্যামেরাম্যান কুনাল একটা খুব স্পেশাল স্টোরি কভার করতে মুম্বাই যাই।

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস, সেই স্টোরিটা হচ্ছে সারাটা দেশ যার ভক্ত, সেই স্বামী দেবভক্ত বাবার ওই মহা যজ্ঞের স্টোরি।
প্রথমে তো আমি প্রচন্ড খুশি ছিলাম যে, আমার জার্নালিজমের কেরিযারে এই প্রথম ইন্ডিপেনডেন্টলি এতো বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা স্টোরি কভার করার একটা সুযোগ পেয়ে গেছি বলে।

কিন্তু, কেই বা জানতো বল যে, এই স্টোরিটার জন্যেই একদিন আমি আমার লাইফ স্টোরিটাই শেষ করে দিতে বাধ্য হবো?

যাই হোক, তোর তো পুরোটাই জানা, তাই আর বেশি ঘ্যানাতে চাই না।
শুধু কিছু ডিটেলস বলে যেতে চাই, যেটা তুই জানিস না।

অনেক অপেক্ষা করে এবং অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে ফাইনালি স্বামী দেবভক্তজির সাথে সাক্ষাৎ হলো আমাদের।
উনি তার একদিন আগেই অ্যানাউন্স করেছিলেন যে, উনি নাকি উনার মুম্বাইয়ের আশ্রমেই ওই মহাযজ্ঞটা করবেন।
তুই তো জানিস যে, ভারতবর্ষে স্বামী দেবভক্তজির কতো কোটি কোটি ভক্ত ছড়িয়ে আছে।

এমনকি শাহরুখ খান, সলমন খানের মতো এতো বড় সেলিব্রেটিরাও দেবভক্তজির অন্ধভক্ত।
এক কথায়, দেবভক্তজি হলেন পুরো দেশের ভগবান।

সেই কারণেই এতো কষ্ট করলাম শুধুমাত্র দেবভক্তজির একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ পাওয়ার জন্যে।
আর ইন্টারভিউটা আমাদের চ্যানেলের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী লাইভ ব্রডকাস্ট করলাম।
ওই একটা ব্রডকাস্টের কারণে রাতারাতি আমাদের নিউজ চ্যানেলের ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার্স কতোগুণ বেড়ে গিয়েছিল সেটা নিশ্চয় তোর এখনও মনে আছে।
আমিও মোটিভেটেড ফিল করলাম।

ঠিক করলাম যে, দেবভক্তজির মহাযজ্ঞটা লুকিয়ে লুকিয়ে রেকর্ড করবো।
আমি শিওর ছিলাম যে, আমাকে আমাদের নিউজ চ্যানেল এটা করার পারমিশন তখনই না দিলেও, পরে বুঝিয়ে বললে আমার এই রেকর্ডিংটা ব্রডকাস্ট হবেই।

এবং তাতে আমি ও আমাদের নিউজ চ্যানেল – দুজনেই রাতারাতি ফেমাস হয়ে যাবো।
কিন্তু, আমার এই ফেমাস হওয়ার লোভই আমার কাল হলো রে।

ওই মহাযজ্ঞটার রাতে আমি আর কুনাল কিভাবে সবার নজর এড়িয়ে আশ্রমের ভেতরে ঢুকলাম, কিভাবে আবিষ্কার করলাম যে, আশ্রমের নীচে, মানে আন্ডারগ্রাউন্ডে এই দেবভক্তজির একটা পুরো সাম্রাজ্য আছে, এবং কিভাবে আবিষ্কার করলাম যে, দেবভক্তজি আশ্রম এবং দেব সেবার নামে আসলে একটা মস্ত বড় ড্রাগস, হিউম্যান ট্র্যাফিকিং এবং সেক্স racket চালাচ্ছেন – এই সবকিছুই তুই অলরেডি অনেকবার খবরের কাগজে পড়েছিস।
তাই ওগুলো আবার বলে সময় নষ্ট করতে চাই না।
এবার আসল গল্পে আসি।

আমরা আমাদের ক্যামেরায় দেবভক্তজির কুকীর্তির সব রকম প্রমাণ রেকর্ড করে নিলাম।
ঠিক করলাম যে, আর এই ভন্ড সন্ন্যাসীর ফালতু মহাযজ্ঞ রেকর্ড করে লাভ নেই।

এখনই বাইরে বেরিয়ে আমাদের ক্যামেরায় রেকর্ড করা ফুটেজ এডিট করেই আমাদের নিউজ চ্যানেলের অফিসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবো।

যেই সুড়ঙ্গটা আমরা দিয়ে এতো দূর অব্দি এসেছিলাম, সেটাই আমাদের একমাত্র ফেরার রাস্তা ছিল।
কিন্তু, সুড়ঙ্গটার মুখের সামনে গিয়ে বুঝলাম যে, সুড়ঙ্গটার মুখটা কে বা কারা যেন বন্ধ করে দিয়েছে!
বুঝলাম যে, ওরা জানতে পেরে গেছে যে, কেউ লুকিয়ে ওদের এই গোপন আন্ডারগ্রাউন্ড সাম্রাজ্যে ঢুকেছে!
আমাদের এইখান থেকে বেরোবার আর চেনা কোনও পথ নেই।

তার মানে, আমরা এখন ওদের শিকার!
এটা ভেবেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা হীম স্রোত বয়ে গেল!

কুনালকে পাশ ফিরে বলতে যাবো যে, এখন আমাদের কি করণীয় হতে পারে, এমন সময়, আমার পিঠের ওপর একটা রাইফেলের নলের মুখ অনুভব করলাম।

পিছন ফিরে তাকানোর দরকার পড়ে নি।

ওরা কিছু বলার আগেই বুঝে গিয়েছিলাম যে, আমরা ধরা পড়ে গিয়েছি।

ওদের মধ্যে থেকে একজন প্রথমেই আমাদের দুজনের মোবইল ফোনগুলো এবং সব রেকর্ডিংগুলো সমেত কুনালের ক্যামেরাটা নিয়ে চলে গেল দেবভক্তজির কাছে।

তারপর আমরা আর ওই ক্যামেরাটা বা ওই রেকর্ডিংগুলো কখনও চোখে দেখিনি।

ওই লোকটা আমাদের মোবইল ফোনস, কুনালের ক্যামেরাটা ও রেকর্ডিংগুলো নিয়ে চলে যাওযার পর, বাকি চার জন আমাদেরকে নিয়ে গেল মাটির নীচেরই একটা অন্ধকার গলির ভিতরে।

দেখে মনে হলো যে, এই গলি দিয়ে হয়তো সচরাচর কেউ যাতায়াত করে না।
তবে গলিটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়।
জায়গায় জায়গায় হালকা পাওয়ারের আলো জ্বলছে।
আমাকে আর কুনালকে পাশাপাশি দুটো আলাদা ঘরে রাখা হয়েছিল।
আমাদের দুজনের ঘর দুটোই ছিল ওই করিডরটার একে বারে শেষের দিকে।

মনে আছে, ওই করিডর দিয়ে যেতে যেতে অন্যান্য ঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা দুজনেই আঁতকে উঠেছিলাম!
দেখেছিলাম যে, ঘরগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বয়সের মেয়ে রাখা আছে।

সকলকেই এমন ভাবে ড্রাগ করে রাখা হয়েছে যে, ওদের কারোরই হুঁশ নেই, আবার পুরোপুরি অজ্ঞানও হচ্ছে না।
শুধু ঢুলছে এবং মুখ দিয়ে হালকা একটা গোঁঙানির মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে।

বুঝালাম যে, যেই মেয়েগুলোকে দেবভক্তজির লোকেরা সেক্স স্লেভ হিসেবে বিক্রি করে, তাদেরকে ধরে এই অবস্থাতে এই ঘরগুলোতেই বন্দী করে রাখে।

সেই রাতে আমাকে আর কুনালকে ওরা একটু জল পর্যন্ত খেতে দেয় নি।
কি বলবো বিট্টু, সে কি ভয়ানক পরিবেশ রে!

অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে ওই গা গুলানো ড্রাগসের গন্ধ আর ওই মেয়েগুলোর হালকা কিন্তু ভয়ংকর গোঁঙানি!
প্রথম এক ঘন্টা তেমন কিছু মনে হয়নি রে।

কিন্তু তারপর, যত সময় গড়াতে লাগলো, ততই যেন ওই হালকা গোঙানিটাই আমাদের কাছে অসহ্য মনে হতে লাগলো।

সে একই সঙ্গে এমন এক অদ্ভুত এবং দুঃসহ অনুভূতি যেটা মানুষ অন্তত শব্দে কখনও প্রকাশ করতে পারবে না!
কিন্তু, আমরা তখনও বুঝতে পারিনি যে, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের যা দুর্গতি হতে চলেছে, এইটা সেটার তুলনায় কিছুই না।

তখন যে ঠিক কটা বাজে তা জানার উপায় আমাদের ছিল না।
তবে এই টুকু বলতে পারি যে, তখন আমি ওই ঘরটার মধ্যে অন্তত তিন ঘন্টা তো কাটিয়েই ফেলেছি।
কয়েকটা মানুষের পায়ের শব্দ শুনে আন্দাজ করলাম যে, করিডোর দিয়ে আমাদের ঘরগুলোর দিকে দেবভক্তজির লোকজন হেঁটে আসছে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেবভক্তজির লোকজন এসে আমার আর কুনালের হাত দুটো শক্ত করে বেঁধে, আমাদের পিঠে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে দেবভক্তজির সামনে এনে হাজির করলো।

তারপর যা যা ঘটল, তা যেন সিনেমার এক একটা সিনের মতো আমাকে নির্বাক দর্শক বানিয়ে, আমার চোখের সামনে একের পর এক প্লে হতে থাকলো।

দেবভক্তজি ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছেন যে, আমাকে এবং কুনালকে মরতেই হবে!
কিন্তু, তার চেয়েও ভয়ানক হচ্ছে, তিনি আমাদেরকে যেই যেই উপায়ে মরতে আদেশ করলেন, সেইগুলো!
তার করা আদেশ অনুযায়ী, কুনালকে উনার লোকেরা আমার সামনেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে এবং আমাকে সেটা দেখতে হবে!

আমার জন্য দেবভক্তজির আদেশ ছিল যে, কুনাল মরে যাওয়ার পর, আমাকে উনার লোকেরা আবার ওই ঘরটায় বন্ধ করে দেবে এবং আমাকে ততক্ষণ ওরা কোনও খাবার বা জল খেতে দেবে না যতক্ষণ না আমি মরে যাই।

আমরা দুজনেই ফিজিকালি এবং ভার্বালি অনেক বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা আমাকে সামনের একটা পিলারের সাথে বেঁধে দিল।

আর কুনালকে ওরা একটু দূরে, একটা বড় খাঁচার মধ্যে ভরে দিয়ে খাঁচার দরজাটা বন্ধ করে, সেই দরজাটায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল।

সেই মুহূর্তে ওই মোটা দড়ির বাঁধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে আমার মাথায় শুধু এই কথাটায় ঘুরছিল যে, সৎ সাংবাদিক হতে গিয়ে এ কোন নরকে এসে পড়লাম!

খাঁচার ওপর থেকে কুনালের গায়ে লিটার লিটার পেট্রোল ঢালা হচ্ছে, আর আমি সেটা ছটফট করতে করতে তাকিয়ে দেখছি!

দেবভক্তজি যখন নিজের হাতে ওই ম্যাচকাঠিটা জ্বালালেন, তখন আমার হৃদয়ের স্পন্দনটা যেন বন্ধ হয়ে গেল!
তার পরের মুহূর্তেই শুনতে পেলাম কুনালের সেই বিকট চিৎকার, যা আমি মরা না পর্যন্ত আমার কানে বাজবে!
জ্বলন্ত অবস্থায় কুনালের ওই খাঁচাটার মধ্যে সেই ছটফট করাটা মনে পড়লে আমার এখনও গা শিউরে ওঠে জানিস!
তার সঙ্গে কুনালের সেই চিৎকার!

আমার ভাগ্য ভালো যে, আমাকে সেই নরকিয় দৃশ্য শেষ অব্দি দেখতে হয়নি।
তার আগেই কখন যেন আমি জ্ঞান হারাই।
জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারলাম যে, এবার আমার মরার পালা।

আমাকে অজ্ঞান অবস্থাতেই দেবভক্তজির লোকেরা আবার ওই ঘরটায় এনে ফেলে দিয়ে, ঘরটার দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।

ক্ষুদা ও তৃষ্ণাকে সঙ্গি করে, এবার আমার তিল তিল করে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
কত ঘন্টা কেটে গেছে, তা আন্দাজ করার অবস্থা আমার তখন নেই।

মাঝে ওই বিশ্রী ড্রাগসের গন্ধ আর সেই গোঁঙানির আওয়াজ সহ্য না করতে পেরে তিন বার বমিও করে ফেললাম।
ক্লান্তিতে ও তৃষ্ণায় তারপর কখন যে একটু তন্দ্রা মতো এসে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি।

হঠাৎ, গটগট করে আমার ঘরের দিকে এগিয়ে আসা কতগুলো বুট জুতোর আওয়াজ শুনে আমার তন্দ্রাটা ছুটে গেল।

আমার বুঝতে একটু সময় লাগলো যে, দেবভক্তজির লোকেরা আমায় নয়, আমার উল্টোদিকের ঘরের একজন মেয়েকে দেখতে এসেছে।

অন্য বন্দী মেয়েদের মতো ওই মেয়েটাকেও ওরা ড্রাগস দিয়ে কাবু করে রেখেছিল।
কিন্তু, ওরা জানতো না যে, ওই মেয়েটার ওই ড্রাগটা নেওয়ার ফলে ইনফেকশন হয়ে গেছে।
এখন সেই ইনফেকশন চূড়ান্ত আকার নিয়েছে এবং বেশ কয়েকটা মেয়ের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে।
সেই সব মেয়েগুলো এখন অবিরাম রক্ত বমি করে চলেছে!
এতগুলো মেয়ের কিছু হয়ে গেলে তো দেবভক্তজির কোটি কোটি টাকার লোকসান।
তাই দেবভক্তজির লোকেদের এতো ব্যস্ততা।

কিছুক্ষণ পরে দেখলাম যে, আমার ঘরের ইলেকট্রনিক দরজাটা আপনা আপনি খুলে গেল।

দেবভক্তজির লোকেদের কথোপকথনে বুঝালাম যে, ওরা অসুস্থ মেয়েগুলোকে বাইরে বের করবে বলে ওদের ঘরের দরজাটা খুলেছিল।

কিন্তু, একটা যান্ত্রিক প্রবলেমের ফলে সবকটা ঘরেরই দরজা খুলে গেছে।
যান্ত্রিক প্রবলেমটা ঠিক করতে সময় লাগবে, তাই দুজন লোককে আমার ঘরের সামনে পাহারায় বসিয়ে বাকি লোকজন অতি ব্যস্ত হয়ে ওই মেয়েগুলোকে কোথায় যেন নিয়ে চলে গেল।
তখনই বিদ্যুতের মতো আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল!
আমি ভাবলাম, এই আমার বাঁচার শেষ সুযোগ।

আর কিছুক্ষণ পরেই এই যান্ত্রিক প্রবলেমটা ঠিক হয়ে যাবে আর আমাকেও এই অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে নরকে পঁচে-গলে মরতে হবে।

সুতরাং, যা করার তা এক্ষুনি করতে হবে!
গল্পে পড়েছিলাম যে, মানুষ বাঁচার জন্যে জানোয়ারও হয়ে যেতে পারে।
সেদিন সেটা নিজে এক্সপিরিয়েন্স করলাম।

দু মিনিট আগেও আমার উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে যেন অদ্ভুতভাবে আমার মধ্যে এক অসীম শক্তির সঞ্চয় হলো।

চোখের পলকে আমি একটা ক্ষুদার্ত বাঘের মতো ওই দুটো পাহারাদারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম!
ওরা যথারীতি গুলি চালালো।
কিন্তু, ততক্ষণে আমি ওদের গলাদুটো ধরে ফেলেছি।
ফলে, ওদের দুজনেরই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।

পরের মুহূর্তেই আমি ওদের দুজনের মাথাদুটো মাটিতে চেপে ধরে রেখে, ওদের মুখদুটো প্রাণপণে দাঁত দিয়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে দিতে লাগলাম!

ওদের নাক, ঠোঁট, গাল কিছুই যখন আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না, তখন আমি ওদের ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
দেখলাম, করিডোরের সামনে আর কোনও পাহারাদার নেই।
এক ছুটে করিডোরটা পার করে এদিক ওদিক তাকালাম।
মেয়েগুলো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়াতে, সবাই ওদেরকে নিয়েই ব্যস্ত হয়েছে।
এই আমার সুযোগ!
কিন্তু, যেই রাস্তাটা দিয়ে এখানে ঢুকেছিলাম, সেটা তো ওরা বন্ধ করে দিয়েছে!
আর বেরোবার রাস্তা তো আমার জানা নেই!
তাহলে এখন উপায় কি?
অন্য গার্ডসরা যে কোনও মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে!
ফলে, যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে!
কিন্তু, অনেক খুঁজেও কোনও লাভ হলো না।
এখনকার সবকিছুই খুব সিরিয়াসলি প্ল্যান করে বানানো।

যখন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি, ঠিক তখনই চোখে পড়ল যে, দেওয়ালের একটা জায়গা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে ব্যাঁকা!

কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম যে, দেওয়ালের এই অংশটা আসলে একটা লুকানো দরজা।
কিন্তু, কোনও কারণে এটা পুরোটা বন্ধ হয়নি বলে দূর থেকে ওরকম মনে হয়েছিল।
আমি দরজাটা পুরো খুলে সামনে তাকিয়ে দেখি এক সারি সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে।
এবং একদম ওপরের সিঁড়িটার ওপর পড়া একটু অন্যরকম আলো দেখে আমার দু চোখে জল চলে এলো।
কতক্ষণ পরে যে একটু সূর্যালোক দেখলাম তা জানি না, তবে মনে হলো যেন কত বছর পর দেখলাম।
বুঝতে পারলাম যে, দেবভক্তজির লোকেরা তড়িঘড়ি করে ওই মেয়েগুলোকে এই পথ দিয়েই বাইরে নিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু, তাড়াহুড়োতে এই দরজাটা ঠিক করে বন্ধ করে নি।
বিট্টু আমি জানি যে, তুই একজন নাস্তিক।

তবু বলছি, সেদিন মনে হয়েছিল যে, ভগবান আমাকে যেন নিজের হাতে করে আমার দ্বিতীয় জীবনটা উপহার দিয়ে গেলেন।

কিন্তু, হায়!

ঈশ্বরের সেই অমূল্য দানের মর্যাদা আর রাখতে পারলাম কোথায়!
আমার কাছে দেবভক্তজির কুকর্মের কোনও প্রমাণ না থাকলেও, আমাদের নিউজ চ্যানেল আমি দেবভক্তজির আশ্রমের নীচে, উনার আন্ডারগ্রাউন্ড সাম্রাজ্যে যা যা দেখেছি সব কিছু আমার একটা ইন্টারভিউয়ের রূপে ঘটা করে ছেপে দিল।

খুব সম্ভবত ফেমাস হওয়ার লোভেই আমাদের নিউজ চ্যানেল এটা করেছিল।
তারপর খবরটা ছড়াতেই অন্য অনেক নিউজ চ্যানেল আমার ইন্টারভিউ নিল।
আমি ওদের সব কিছু ডিটেলে বলেছিলাম।
আমার ইন্টারভিউগুলো ভাইরাল হলো।
খুব দ্রুত দেশে একটা ছোটখাটো বিপ্লবী মানষিকতা দেখা দিল।
ফেসবুক আর টুইটারে আবার ঝড় উঠল।

“ ধর্মকে হাতিয়ার করে আর কতদিন দেবভক্তজির মতো লোকেরা আমাদের টাকা নিয়ে এইরকম নোংরামি করবে? ”

– এইসব স্লোগান উঠতে শুরু করলো সোশাল মিডিয়ায়।

কিন্তু, মাত্র কয়েকটা দিন পরেই হঠাৎ যেন কোনও এক অদৃশ্য শক্তি এই সবকিছুকেই ধামাচাপা দিয়ে দিল।
তুই তো জানিস যে, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বলিউড তারকা সলমান খান – সবাই দেবভক্তজির কথায় ওঠেন এবং বসেন।

দেবভক্তজির উনারা এতটাই অন্ধভক্ত।
তাই আশা করি তোকে আর বুঝিয়ে বলতে হবে না যে, কে এই সবকিছুকে ধামাচাপাটা দিল।
তা ছাড়া, আমার কাছে তো কোনও প্রমাণও ছিল না।

কিন্তু, তাই বলে আমার বার বার অনুরোধ করা সত্বেও কেউ একবারও দেবভক্তজির আশ্রমের নীচে উনার সত্যিই কোনও আন্ডারগ্রাউন্ড সাম্রাজ্য আছে কি না সেটা সার্চ পর্যন্ত করলো না!

যাই হোক, আমার চাকরি কোনও অজ্ঞাত কারণে চলে গেল।
বলা বাহুল্য, এর পিছনেও দেবভক্তজিরই হাত ছিল।
আমার ফোনে থ্রেট কল মাত্রাতিরিক্ত আসতে লাগলো।

থ্রেট কলারদের দাবি যে, আমি একটা প্রেস কনফারেন্স করে পুরো দুনিয়ার সামনে বলি যে, দেবভক্তজির বিষয়ে আমি আমার আগের ইন্টারভিউগুলোতে যা যা বলেছি সেই সবকিছু সম্পূর্ণ মিথ্যে।
ওই সবকিছু আমি বলেছি সস্তা পাবলিসিটি পাওয়ার জন্যে।

তবে, যতই থ্রেট কল আসুক আমি আজ অব্দি কিন্তু ওদের কথামতো প্রেস কনফারেন্সটা করতে রাজি হই নি রে বিট্টু।

কিন্তু, আস্তে আস্তে যেন ওরা পৃথিবীর সব রঙ আমাদের থেকে কেড়ে নিতে শুরু করলো।
একদিন তো বাবা বাজার করার সময়, কয়েকটা গুন্ডা বাবাকে হঠাৎ ওদের গাড়িতে জোর্ করে তুলে নিয়ে চলে গেল।
বিশ্বাস কর, পুলিশ সব জানত।
কিন্তু, কিছুই করেনি।

দীর্ঘ আটত্রিশ ঘন্টা পর ওরা বাবাকে হঠাৎ বাড়ির সামনের ফেলে দিয়ে যায়।
বাবাকে প্রাণে না মারলেও, বাবার কপালে, হাতে এবং অন্য অনেক জায়গায় কালসিটের দাগগুলো দেখে নিজেকে প্রথমবার এতটা অসহায় ফিল করলাম।

বুঝতে পারলাম, ওরা বাবাকে প্রাণে মারে নি কারণ, ওরা জানতো যে, মারার থেকেও মারতে যে পারি সেটা বোঝতে পারলে বেশি কাজ হবে।

তুই তো জানিস যে, আমি একটা লোয়ার মিডল ক্লাস ঘরের ছেলে।
এই দেশ ছেড়ে কোথায় যাবো আমরা বল?

আর এই দেশে থাকতে গেলে দেবভক্তজির লোকেদের কথামতো আমাকে ওই প্রেস কনফারেন্সটা করতেই হবে এবং সেটা আমি বেঁচে থাকতে কখনওই করব না।

তাই আমার এই ডিসিশনটা নেওয়া।
তবে বিট্টু, আমি চলে গেলে আমার পরিবারের কি হবে একবার ভেবে দেখেছিস?
ওরা আমার গোটা ফ্যামিলির যে কি হাল করে ছাড়বে সেটা কল্পনা করতে গেলেও আমি ভয়ে আঁতকে উঠি!
তাই আজ আমি একা মরণের পথে হাঁটবো না।
আমার সঙ্গে থাকবে আমার গোটা পরিবার!
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস।

এই সুইসাইড নোটটা আমি লিখলেও, ‘ আত্মহত্যা ’ নামক পাপটা করবো আমরা সবাই – আমি এবং আমার পুরো পরিবার!

আমরা সবাই মিলে দীর্ঘ আলোচনার পরই এই সিদ্ধান্তে এসেছি।
তুই হয়তো এটা ভেবে অবাক হচ্ছিস যে, যেই ছেলেটা মেট্রোয় সুউসাইড করার প্রথাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো এমন কি, সেটার বিরুদ্ধে টিভিতে টক শোও হোস্ট করেছে, সে কি করে আজকে সুইসাইডের পথ বেছে নিল।
আসলে আমিই ভুল ছিলাম রে।

যারা সুইসাইড করে, তারা মোটেও ভীতু নয়।
আজকে বুঝতে পারছি যে, তারা মরবার জন্যে মরে না, আসলে তারা বাঁচার আশায় মরে।
যাক গে, এমনিতেই চিঠিটা অনেক লম্বা হয়ে গেছে, তাই আর বকবো না।
এবার তাহলে আমরা আসি রে।
তবে যাওয়ার আগে শুধু একটা প্রশ্ন করে যেতে চাই।
আমাদের জীবনটা তো স্বয়ং ঈশ্বরের দান।
আমার ক্ষত্রে তো ঈশ্বর সেই দান একবার নয়, দু-দু বার করেছিলেন।

তাহলে কোন ক্ষমতায় ঈশ্বরের নামে এই তুচ্ছ অন্ধবিশ্বাস আমাদের থেকে আমাদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নিতে পারে?

তাহলে কি তাঁর নামে এই অন্ধবিশ্বাস স্বয়ং ঈশ্বরের থেকেও বেশি শক্তিশালী?

ইতি তোদের
বাবুন।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত