পথের ধারে

পথের ধারে

একটা লং ডিসটেন্স ট্রেন এ যাচ্ছি – সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস, গাড়িটা খুব কম জায়গাতে দাঁড়ায় ı সকাল সাতটা তে ঘুম ভেঙে গেল, মুখ ধুয়ে বসে আছি, চা ওয়ালা এলে চা খাবো ı ও মা ! সাড়ে আটটা বেজে গেল, গাড়ি তা কোথাও দাঁড়ালো না – কোনো চা ওয়ালা ও এলো না, এদিকে ক্ষিদে পাচ্ছে – কি করি ? বাঙালি চরিত্র বিরোধী একটা কাজ করতেই হলো – বৌ সকালের জল খাবারের নামে পরোটা আর মিষ্টি দিয়েছিলো, ব্যাগ খুলে তাই খেয়ে ফেললাম ı ভেবে দেখুন একবার ব্যাপার টা !

আমি হলাম গিয়ে বাঙালি, সকাল থেকে পেটে এক ফোঁটাও চা পড়েনি তার আগেই পরোটা আর মিষ্টি ! এভাবেইতো মানুষের স্বভাব চরিত্র খাপ হতে শুরু করে – জাতি তার মৌলিকতা হারায় !
ট্রেন টা উড়িষ্যা রাজ্যের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ একটা ছোট স্টেশন এ দাঁড়িয়ে গেল – সম্ভবত: সিগন্যাল পায়নি, আগে লাইন এ গ্যাংম্যানেরা কাজ করছে ı স্টেশনটার নাম দেখলাম নিরাকারপুর ı

চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা, রেল লাইনের দু’পাশে ধান ক্ষেত পাহাড়ের কোল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সবুজ, বর্ষা শেষ হয়েছে, প্লাটফর্মে নেমে গেলাম যদি একটা চা ওয়ালার দেখা পাওয়া যায় ı এটা একটা ফ্ল্যাগ স্টেশন, প্লাটফর্ম প্রায় রেল লাইনের সাথে মেশানো, কোনো চা এর স্টল নেয়, তবে বাইরে দেখলাম কয়েকটা ছোট ছোট চায়ের দোকান, তারা তো আর জানতো না যে এই গাড়িটা আজ এখানে দাঁড়িয়ে যাবে, ছোট স্টেশনে তো আর বড়ো গাড়ি দাঁড়ায় না ı

দেখি কিছু যাত্রী চা এর দোকানের দিকে এগুচ্ছে – বুঝলাম এদের অবস্থা ও অবস্থা আমার মতো, এক ভদ্রমহিলা জানলা থেকে ডাকলেন,”ওগো শুনছো, এই গ্লাসটা নিয়ে যাও, এতে ভরে নিয়ে এসো” ı যদি ইতিমধ্যে গাড়িটা সিগন্যাল পেয়ে ছেড়ে দেয় – অবশ্য চায়ের দোকান এতো কাছে যে ছুটে এসেও ট্রেনে চাপা যাবে ı এই ভেবে একবার সিগনালের দিকে একবার চা দোকানে কতটা ভিড় হচ্ছে তার দিকে দেখতে দেখতে গুটি গুটি পায়ে এগুলাম – দোকানি কে বললাম, “চা দাও”ı সে বললো, “বানাচ্ছি বাবু – গরম চা, গাড়িটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো” ı

বেশ কিছু যাত্রী, কেও খালি হাতে কেও গ্লাস নিয়ে অপেক্ষা করছে, আমি একা নই – গাড়ি ছেড়ে গেলে এরা সবাই আছে ı একটু ভরসা পেলাম ı চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম – গুটিকয়েক তালপাতার ছাউনী দেওয়া কাঁচা ঘর, দোকান, একটা পান দোকান, সেখানে টেপ চালিয়ে হিন্দি গান বাজাচ্ছে – ‘বস্তি বস্তি পর্বত পর্বত গাতা যায়ে বানজারা লেকর দিলকি এক তারা’ ı

একটা ছোট মেয়ে মাথায় করে মাটির কলসীতে ভরে জল এনে রাখলো চায়ের দোকানের বালতিতে – দোকানি তাকে বললো গ্লাসগুলো ধুয়ে ফেলতে – সম্ভবত: দোকানি মেয়েটার বাবা ı আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম তার নাম – সে বললো ‘মুনিয়া’ ı আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি সারাদিন দোকানে কাজ করো? সে বললো – ‘হ্যাঁ’ ı আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,”তুমি স্কুলে যাও না? পড়াশুনো করো না?” সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল – পায়ের আঙুলে করে মাটি খুঁড়তে লাগলো ı

আমি বললাম আচ্ছা কাজ করো, এই বলে আমি একটু সরে এসে চারিদিকে দেখতে লাগলাম ı কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে মেয়ে – খালি গা, তারা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে ট্রেন থেকে নেমে আসা যাত্রীদের ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো অবাক চোখে – আজ একটা এক্সপ্রেস গাড়ি তাদের ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে গেছে, তার যাত্রীরা সব – রঙিন রঙিন জামা কাপড়, কেও কেও চোখে কালো চশমা পরেছে – এটা যেন তাদের জন্যে এন ইভেন্ট অব দ্য ডে! ইতিমধ্যে চা তৈরি হয়ে গেছে, দোকানির কাছে মাত্র চারটে কাঁচের গ্লাস, একবার চার জনের বেশি লোককে চা দিতে পারছে না, চা খাওয়া হয়ে গেলে সেই গ্লাস ধুয়ে আবার চা দেবে, আমার টার্ন এলো সেকেন্ড ব্যাচে – চা এ চুমুক দিলাম

– আঃ! চা টা সত্যিই ভালো বানিয়েছে – অবশ্য সকাল থেকে এতক্ষন অপেক্ষা করেছি, হয়তো সেজন্যও চা টা বড়ো বেশি ভালো লাগলো ı চা শেষ করে পয়সা মিটিয়ে ধীর পায়ে কামরার দিকে এগুচ্ছি, ইঞ্জিনটা হুইসেল দিয়ে গাড়িটা ছাড়লো, আমিও নিজের কামরাতে উঠলাম ı ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলো হাত নাড়ছে – আমিও হাত নাড়লাম, স্টেশনটার নামটা আবার ও দেখলাম – নিরাকারপুর – একটা ছোট্ট স্টেশন, অজ পাড়া গাঁ – হয়তো আর কখনো আসবো না এখানে – ওই লোকটার হাতের চা আর কখনো খাবো না ı

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত