বিয়ের সদাই

বিয়ের সদাই

একটা থাপ্পড় দিয়া দাঁত ফালায় দিবো! দোকানে থাকা প্রত্যেকটা চোখ আমার দিকে ঘুরে গেলো। চিৎকারটা জোরে হয়ে গেছে কিন্তু আমি এখন সত্যি সত্যি বিরক্ত।

আমরা এসেছি বিয়ের শপিং করতে। মাত্র যে হুঙ্কারটা দিলাম? এটা দিয়েছি আমার হবু স্বামীকে। বিগত ৪৫ মিনিট ধরে এই দোকান ওই দোকান ঘুরছি তার স্যুটের কাপড় কিনতে, প্রত্যেকটা দোকানে ঢুকে তার একটাই কথা, “আপনি পছন্দ করেন!” প্রথম কথা আমার নিজেরটা আমি মেয়ে মানুষ হয়ে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে পছন্দ করেছি, তারটা কেন আমি করব? দ্বিতীয় কথা এই রামছাগলটার সাথে আমার সাড়ে ছয় বছরের প্রেম। বিয়ের কথা উঠার পর থেকে গাধাটা আমাকে আপনি করে ডাকছে! কার মেজাজ ঠিক থাকে?

: শোনো নোমান? হয় তুমি এই মুহূর্তে কোঅপারেট করা শুরু করবে, না হয় আমি তোমার জন্য কটকটা হলুদ রঙের শেরওয়ানী কিনবো, আর গলায় থাকবে কোরবানীর গরুর গলায় দেয় যে? সেই কাগজের মালা। লাল রঙের মালা গলায় দিয়ে তুমি আসবে! ভালো হবে না??
:আপনি যেটা ভালো মনে করেন।

এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। উঠে সোজা হাঁটা ধরলাম। রামছাগলটা উঠে আমার পেছন পেছন আসছে। কোন কথা না বললেও আমি পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এটা আমার পরিচিত পায়ের শব্দ। ক্যাফে মল্লিকাতে ঢুকে একটা লাচিছ অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি। নোমান ঢুকে আমার সামনে এসে বসলো। আমার মাথায় রাজ্যের চিন্তা। ও তো এমন ছিল না, কাল আমাদের বিয়ে এখন কেন এমন করছে! বিয়েটা ওর ইচ্ছেতেই হচ্ছে আমি তো জোর করি নি।

:নোমান তোমার কি হয়েছে বলো তো? তুমি কি বিয়েটা করতে চাচ্ছো না?
:আপনি লাচিছ খান, এই যে নিয়ে এসেছে!
:তুমি ঠিক কি কারণে আমাকে আপনি বলছো? কেন এমন করছো?
:জানি না! আপনি খান, আমি যাই!

উত্তর দেবার আগেই ছেলেটা পালিয়ে বাচলো। আমি বিব্রত আর বিরক্ত। ও তো এমন ছিলো না! গতকাল আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা উঠলো, আগামীকাল আমাদের বিয়ে। ওর বিদেশে খুব ভালো একটা জব হয়েছে। ও নিজেই বললো যদি দুইদিনের মধ্যে বিয়েটা হয়ে যায় তোমাকে সহ ভিসা আবেদন করতে পারবো। আমি নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেছি, আমাদের স্বপ্ন অবশেষে সত্যি হতে যাচ্ছে। কিন্তু ওর এমন আজব পরিবর্তন আমি মানতে পারছি না।

এতগুলো বছর তো এই মানুষটা এমন ছিল না, ও কি আমাকে বিয়ে করতে চায় না? শেষ মুহূর্তে দোটানায় আছে? আমি বাসায় বলে ফেলেছি, গাই গুই করলেও সবাই জানতো আমাদের ব্যাপারটা তাই খুব একটা ঝামেলা করে নি। বড় আপা রওনা দিয়ে ফেলেছে শশুর বাড়ি থেকে, ছোটোভাইটা অফিস থেকে জরুরী ছুটি নিয়ে আয়োজনে লেগে গেছে। এখন এই বিয়ে বাতিল হলে আমাকে ত্যাজ্য করবে মাস্ট! ভাবতে ভাবতে আমার দুই গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আমি এখন কি করবো? সামনে তাকিয়ে দেখি নোমান হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে আসছে। সামনে বসে প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

:স্যুটের কাপড় কিনলে তো সেলাই করার সময় হবে না তাই রেডিমেট কিনতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু আপনি যে রেগে আছেন তাই কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলাম না, এটা ভালো হইসে?? (ভয়ে ভয়ে বললো ও)

চোখ মুছে দেখি নেভি ব্লু একটা স্যুট ভেতরে। আর সাথে ম্যাচ করা একটা প্যান্ট।
: বাকি জিনিস? ভিতরে পরার শার্ট? তারপর জুতা? (গাল ফুলিয়ে অভিযোগ করলাম)
:আমার সাদা অফিস পরার একটা শার্ট আছে না কালো বোতাম? ওইটা পরি আর ব্রাউন বুট আছে আমার ওইটা।
:পুরোনো কাপড় পরে বিয়ে করবে? আব্বু টাকা দিয়েছে তো।
:না আর টাকা নষ্ট কইরেন না। একটু উপরে বসি চলেন? এ এন্ড ডব্লিউ তে??
:চলো (আমি এতক্ষণে মেনে নিয়েছি আমাকে ও আপনি করেই বলবে!)

এটা আমাদের এতদিনের ডেটিং স্পট। নোমান বলতো “তোমার পেটে এ এন্ড ডব্লিউর একটা মিনি শাখা হয়ে গেছে এতদিনে”। আমরা আমাদের সেই পরিচিত দুটো সোফায় বসলাম। আগের মত একটা রুট বিয়ার অর্ডার করলাম, নোমান কিছু একটা বলার জন্য উশখুশ করছে দেখে নিজেই জিজ্ঞেস করলাম,

:কিছু বলবে?
:না।
:সত্যি?
:আমার ভয় লাগছে!
:কি ভয় নোমান? আমাকে বলো? এই যে আমি!?
:না আপনাকে বলতেও ভয় লাগছে।

আমি উঠে হেঁটে হেঁটে আগের মত নোমানের পাশে এসে বসলাম, ওর ডান হাতটা আমার দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম,

: এই যে আমি? কি হয়েছে আমাকে বলো, তোমাকে এমন দেখতে আমারো ভয় লাগছে, চলো আমরা আলোচনা করি হু?

:আমি যদি খারাপ স্বামী হয়ে যাই?? আমি যদি ফেল করি?? আম্মু মাঝে মাঝে আব্বুর উপর রাগ করে কাঁদে। আমি যদি তোমাকে কাঁদাই? আমি যদি তোমার সব শখ পূরণ করতে না পারি?? আমার যদি কখনো তোমাকে চড় মারতে মন চায়?? তুমি তো অনেক রাগী, তুমি তো আর আমার সাথে থাকবে না তাহলে! তুমি চলে গেলে সবাই আমাকে ছি ছি করবে, আম্মু রাগ করবে। আম্মু তোমাকে যেই আদর করে, দেখা যাবে আম্মুও তোমার সাথে চলে যাবে! আমি তখন কার সাথে থাকবো!? (কথা গুলি বলতে বলতে নোমান ছোটো বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগলো, খালি বার বার একটা কথাই বলছে এখন “আমাকে রেখে যেও না হ্যাঁ”)

আজকে আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। প্রথম এক সপ্তাহ আমাকে আপনি করে ডেকে নোমান আবার তার আগের রূপে ফিরে এসেছে। আগে নিয়ম করে জিজ্ঞেস করত ভালো আছো? খেতে পারো আমাদের বাড়ির তরকারি? মন ভালো? ঘুম হয়? এখন আবার আগের রূপে ফিরে গিয়ে মাঝে মধ্যেই বলে উঠে ” বুঝলা কল্পনা, তোমাকে দেখতে মাঝে মাঝে সঞ্জয় দত্তের মত লাগে!”

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত