কুঁচিমারা

কুঁচিমারা

জীবনের বাসনা পূর্ণ হল গেল বছর। এবার তার বর্ষপূর্তি। সন্ধায় কয়েকজন বন্ধু আসবে। আজ প্রথম শাড়ী পড়বে রফিকের বৌ।

এই এক বছরে তিন জনের কোন লক্ষণ ধরা পরেনি। বছর না ঘুরতেই একটা নিয়ে নিবে। শেষ বয়সে কপালে বিয়ে জোটার আগেই রফিক এমন সিন্ধান্ত নিয়ে ছিল। বাঁধসাধে তার রূপবতী বৌ। তার পেটের চামড়া ঢিলা হয়ে যাবে। চাপা মরে যাবে। কাপালে ভাঁজ পরবে। উরু ফেটে যাবে। শাড়ী পড়লে বয়স বেশি লাগে। বছর না ঘুরতেই উমুকের মা সুমুকের মা এমন ডাক আমি শুনতে পারব না। রফিক শান্ত ভাবে বুঝায়। সবাইতো সংসারে একটা বাচ্চা চায়। বাড়িটা খালি খালি লাগে। নাওটা একটা। কোন লাভ হয় না। পাঁচ বছরের জন্য তালা। বৌয়ের এমন কথায় তার কছেও ঘেঁসতে পারে না রফিক। রফিকের আশায় গুঁড়েবালি।

স্ত্রীকে বুঝিয়ে বাগে আনলেও একবার বাপের বাড়ি গেলে সব ভুলে যায়। সব কথা বিপরীত করে তবে বাপের বাড়ি থেকে ফিরে। তুমি না গত সপ্তাহে বললে। আজ আবার না বলছ কেন? রফিকের কথার কোন জবাব না পেয়ে রফিক অবাক হয় না। এমন অনেক বার হয়েছে। দুজনই চুপচাপ থাকে। কি আর করা, যে সেই। তালা আর খোলে না। হাতে ধরে চুমু খেয়ে দুপুরে রাত্রে সব সময় রফিকের হাজার কথা। বৌয়ের এক কথা। তালা।

জুয়েলারীতে অর্ডার দিয়ে এসেছি। তোমার নাম্বারটাও দিয়েছি। ওরাকি ফোন করেছিল ? না করেনি। বৌয়ের কথায় উত্তর দেয় রফিক। ভেজা তোয়ালেটা হাত থেকে রেখে হারবাল বিউটি কুইন আনতে বলে রফিককে। বয়ামের অভাব নেই। এটায় শঙ্খচুড়াতো ওটায় মুলতানী। ওটায় বাদলা ঘি মাখন শশা পেপে টমেটো পেষ্টের অভাব নেই। তাকে থরে থরে সাজানো। রূপচর্চার উপকরণের সাথে আছে একটি ব্যায়াম চর্চার বই। মাঝে মাঝে রফিকের পার্লার পার্লার লাগে। সন্ধায় কয়েক জন বন্ধুকে আসতে বলেছে। বৌ রান্না করে খাওয়াবে। রফিকের এতদিনের জবান দেওয়া। কলিগদের একবছরের আশা পূর্ণ হবে। অফিসের সবাই জোকের মতো লেগে ছিল একটি বছর। যদিও ফাইভ ষ্টার হোটেলে বহু বার খাইয়েছে। তবু ভাবীর হাতের রান্না।

তোমার অফিসের ব্যস্ততা কি কোন দিন শেষ হবে না। আরে মানুষতো দু’একদিন বাড়িতে ঘুমায়ও নাকি। রফিরে বৌ প্রায় এসব বলে। কিন্তু তাতে কি। অফিস মানেই টাকা। উপর থেকে একটি ফাইল নিচে রাখলেই টাকা। বস অফিসে নাই বললেই টাকা। এখনতো হবে না রেখে যান। পড়ে বসকে দিয়ে করিয়ে দিব তাতেও টাকা। তাই রফিক উত্তর দেয়। অফিসের সবাইকে গিয়ে ঘুমাতে বলো। আমি একাই অফিস করব। একদিন না গেলে টেবিলের নিচের রাস্তায় যদি কেউ হাত বাড়ায়। এই কয়মাস ছুটি নেয়নি। অফিসে খুব ব্যস্ত ছিল।

আজকের দিনটায় অফিস করে লাঞ্চ আওয়ারে চলে আসবে। ফুলটুল হাবিজাবি কেনাকাটা করে সন্ধার আগে বাসায় ফিরে সব ঠিকঠাক করে ফেলবে। সব বন্ধুরা আসার আগেই। রফিকের সাথে আসবে কলিগরা। এমন প্লান ছিল। কিন্তু সময় মতো সব ঠিকঠাক হবেতো। বৌয়ের যা খুঁতখুঁতে স্বভাব। এটা ভালো না তো ঐটা পাল্টাও। এটা রং ভালো হয়নি ফিরিয়ে দাও। এটা তো একটায় হবে না, তিনটা লাগবে। আরো কত কি। রফিকের এখন মুখস্ত। তখন মাত্র নতুন বিয়ে করেছে। বৌয়ের বান্ধবীর বাড়িতে যাবে। তারা দাওয়াত করেছে। পুরাতন মোবাইল সেট নিয়ে কি যাওয়া যায়। দুজনের মোবাইল পাল্টাতে হয়েছে সাতদিন ধরে। আজ এই মডেল পছন্দ করে কিনেছে তো কাল আসে নতুন মডেল। আরো সুন্দর। ঐটা ফেরত দিয়ে আনে পরের দিনেরটা। এমন করতে করতে এক মোবাইলের দাম ক্ষতিপূরণ দিয়েছে রফিক। মোবাইল মোবাইল করেই দাওয়াদের তারিখ মিছ হয়েছে গত সপ্তাহে। ওদিক থেকে রিং আর রিং।

বান্ধবীরা সবাই আমাকে লজ্জা দিচ্ছে। এমন কুঞ্চুস লোকের ঘর করছিস হানিমুনের পয়সা জোটে না। না থাকে তো নিয়ে যাস। তবু হানিমুন তো হবে। এমন কথা আর কত শোনাবে তুমি শুনি। অফিস থেকে আসা মাত্র আঙ্গুল খাড়া করে বয়ান শুরু করে রফিকের স্ত্রী। আরে আমি কি না বলেছি। যাবতো একটু ঝামেলাটা কমলেই যাব। আর কয়েকটা দিন। রফিকের বিনয়ী কথায় মন গলে না। তোমার ঐ কয়েকটা দিন একবছরেও শেষ হয়নি। অফিস অফিস আর ঝামেলা। তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন শুনি। তুমি তোমার অফিসের ঝামেলা নিয়েই থাক আমি চললাম। সেদিন রফিকের অফিসের পর শুরু হয় ওভারটাইম। বায়না মিটিয়ে বৌ আনতে হয় শশুর বাড়ি থেকে।

সাতদিনের ছুটি নিয়ে যাবে হানিমুনে। হউক না বাসি তবুতো মান রক্ষা হবে। তিনদিন হানিমুন আসা যাওয়া দুইদিন। প্লান প্রোগ্রাম করে দেয়ালের ক্যালেন্ডারে লাল কালি মেরে দাগ কেটে রেখেছে। একমাস আগে। বিয়ের সময় শশুর বাড়ির দাওয়াত, অফিসের ঝামেলা হানিমুন আর হয়ে উঠেনি। এবার সে বোঝা নামানোর পালা। রফিক মনে মনে ভাবে এবার হয়তো তালা খুলবে। বৌয়ের সব বায়না একে একে পূরণ করছে সে আশায়। যখন যা চায় তাই সই। জি হুজুর জি হুজুর।

মাঝে মাঝে রফিক বাচ্চাদের খেলনা কিনে আনে। বাচ্চার জন্য যদি বৌয়ের মনটা একটু গলে। গত কালও একটি খেলনা কিনে আনে। এই দেখ কি এনেছি- কি এনেছ। লিষ্টের উপরে চোখ রেখে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে জিজ্ঞেস করে বৌ। বাচ্চাদের খেলনা। আস্তে করে উত্তর দেয় রফিক। তুমি কি এখনো বচ্চাই রয়ে গেলে। এমন জবাব শুনে রফিক চুপ করে থাকে। বিবাহ বার্ষিকীর বাজেট করা শেষ। এবার ঘার ঘুরিয়ে দেখে পুতুল। এটা একটা পুতুল হল। কোথা থেকে এনেছ। স্বভাবটা একটু পাল্টাও বুঝলে। ষ্টান্ডার্ড হও। দুদিন পর হবে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। আর তুমি কিনে আনো পুতুল। ছেলে মানুষি !

রফিকের পকেটে থাকে দুইটা লিষ্ট। একটা সুন্দরী বৌয়ের কেনা কাটার। আরেকটা টেবিলের নীচের। লাখ টাকা উপরি নিয়ে যখন গুরুত্ব পূর্ণ আলাপ চলে অফিসে। তখন রিং বেজে উঠলে না ধরলে আর রক্ষা নেই। ঘারে মোবাইল চেপে কাত হয়ে জি হুজুর জি হুজুর করতে করতে টাইপ করে লম্বা লম্বা ফর্দ। এবার লিষ্টের সব শেষে রফিক আরো একটি নাম লেখে। শাড়ী। বিয়ের পর শাড়ী পড়তে দেখেনি। খুব শখ অন্তত একটা দিন বৌকে শাড়ী পড়িয়ে দেখবে।

বিবাহ বার্ষিকীর কেনাকাটা করতে গিয়ে প্যাকেট ভরে। চিকনি চামেলী বাতাবী লেবু উরাধুরা নামি সব কাপড় দিয়ে। রুবি পান্না জারকানে পাথরের কারুকাজ করা গহনা গুলো সে আগেই কিনে নিয়েছে। এখন শুধু মাত্র কুন্দনের একটি সেট তার বাকী আছে। জুয়েলারীতে জানিয়ে দিয়ে এসেছে। আসলে তারা ফোন করবে। তখন নিয়ে আসবে। রূপ চর্চার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত শবাশন পদ্ধাশন ব্যায়াম তার নিত্য দিনের রুটিন। শরীরটাও শ্লীম। এগুলিতে মানায়ও ভালো। কিন্তু রফিকের বয়স একটু বেশী। শাড়ী পড়াতে খুব শখ, বাঙ্গালী। তাই লিষ্টের শেষে শাড়ী যোগ দিয়েছে। রফিক একবার শাড়ীর কথা বললে বৌ বলে আমি শাড়ীর কথাতো বলিনি। আহা তুমি বলনি তাতে কি আমি লিখেছি। নাওনা একটা শাড়ী। তোমাকে ভালো মানাবে। রফিকের কথা শেষ না হতেই – রাখো তোমার ভালো। শাড়ী পড়ে কি বুড়ি হব নাকি। বেচারা থতমত খেয়ে দুহাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে পিছু পিছু হাটে।

অন্য মার্কেটে গিয়ে কেনা কাটার সময় রফিকের ঘ্যনরঘ্যনর প্যাচালে যদিও বা শাড়ী দেখতে রাজি হয়। মথুরা সিক্ল, স্বর্ণ চুরী, ছত্রিশ গড়ের ঘিচা সিল্কের উপর ডিজাইন করা শাড়ী, তাতের শাড়ী, জামদানী, ইজিপসিয়ান, কটন, সিক্ল, ইকো সিক্ল, কুচিপুরী সিক্ল, লেটেষ্ট কালেকশান স্মার্ট ট্রেডিশনাল শাড়ী গুলো দেখে দেখে যখন দূর্বল অবস্থা। তখন নিয়েছে নেটের উপরে লেঙ্গাচলী টাইপের জরির পাড়ের উপর কাজ করা কুঁচিমারা একটি শাড়ী। খুব পাতলা, ব্লাউজ পিচ সহ পুরো শাড়ীটা হাতের মুঠোয় নেয়া যায়। পড়ার সময় এই শাড়ীতে আলাদা কুঁচি দেওয়ার দারকার পড়ে না। শাড়ী পড়তে না পারাদের জন্য কুঁচি দেওয়ায় দারুণ সুবিধা। তাই এই সহজ মার্কা শাড়ীটা নিয়েছিল রফিকের অনুরোধে। আজ বিবাহ বার্ষিকীতে শাড়ীটা পড়বে। সত্যি দারুণ লাগবে। আকাশের পরীর মতো অপূর্ব সুন্দরী মনে হবে। একবার তাকালে চোখ ফেরানো যাবে না। আজ তার এত দিনের ইচ্ছা পূরণ হওয়ার দিন। এখন বৌয়ের সাথে জাকজমক পূর্ণ বিবাহ বার্ষিকী পালন করার সময়। একদিন পরেই দুজন যাবে লং ড্রাইভে। দিন রাত চলবে গাড়ী। রফিকের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বে মারিয়া। শাড়ীর আঁচল ছড়িয়ে পড়বে রফিকের হাটু পর্যন্ত। ডান হাতে ষ্ট্রিয়ারিং ধরে। বাম হাতে মারিয়ার মাথায় হাত বুলাবে। রফিকের চোখের সামনে থেকে বারবার সরিয়ে দিবে মারিয়ার মাথার উড়ন্ত চুলগুলো। অন্ধকার ঘরে মাথা নিচু করে। ভাবনার লিষ্টে মনের চোখ রাখে রফিক।

বিউটি পার্লার থেকে শাড়ী পড়ে সেজে আসে রফিকের বৌ। কযেক জন কাছের বন্ধুরা উপস্থিত। অফিস কলিগরা রফিকের সাথেই আসবে। তারা তো একসাথেই আসবে। এতক্ষণ তো আসার কথা। কিন্তু আসছে না কেন। বার বার ট্রাই করেও মোবাইলে সংযোগ পাচ্ছে না মারিয়া। হয়তো মোবাইলে চার্জ নেই। অফিসের নাম্বারে ফোন দেওয়ার আগ মুহূর্তে তার মোবাইলেই রিং বেজে উঠে। হ্যালো – হ্যালো – আপনি মারিয়া – জি বলছি আপনি – এফ বি আইএর সদশ্য। ঢাকা অফিস থেকে বলছি – কি ব্যাপার – আপনার স্বামীকে এক কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত