সাগরিকা

সাগরিকা

হাইস্কুলে ভর্তি হবার পর অনেক নতুন বন্ধু পেলাম,খুব ভালো লাগছে, নতুন স্কুলে মানিয়ে নিতে পারব কিনা সেই ভয়টা বরাবরই ছিল কিন্তু সেরকম কোনোকিছুই হয়নি। যেহেতু এটা

কো- এডুকেশন স্কুল, তাই বন্ধুর সাথে সাথে আমার অনেক বান্ধবীও হয়েছে,

তাদেরই মধ্যে একজন সাগরিকা।খুব মিষ্টি স্বভাবের চঞ্চল মেয়ে, তবে নারীসুলভ লজ্জা ও নম্রভাব ওর মধ্যে রয়েছে।দেখতেও বেশ ভালো, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্বেতপদ্মের মতো, মুখশ্রী নজরকাড়া। এছাড়াও ওর আরও একটি গুন রয়েছে ও অসম্ভব সুন্দর গান করতে পারত…অফ পিরিয়ডে যখন আমরা কমন রুমে গিয়ে বসতাম তখন ও সবাইকে গান শোনাত…প্রথমে ওর সাথে বিশেষ আলাপ ছিল না কিন্তু প্রথমদিন ওর গলায় “দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে” শুনে আমি এতোই মুগ্ধ হয়ে গেলাম যে নিজে থেকেই ওর সঙ্গে গিয়ে আলাপ করি। খুব মিশুকে স্বভাব আর ভদ্র ব্যাবহার ওর কথাতেই প্রকাশ পাচ্ছে।

এরপর যত দিন গেল ততই সবার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আরও পোক্ত হল।

স্কুলের সিনিয়র একটা দাদা সাকিব প্রায়ই সাগরিকাকে ডিস্টার্ব করত, কিন্তু ও ছেলেটাকে বিশেষ পাত্তা দিত না।স্কুলে সাকিব, সাগরিকার নামে উলটোপালটা গুজব রটতে লাগত সাগরিকা তাও চুপচাপ মেনে নিল কিন্তু ক্রমে ছেলেটার জ্বালাতনের মাত্রা এতই বেড়ে গেল যে একদিন সাগরিকা ওর নামে হেডস্যারকে কমপ্লেন করতে বাধ্য হল হেডস্যার খুব কড়া ছিলেন তাই সাকিবের এরকম অভদ্র ব্যবহারের জন্য ওকে স্কুল থেকে সাসপেন্ড করে দিল। স্যারের এই বিচারে সাগরিকাও যেন কিছুটা স্বস্তি পেল, কিন্তু সাকিব সাদাসিধে ছেলে ছিল না। যাবার সময় ও সাগরিকাকে শাসিয়ে গেল, “দেখে নেব”॥

এই ঘটনার পর অনেকদিন কেটে গেল।একদিন স্কুল ছুটির পর আমরা সবাই মিলে বাড়ি ফিরছিলাম। আমি, অর্নব, সায়ন, রাজ দল বেঁধে গল্প করতে করতে আসছি আর রাস্তার ওপারে সাগরিকা আর ওর বান্ধবী পূজা,সোমা, আর সুস্মিতারাও বাড়ি ফিরছে।সাগরিকা রাস্তার একদম ধারে ছিল।চোখাচোখি হতেই আমার দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি হাসল, আমিও হাসলাম॥ হঠাৎই একটা বাইক খুব স্পিডে এসে বাইক চালকের পিছনের সিটে বসা ছেলেটি খুব দ্রুত একটা অ্যাসিডের বোতল খুলে সাগরিকার গায়ে, মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দিয়ে খুব দ্রুত পালিয়ে গেল..ব্যাপারটা এতটাই আকস্মিক যে আমরা কী করব তা বুঝে ওঠার বিন্দুমাত্র সময় পেলাম না।

সাগরিকা ভয়ংকর চিৎকার করে রাস্তার ওপর পড়ে গেল। ওর গোটা শরীর তখন বেদনায় জ্বলছে। হাত, মুখ বিভৎস ভাবে পুড়ে গিয়ে সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। অ্যাসিড ছিটকে বাকিদের ব্যাগেও পড়েছিল কিন্তু সাগরিকা বাদে কারোর গায়ে পড়েনি। আমাদের স্কুলের কেমিস্ট্রি স্যার ও ইকোনমিস্কের স্যার তখন ওই রাস্তা দিয়েই বাইক নিয়ে আসছিলেন, সময় নষ্ট না করে ওনারা ওই বাইকটির পিছনে ধাওয়া করলেন॥

এদিকে রাস্তার ওপারে একটা বড়সড়ো ভিড় তৈরি হয়ে গেছে, একটা কান্নার রোল উঠেছে, সবাই দেখছে কিন্তু কেউ সাগরিকার কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। তারই মধ্যে কিছুজন ছবি তুলছে, কেউ আবার সাংবাদিকতার ভার নিয়ে পুরো জিনিসটা ফেসবুকে লাইভ করছে, অপরাধীকে ধরার কোনো চেষ্টা কারোর মধ্যে না দেখে অর্নব আর রাজকে ভিড়টা সরাতে বললাম,

আর বলে দিলাম কেউ যেন ছবি না তোলে, এবং এক্ষুনি পুলিশকে ফোন করে ডাকতে বলে আমি আর সায়ন ছুটতে ছুটতে সাগরিকার বাড়ি গেলাম ওর বাড়িতে খবর দিতে॥

সাগরিকার বাবা মাকে নিয়ে যখন রোডে এলাম তখন ভিড় আরও দ্বিগুন বেড়ে গেছে। লোকজন আরও বেশি বেশি করে ওর ছবি তুলে চলেছে আমার বন্ধুরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেও তাদের রুখতে পারছে না। সাগরিকার পুড়ে যাওয়া দেহটা শুকনো পাতার মতো কুঁকড়ে গেছে, আর ওর চামড়াগুলো গলে গিয়ে রাস্তার পিচের সঙ্গে আটকে গেছে, মুখতো বোঝাই যাচ্ছে না, শুধু ওর চাপা গোঙানি শুনতে পাচ্ছি সেটাও এই জনসমুদ্রে স্পষ্ট নয়। তারই মধ্যে কাকিমা (সাগরিকার মা) বিরাট চিৎকার করে রাস্তার মধ্যেই পড়ে গিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল, পূজা, সোমারা ওর মাকে হাজার সান্তনা দিয়েও চুপ করাতে পারল না, কাকিমা অনবরত কেঁদেই চলেছে।

এবার পাশের একটা মুদিখানা দোকানের কাকু ওনার দোকান থেকে সমস্ত চটের বস্তা বার করল, তারপর একটা কাঠের ভাঙা দরজাও জোগাড় করে দিল। এরপর আমরা সবাই মিলে হাতে চটের বস্তা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে খুব সাবধানে ওকে রাস্তা থেকে তুলে ভাঙা দরজটার ওপর শোয়ালাম॥

সাগরিকা রাস্তায় মুখ গুজে পড়েছিল বলে কেউ ওর মুখ দেখতে পায়নি, দরজাটার ওপর শোয়াতে ওর অ্যাসিড আক্রান্ত মুখটা আরও স্পষ্ট হল। ওর মুখ দেখা মাত্রই সঙ্গে সঙ্গে লো প্রেসারের কারনেই বোধ হয় আমার মাথাটা ঘুরে গেল যদিও সায়ন আমায় ধরে নিয়েছিল। নিজেকে সামলাতে এক মিনিটের একটু বেশি সময় লাগল। তারপর আবার দেখি জনৈক এক ভদ্রমহিলা রাস্তার উপরেই হুরহুর করে বমি উগরে দিলেন।

তারই মধ্যে ভিড় সরিয়ে আমরা একটা ভ্যান ডেকে দরজা সমেত সাগরিকাকে তুলে হসপিটাল ছুটলাম। ওকে হসপিটালে ভর্তি নেওয়া হল, যদিও আমাদের কারোরই মনের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। স্কুল থেকে প্রায় সকল টিচাররাই হসপিটালে এসেছেন।

সন্ধ্যের দিকে পরিস্থিতি একটু সহজ হতে হসপিটাল থেকে আমরা যে যার বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। সাগরিকার বাবা মা দুজনেই তখনো প্রচন্ড কাঁদছিল, কিন্তু কী বলেই বা সান্তনা দিতাম ওদের॥

ফিরে আসার সময় দেখলাম হসপিটালে পুলিশ সহ আমাদের কেমিস্ট্রি আর ইকোনমিস্কের স্যার ঢুকলেন। জানতে পারলাম স্যারেরা অনেক দুর পর্যন্ত পিছু করেও অপরাধীদের ধরতে পারেনি কিন্তু বাইকটার নম্বর নোট করে নিয়েছে॥

পুলিশের দারোগা বললেন, ” তোমাদের আরও কিছুক্ষন দাঁড়াতে হবে” বলে একে একে আমাদের সকলকে জেরা করলেন যে আমরা কিছু জানি কি না বা আমরা কাউকে সন্দেহ করছি কি না। সাকিবের সঙ্গে বচসার ব্যাপারটা আমরা পুলিশকে জানালাম। সেদিনের মতো আমরা যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম॥

পরদিন সকালে হসপিটালে ফোন করে জানতে চাইলাম সাগরিকা কেমন আছে? জানতে পারলাম ওর অবস্থা খুব শোচনীয়, শরীরের ৮০% পুড়ে গেছে আর ওর চামড়ার স্তরগুলোও উল্টেপাল্টে মিশে গিয়েছে,, তবুও ডাক্তাররা সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।

সেদিন আমরা কেউই স্কুল গেলাম না।

দুপুর দুটোর দিকে কেমিস্ট্রি স্যার ফোন করে ফোন করে বলল, বাইক সমেত দোষীরা ধরা পড়েছে। আমরা সব বন্ধুরা থানায় যাব বলে বেড়িয়ে পড়লাম। কাকুকেও ( সাগরিকার বাবা)
ফোন করে থানায় আসতে বললাম॥

পুলিশ যাদের ধরে এনেছে তারা সাকিব আর তার বন্ধুরা। থানায় সাকিবের বাবা সমেত আরও দশ বারোটা মতো লোক এসেছে। কাকু ওদের নামে মামলা করবে ঠিক করল, আমরাও সায় দিলাম, আমাদের বন্ধুর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি চাই।সাকিবের বাবা ভীষন রকম চোখরাঙানি দিয়ে কেস করতে মানা করলো, কাকু সেসব উপেক্ষা করে ওদের নামে মামলা দায়ের করলো।

এদিকে সাগরিকার অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছে, দেহ বলে কিছু নেই শুধু একটা পুড়ে যাওয়া মাসংপিন্ডে প্রানটাই আছে মাত্র।

এভাবে চার মাস অবধি সাগরিকা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছিল, কিন্তু আর পারেনি। সাগরিকার পরিবার খুব ভেঙে পড়েছিল, আমরাও সবাই খুব কেঁদেছিলাম, আমাদের এত কাছের বন্ধু, ওর কাছ থেকে আর কোনোদিনও গান শুনতে পাব না এটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল।

এদিকে কোর্টে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সেরকম কিছুই প্রমান করা যায়নি। সাগরিকার মৃত্যু হলেও, মামলার কোনো সঠিক সুরাহা হয়নি। দু বছর অবধি কেস লড়ার পরও কোনো সুবিচার না পাওয়ায় আইনব্যাবস্থার প্রতি ধিক্কারে কাকু কেস তুলে নিয়েছিল।

আমরা বারন করলে কাকু

বলেছিল, “কার জন্য কেস লড়ব বলতে পারো, কোনো দোষ না করেও আমার মেয়েটা শেষ হয়ে গেল আমি বুঝতে পেরেছি এদের শাস্তি এখানে হবার নয়।”

এত বড়ো অপরাধ করেও দোষীরা ছাড়া পেয়ে গেল। পেয়ে যায়, তারপর আবার অন্য একটা ঘৃন্য অপরাধ করে, আর মাঝখান থেকে সাগরিকার মতো হাজার হাজার নিষ্পাপ মেয়েরা প্রতিদিন এভাবেই সুবিচার না পেয়ে এক বিন্দু নোনা জল হয়ে মহাসমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়, আর কোনোদিনও তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। সার্থক হল রে তোর নাম…..”সাগরিকা”

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত