তার সাথে দেখা হয় যদি

তার সাথে দেখা হয় যদি

অনেক রাত।

পাড়ার লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশের ঘরে বৌ বাচ্চাও। ড্রইং রুমে একটা জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে। আর এই পড়ার ঘরে ল্যাপটপটায় ইউটিউবে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলছে খুব কম ভলিউমে। ল্যাপটপের পর্দায় আলোর নাচানাচি আর টেবিলের ওপর রাখা ঘুমের ওষুধগুলোর ওপর সেই আলোর প্রতিফলন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে।

ল্যাপটপে যে জিনিসটা টাইপ করা হচ্ছে সেটাকে সুইসাইড নোট বলা যেতে পারে। আত্মহত্যার ইচ্ছা অর্কর জীবনে এই প্রথম নয়। অনেক বছর আগে একবার হয়েছিল। যে পরিস্থিতিতে অর্ক অনেকগুলো ঘুমের ট্যাবলেট আর একটা দড়ি (অর্কর নিজের ভাষায় ‘প্ল্যান বি’) জোগাড় করেছিল সেটা সত্যিই একটা দুরূহ পরিস্থিতি ছিল। আশি শতাংশ লোক ও পরিস্থিতিতে পড়লে সত্যিই আত্মহত্যা করে বসে। কিন্তু অর্ক যেদিন রাতে আত্মহত্যা করবে ভেবেছিল ঠিক সেদিন দুপুরে এমন কিছু একটা ঘটে যাকে মিরাকল বলা চলে। আত্মহত্যাটা যে শুধু করতে হয়নি তা নয়, জীবনদর্শন পুরো পালটে গিয়েছিল।

এমনিতে অর্ক মিরাকল, জ্যোতিষ, ভূত, ভগবান এসবের কোনটাতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনটাই করে না। তথাকথিত একটা মিরাকল নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও না। কিন্তু এটা সত্যি যে ওর জীবনে কাকতালীয় আর সমাপতনের সংখ্যা খুব বেশি। যেমন, সেই মিরাকলটার পর থেকে এত বছরে ওর সঙ্গে অন্তত দুজনের দেখা হয়েছে যারা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল। অর্ক কি করে যেন এই মানুষদের দেখলেই বুঝে যায় তাদের ভেতরে একটা ঝড় চলছে। এই দুজনকেই অর্ক সেই মিরাকলটার গল্প বলেছে। এবং গল্পটা শোনার পর আশ্চর্যজনকভাবে দুজনের মধ্যেই একধরণের পরিবর্তন ঘটেছে যেটা ভালর দিকেই।

সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, অর্ক একজন মাঝবয়েসী মধ্যবিত্ত বাঙালী যার জীবনে একবার অবসাদ আর হতাশা এসেছিল যেটা কাটিয়ে উঠে এখন সে একজন আপাদমস্তক আশাবাদী মানুষ যার মনের জোর আর পাঁচটা লোকের তুলনায় অনেক বেশি।

বরং, এত বছর পর এই যে দ্বিতীয়বার এতগুলো ঘুমের ওষুধের পাতা সামনে নিয়ে বসে ঝিমোতে ঝিমুতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছে তার কারণটা সেবারের কারণটার তুলনায় তুচ্ছাতিতুচ্ছ। হ্যাঁ, চাকরিখানা কয়েক মাস আগে চলে গেছে বটে, কিন্তু অর্কর ঘটনাবহুল অতীতে মোকাবেলা করা ঝড়ঝাপটাগুলোর কাছে সামান্য একটা চাকরি যাওয়া নস্যি। বরং কারণটা শুনলে কেউ কেউ বালখিল্য বা হাস্যকরও বলবে।

সামান্য মদ্যপানের ফলে মনটা বেশ ফুরফুরে আছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে নেই হয়ে যাবে ভেবে তেমন দুঃখটুঃখ হচ্ছে না। তবে চিঠিটা লিখতে হবে। কাকে যেন লিখবে? হ্যাঁ শ্রীপর্ণাকে।

কিন্তু কেন লিখবে? মনে পড়েছে। আজ সকালে নামকরা খবরের কাগজে অর্কর লেখা প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বইটার নাম বেরিয়েছে। তাও যেমনতেমন করে নয়। অর্কর বইটা বেস্টসেলার হয়েছে। প্রকাশক খবরের কাগজের সেই পাতার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে লেখককে ট্যাগ করেছেন। খুশি তো বটেই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছিল খবরের কাগজ দেখে। এরকম একজন অখ্যাত লেখকের বই বেস্টসেলার হবার কথা নয়। কিন্তু অর্ক বিখ্যাত না হলেও জনপ্রিয় এবং একটা বিশাল নেটওয়ার্ক বজায় রেখে চলে। নিশ্চয় পরিচিত আর বন্ধুবান্ধবরাকিনে কিনে বইটাকে বেস্টসেলার বানিয়ে দিয়েছে। বন্ধুদের প্রতি তাই গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করে অর্ক।

তারপর যেন কী হল? সকালে চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীপর্ণাকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে খবরটা পাঠিয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপে তো অনেকদিন ধরেই ব্লক হয়ে আছে। বহুদিন কথা না হবার পর আজকাল মেসেঞ্জারে একটা দুটো কথা হয়। অর্কর তরফ থেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা ছাপিয়ে বেরিয়ে আসা আবেগ, শ্রীপর্ণার দিক থেকে উপেক্ষাসূচক হুঁ হা। দুপুরের দিকে দেখল মেসেজটা শ্রীপর্ণা দেখতে পেয়েছে কারণ মেসেজটার নিচে ডানদিকে ‘টিক’ চিহ্ন পড়েছে। একটু অভিমান হয়েছিল। লিখল ‘ভদ্রতা করেও একবার অভিনন্দন জানাতে পারতিস’ উত্তরে, অনেকক্ষণ পর শ্রীপর্ণা লেখে ‘অ আচ্ছা। অভিনন্দন।’ অর্কর অভিমান বেড়ে যায়।লেখে ‘তোর জন্যই বই লিখলাম, তোর কাছ থেকে ঠিক এরকম প্রতিক্রিয়া আশা করিনি।’ উত্তরে শ্রীপর্ণা বলে, উৎসর্গপত্র সহ গোটা বইয়ের কোথাও তার নাম নেই, কী করে বুঝবে ওর জন্যই লেখা? আরো সন্দেহ প্রকাশ করে, অর্ক নিশ্চয় আরো দশজন মেয়েকে একই কথা বলেছে। কিন্তু শ্রীপর্ণা সেই দশজনের মত বোকা নয়।

অর্কর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে! একি বলছে শ্রীপর্ণা? অর্ক যখন সবে লেখালিখি শুরু করেছিল তখন শ্রীপর্ণাই প্রথম বলেছিল, ‘দেখিস তোর বই একদিন ছাপা হবে।’ অর্ক বলেছিল ‘লিখলে তোর জন্যই লিখব, কিন্তু তোর নাম কোথাও লিখলে তো নানা জায়গায় ক্যাচাল শুরু হবে।’ শ্রীপর্ণা বলেছিল ‘নাম লেখার দরকার কী? লেখার সময় সত্যি করে আমার কথা ভাবলেই আমি ঠিক বুঝতে পারব।’ অর্ক যে বিশাল কিছু লেখালিখি করে তা নয়। বছর পাঁচেক আগেও সে কিছু লেখার কথা ভাবেনি। আরো অনেকের মত ফেসবুকে লিখতে লিখতে একদিন বই লেখার প্রস্তাব আসে, আর লিখেও ফেলে। অর্কর বয়েস চল্লিশের ওপর হলেও কিছুকিছু ক্ষেত্রে তার ভাবনার গতিপ্রকৃতি শিশুসুলভ। সে প্রত্যেকটা শব্দ লিখতে গিয়ে শ্রীপর্ণার কথা ভেবেছে এবং বইটা সত্যি সত্যিই প্রকাশিত হবার পর শ্রীপর্ণাকে ডাকযোগে পাঠিয়েছে। যদিও তার অনেক আগেই শ্রীপর্ণার সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

তাই আজ নিজের শিশুসুলভ ভাবাবেগের ওপর ধিক্কার আসা। আর তাই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা।
গল্পটা এই পর্যন্ত চলার পর যে কারো প্রথম প্রশ্ন সম্ভবত হবে, শ্রীপর্ণা কে? বরং বলা ভাল, অর্কর সঙ্গে তার কি সম্পর্ক।

উত্তর বলা খুব মুশকিল। এই দুটি চরিত্রের দেখা হয়েছিল মাত্র একবার। আর কথা যেটুকু হয়েছে সব যোগ করলেও সম্ভবত চব্বিশ ঘন্টার বেশি হবে না।

এইপর্যন্ত শোনার পর পুরুষ চরিত্রটির সম্পর্কে যে কথাটা মনে হবে সেটা হল ‘ন্যাকা’ বা ‘অপরিণতমনস্ক’। কিন্তু কার কী মনে হল তাতে অর্কর কী আসে যায়? ও তো গল্পের শ্রোতা নয়, গল্পের চরিত্র।

শ্রীপর্ণা কি অর্কর প্রেমিকা? বলা মুশকিল। শ্রীপর্ণা নিজেই বলেছিল সে অন্য একজনের প্রেমিকা। সেই মানুষটি অসম্ভব গুণী। অর্ক তাঁকে সামান্য হিংসে আর অসম্ভব শ্রদ্ধা করত। শ্রদ্ধা করার কারণ, শ্রীপর্ণা সেই মানুষটির কাছে ভাল থাকে। হিংসে করার কারণ, সেই মানুষটির জন্য শ্রীপর্ণার সময়ের সিংহভাগ বরাদ্দ। অর্ক এমনিতে অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। কিন্তু যাঁহাতক ‘প্রেম’ নামক অসংজ্ঞাত অনুভূতিটির প্রশ্ন, সে এব্যাপারে একজন যন্ত্রমানব। তদুপরি অর্কর সমস্যা হচ্ছে সে সবাইকে ভালবাসে। যাদের ভালবাসত এবং বাসে, তার মধ্যে শ্রীপর্ণা একজন। শুধু, প্রথম আলাপে অর্ক বলেছিল ‘আপনাকে দেখে কী যেন মনে পড়ছে, কিন্তু কী মনে পড়ছে সেটাই মনে পড়ছে না।’। আর তারা পরস্পরকে দুটো ডাকনামে ডাকত। এই সম্পর্কটাকে কী বলে কে জানে! শ্রীপর্ণা তাকে দূরে সরিয়ে দেবার পর থেকে সে মাঝে মাঝেই পুরনো হিন্দি সিনেমার একটা গান খুব শোনে, ‘হোকে মজবুর মুঝে উসনে ভুলায়া হোগা।’…নিশ্চয় শ্রীপর্ণার পক্ষে কোন কারণে ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছিল না, তাই বাধ্য হয়েই…

যোগাযোগটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার পর অর্ক অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল। চাকরিটা যাবে যাবে করছিলই। অধিকন্তু যেটা হল, প্রাণপণ খেটে চাকরিটা বাঁচানোর চেষ্টা ব্যর্থ হল। এলোমেলো হয়ে যাওয়া মাথাটা ততটা কাজ করছিল না যতটা করলে চাকরিটা চালু রাখা যায়। অর্ক অবশ্য এর পেছনে বিচ্ছেদটাকে দায়ী করে থাকে, শ্রীপর্ণাকে নয়। আর বিচ্ছেদটার জন্য দায়ী ও নিজেই। প্রায় চলে যেতে বসা চাকরিটা ওকে প্রবল মানসিক চাপে ফেলেছিল। যতই আশাবাদী মানুষ হোক, একটা চাকরি চলে যাবার অভিঘাত একজন মধ্যবিত্তের মনোজগৎকে তছনছ করে দেয়। অর্ক সেইসময়টা অসম্ভব অসহিষ্ঞু করে তুলেছিল। আর ঠিক সেই সময় শ্রীপর্ণার একটা আপাততুচ্ছ মন্তব্যের উত্তরে অভিমানবশত একটু বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। শ্রীপর্ণা আর কথা না বাড়িয়ে সেদিনই সম্পর্কটা ছিন্ন করে। অনেক অনুতাপ আর ক্ষমাপ্রার্থনায় সেই চিড় আর জোড়া লাগেনি।

কিন্তু আজকের কথোপকথন তার ভাবনা পালটে দিয়েছে। এতদিন ভেবে এসেছিল, শ্রীপর্ণা তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ভালবাসাটা (নাকি বন্ধুত্ব) কোথাও লুকিয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু অবিশ্বাস! নেওয়া যাচ্ছে না। অর্ক নিজেকে শেষ করে দিয়ে প্রমাণ করে যাবে, বইটা লেখার সময় ও সত্যিই শ্রীপর্ণার কথা ভেবেছিল। আর শেষ পর্যন্ত সারা জীবনে যে একটা মানুষ ওকে অবিশ্বাস করল সেটা শ্রীপর্ণাকেই হতে হল?

বোকা বোকা। অপরিণতমনস্ক ব্যাপার। অর্ক জানে। কিন্তু বোকা এবং অপরিণত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে অর্কর আর ইচ্ছে করছে না।

অর্ক ঘুমের ওষুধের একটা পাতা হাতে নেয়। সুইসাইড নোটে কি লিখবে কিছুতেই মাথায় আসছে না। কি করবে? না লিখলে তো শ্রীপর্ণা কখনো জানতেই পারবে না। আচ্ছা, লিখলেই বা কি করে জানবে। ইনবক্সে অর্কর চিঠি দেখলেই তো ইমেলটা ডিলিট করে দেবে। তাহলে লিখে কি হবে। পাশের ঘরে বৌ বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। আচ্ছা, অর্ক না থাকলে কারো কি ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? সম্ভবত না। এমন ব্যবস্থা করা আছে যে অর্ক মারা গেলেও ওদের টাকাপয়সার অভাব হবে না। বাচ্চাটাও ত বড় হয়নি যে খুব বেশিদিন পিতৃশোকে কষ্ট পাবে। প্রথম কদিন কাঁদবে, তারপর ভুলেই যাবে।

ইউটিউবে যে গানটা চলছিল সেটা শেষ হয়ে নতুন গান শুরু হয়েছে। ভাবনার সুতোটা ছিঁড়ে গেল।
এ কী করতে চলেছে সে! পঁচিশ বছর আগে জীবন কি তাকে শেখায়নি, পথ চলাটা আচমকা বন্ধ করে দিলে পরের বাঁকে কি বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে কখনোই তা দেখা হবে না? নিজের গল্প শুনিয়ে যে দুজনকে আত্মহত্যা থেকে বিরত করেছিল তাদের প্রতি একটা দায়িত্ব নেই?

না। আত্মহত্যা করবে না অর্ক। কে বলতে পারে, বেঁচে থাকলে আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি?

অর্ক সুইসাইড নোট লিখবে না। তাদের সত্যিকারের গল্পটা লিখে রাখবে। কে বলতে পারে, কোথাও যদি ছাপা হয়, আর সেটা শ্রীপর্ণার চোখে পড়ে, আর শ্রীপর্ণা তাকে বিশ্বাস করে?

অর্ক জানে শ্রীপর্ণা তাকে বিশ্বাস করলেও তার কাছে আর ফিরে আসবে না। ‘হোকে মজবুর মুঝে উসনে ভুলায়া হোগা।’ আসতে চাইলেও উপায় নেই তার। কিন্তু অর্ক জানবে, হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য সে চেষ্টার ত্রুটি করেনি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত