ডিম ভাজি

ডিম ভাজি

আম্মার মেজাজ ভীষণ খারাপ। মতিন আর শিউলি আপার জন্য আমরা সবাই মার খেলাম। আম্মা গণহারে সবাইকে নারকেল পাতার শলা দিলে মেরেছে। পিন্টু চিৎকার করে কাঁদছে। ও একটু বেশিই কাঁদে। তবে আম্মার মাইরটাও আজ খুব লেগেছে। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকের নারিকেল গাছগুলো যখন ছিলানো হয় তখন আম্মা নারিকেল গাছের পাতা ছাড়িয়ে শলা করে আটি বেঁধে রাখেন। এই আটি থেকে একটা অংশ থাকতো আমাদের মাইরের জন্য। এটা আম্মা ছোট করে আটি বেঁধে রাখতেন। বাড়িতে ভাই বোনদের মধ্যে কোন গন্ডগোল দেখলেই আম্মা তোষকের নিচ থেকে এই শলার আটি বের করে পেটানো শুরু করতেন।

আম্মার মাইর হয়েছে ঘন্টা খানেক হলো। আমরা সব ভাইবোন মনযোগ দিয়ে পড়ছি। শুধু পিন্টু ছাড়া। পিন্টু এখনো ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। মাইরটা ওর গায়ে একটু বেশিই লেগেছে। তাছাড়া পিন্টুর দোষটাও কম ছিলো। এ কারণে তার ব্যাথার চেয়ে অভিমানের কান্নাটাই বেশি মনে হচ্ছে। জানি আম্মারো মন খারাপ। পিন্টুর জন্য। দুই দুইবার আম্মা পিন্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। পিন্টুর কান্না থামেনি। আম্মার আদর পেয়ে পিন্টু আরো অভিমানী হয়ে উঠলো। এবার আম্মা আদর করে বললো, হয়েছে আর কাঁদিস না। আজ আমার ছেলেটার জন্য ডিম ভাজি করবো।

আম্মার কিছু পালা মুরগি আছে। কালো মুরগিটা অনেকদিন যাবৎ ডিম দিয়েছে। তিনদিন হলো ডিম দেওয়া বন্ধ। ডিম পাঁচটা হলে আম্মা মুজিব কাকার দোকানে বিক্রি করে। পাঁচটা দিলে সাড়ে বারো টাকা পাওয়া যেত। আম্মা এই টাকা জমান। জমিয়ে শিউলি আপার কোচিং এর খরচ দেন। কালো মুরগির ডিম দেওয়া বন্ধ বলে আম্মার একটু মন খারাপ। শিউলি আপারও। যদিও আম্মা বললো, সামনের সপ্তায় সাদা মুরগিটা ঠিকই ডিম দেওয়া শুরু করবে।
আব্বার জন্য তিনটা ডিম তোলা ছিলো। আব্বা চিনি কলে চাকরি করেন। দিন পনের পর পর একবার আসেন। ছোট চাকরি। আব্বা বাড়িতে আসলে ভালো কোন তরকারি না থাকলে আম্মা ডিমের কোরমা করেন। তিনটা ডিম সিদ্ধ করে টুকরো করলে ছয় পিস হতো। আমরা পরিবারের ছয়জন। এ কারণে আম্মা সব সময় তিনটা ডিম জমিয়ে রাখতেন।

ডিম ভাজি হবে। একটা ডিম। আব্বার জন্য জমিয়ে রাখা সেই ডিম থেকে। অনেক পেয়াজ মরিচ মাখিয়ে ডিম ভাজি। আমরা বলতাম আম্মা জাদু দিয়ে ছোট্ট একটা ডিম বিশাল করে ফেলবেন। ডিম ভাজির ঘ্রান পেয়ে পিন্টুর কান্না থেমে যেত। আমারো খুব ক্ষুধা লাগতো। ডিম ভাজি শেষ হতেই আম্মা সবাইকে খেতে ডাকতেন। একটা ডিম ভাজি চার ভাই বোনের জন্য আম্মা চার পিস করেন । ডিম ভাগ করতে করতে আম্মা পিন্টুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। আমরাও হাসছি। পিন্টু ডিমের দিকে তাকিয়ে আছে। ডিম ফুলে কেকের মত হয়েছে। আমরা সাদা ভাত দিয়ে গরম গরম ডিম খাচ্ছি। শিউলি আপা সাথে ডাল নিয়েছেন। মসুর ডাল। আম্মা ডালটা কি করেন বুঝিনা। ভীষণ স্বাদ লাগে। এক ডাল দিয়েই শিউলি আপা সব ভাত শেষ। আপা তার ডিমের অংশ পুরোটা ভাত দিয়ে খায় না। একটু রেখে দেয়। ভাত শেষ করে আপা আস্তে আস্তে ডিমের বাকি অংশটুকু খান। আপার দেখাদেখি আমিও একই কাজ করি। মকবুল মামার বিয়েতে কত কত মাংস আর পোলাও খেয়েছি কিন্তু আম্মার এই ডিম ভাজির কাছে সেটা কোন স্বাদই নেই।

মাত্র একটা ডিম চারজনকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে্ছি অথচ আমাদের কেউ কম খাচ্ছি বলে মনে হচ্ছেনা। মাঝে মাঝে আম্মা অনেক কিছুই রাধেন। আব্বা মাস শেষে বেতন পেয়ে এটা ওটা নিয়ে আসেন। কিন্তু আমাদের সব ভাইবোনের যেন ঐ ডিম ভাজির চেয়ে স্বাদের কিছু নেই।

হ্যাঁ, এখন সবাই কত বড় হয়ে গেছি। স্বচ্ছল হয়েছি। কত রং বেরং খাওয়া দাওয়া করি। একসাথে ডাবল ডিম পোচও খাই কিন্তু আম্মার ঐ ডিম ভাজি? উফ এই একটা জিনিসের স্বাদ শুধু খুঁজে ফিরি। সেদিন শিউলি আপা সেই সাউথ আফ্রিকা থেকে ফোন দিয়ে বললো, মঞ্জু আমার না আম্মার হাতের ডিম ভাজি খেতে ইচ্ছে করছে। কেকের মত ফুলে উঠা ডিম ভাজি। কথাটা বলেই শিউলি আপা ফুফিয়ে কাঁদছে। আমারো কান্না পাচ্ছে। হয়তো আরো অনেকবার কাঁদবো। মায়ের হাতের জাদুতে ছোট্ট একটা ডিম ভাজি অনন্তকাল আমাদের কাছে অমৃত হয়ে থাকবে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত