স্বপ্নজয়ী

স্বপ্নজয়ী

-এই রিক্সা যাবা.?
-না স্যার, আজ অনেক রাত হইয়া গেছে, বউ পোলাপান ঘরে না খাইয়া আমার লাইগ্যা অপেক্ষা করতাছে, আপনে অন্য রিক্সা দেখেন।

একথা বলে হুর হুর করে চলে গেল খালি রিক্সাটা, ঘড়িতে এখন সময় রাত এগারোটা বেজে সাতাশ মিনিট , রাহিব আশরাফী রিক্সার জন্য কল্যানপুর বাসস্ট্যান্ড এর সামনে দাড়িয়ে আছেন প্রায় অনেক্ষণ যাবত, কিন্তু কোন রিক্সা পাচ্ছেন না, আর বাস তো অনেক দূরের কথা, কারন গত দুদিন যাবত কি এক বিষয় নিয়ে যেন বাসওয়ালারা ধর্মঘট পালন করছে, সুতরাং এত রাতে বাসের আশা করাই হবে বোকামী, আজ অফিসে একটা জরুরী মিটিং এর কারনে একটু বেশিই দেরী হয়ে গিয়েছিল, ফলে তার মাশুল এখন দিতে হচ্ছে রাস্তায় দীর্ঘ সময় দাড়িয়ে থেকে।

একেতো অনেক রাত হয়ে গেছে তার উপর আবার ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে , ফলে খানিক বাদে যদিও দুই একটা রিক্সা দেখা যাচ্ছে, তবে তারা কেউই যেতে রাজি হচ্ছেনা, দুই একজনকে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলেও কোন সুবিধা করতে পারেননি তিনি।

অন্য সময় হলে এতক্ষনে নিজের গাড়িতে করেই বাসায় ফিরতেন তিনি , কিন্তু গত দুদিন আগে গাড়িটা সার্ভিসিং এর জন্য এক গ্যারেজে দেয়া হয়েছিল, আজ তা ডেলিভারির দিন ছিলো, কিন্তু ধর্মঘটের কারনে গ্যারেজ বন্ধ থাকায় ড্রাইভার আরিফ আর গাড়িটি আনতে পারেনি।

-স্যার কই যাইবেন..??

পেছন হতে হটাৎ এই আওয়াজ শুনে চমকে উঠেন রাহিব আশরাফী, তাকিয়ে দেখেন একজন বয়োবৃদ্ধ লোক রিক্সা নিয়ে দাড়িয়ে আছে এবং তার দিকে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে আছে তার জবাব শোনার জন্য, তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উত্তর দিলেন।

-এইতো মিরপুর একে, যাবেন..??
-ঠিক আছে চলেন, মুচকি হেসে বলল রিক্সাচলক।

রাহিব আশরাফী মনে মনে খুশি হলেন এবং প্রভুর নিকট কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উঠে বসলেন রিক্সায়। অতপর চলতে চলতে এক সময় রিক্সা এসে থামলো তার বাসার সামনে, রিক্সা থেকে নেমে তিনি ৩০ টাকা ভাড়ার জাগায় ১০০ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলেন রিক্সাচালকের দিকে এবং বললেন : চাচা আপনি এটা পুরাটা রেখে দেন। কিন্তু সে তা গ্রহণ করতে অস্বিকার করে এবং বলে : স্যার আপনার ভাড়া লাগবোনা, আপনি খালি আমার লেইগা দোয়া কইরেন, আমার স্বপ্নডা যানি পূরণ অয়, তাইলেই অইবো।

কথাটা শুনে রাহিব আশরাফী একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন, বলে কি বেটা..!!! এই বৃষ্টিতে ডাবল ভাড়া দিলেও কেউ আসতে চায়না, আর সে কিনা ভাড়াই নিবেনা..!!

ফলে এক প্রকার আগ্রহ নিয়েই রাহিব আশরাফী ভাড়া না নেয়ার কারনটা জানতে চাইলেন বয়োবৃদ্ধ রিক্সাচালকের কাছে, অতপর রিক্সাচালক তাকে যা বলল, তা শুনে সত্যিই সে অবাক না হয়ে পারালোনা।

রিক্সাচালক তাকে জানালো তার স্বপ্নের কথা, সে বলতে লাগলো : আমার নাম আব্দুর রহমান, আমি কাওরান বাজার বস্তিতে থাকি, ছোট কাল থেইকাই আমার স্বপ্ন আছিলো যে, আল্লাহ কবুল করলে আমি তার ঘর তাওয়াফ করমু, আর আমার নবির রওজা যিয়ারত করমু।

তাই আমি প্রতিদিন রিক্সা চালায়া যেই টাকা আয় করি, সেই আয়ের টাকা থেইকা কিছু টাকা আমি হজ্বের লেইগা জমা কইরা রাইখা দেই, আর প্রতিদিন আমার শেষ টিপে যেই লোক রিক্সায় উডে, তার থেইকা আমি ভাড়া না নিয়া আমি তার বাসায় দিয়া আহি, আর তারে বলি আমার লেইগা দোয়া কইরেন, আমার একটা স্বপ্ন আছে, সেডা যেন তারাতারি পূরন অইয়া যায়, আর আজকে আপনে হইলেন আমার শেষ টিপের যাত্রী, তাই আপনের কাছে থেইকা আমি ভাড়া নিমুনা, খালি আমার স্বপ্নডার লেইগা একটু দোয়া কইরেন, তাইলেই অইবো।

একথা বলে সালাম দিয়ে রিক্সাচালক চলে গেল, আর রাহিব আশরাফী অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলেন সেই রিক্সার দিকে, যতক্ষন না রিক্সাটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। বাসায় আসার পর থেকেই স্বামীর মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে আছে, বিষয়টা চোখ এড়াতে পারেনি রাহিব আশরাফীর স্ত্রী মিসেস তানিয়া রহমানের, তাই সে চুপচাপ স্বামীর পাশে এসে বসলো এবং মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে

বলল : কি ব্যাপার..? কি হয়েছে আপনার..? এমন মুখ গোমড়া করে বসে আছেন কেনো..?
কি হয়েছে আপনার একটু খুলে বলুন তো..!!! রাহিব আশরাফী তার গোমড়া মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটিয়ে তার স্ত্রীর হাত দুটো তার হাতে নিয়ে বলতে শুরু করেন রাস্তায় ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কথা। স্বামীর মুখ থেকে এই ঘটনা শুনে মিসেস তানিয়া রহমানও খুব অবাক হন এবং তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলেন :

-আচ্ছা…আপনি কি তার জন্য কিছু করতে চাচ্ছেন..?
-হুম তাতো অবশ্যই।
-তো..কি করতে চাচ্ছেন তার জন্য শুনি..?
-আমরাতো এবার হজ্বে যাচ্ছি..তাই না..!!!
– হুম…তো..??
-আমি চাচ্ছি আমাদের সাথে এবার সেই রিক্সা চালকের স্বপ্নটাও যেন পূরন হয়, যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে তার সম্পুর্ন খরচ আমিই বহন করতে চাই।

-আরে না না…আমার আবার আপত্তি কিসের.? আমারতো বরং আপনাকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা আমায় এমন একজন হীরার টুকরা স্বামী দান করেছেন। ( এতটুকু বলেই আনন্দে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে মিসেস তানিয়া রহমানের)

-আরে না না…কি যে বলোনা তুমি..!!! আচ্ছা তাহলে এক কাজ করি চলো, কালই আমরা তাকে খুজে বের করি এবং সুসংবাদটা তাকে জানিয়ে দেই কি বলো তুমি..?
-জি….আমিও তাই ভাবছি…!!!

পরদিন তারা উভয়ে মিলে গেল কাওরান বাজার বস্তিতে এবং অনেক খুজে ফিরে অবশেষে খুজে পেলো সেই বয়োবৃদ্ধ রিক্সাচালককে , তাদেরকে দেখে গরিব রিক্সাচালক যারপরনাই খুবই তাজ্জব হলো এবং বলল :

– কি ব্যাপার স্যার..?? আপনেরা আমার বাসায়..?? রাহিব আশরাফী খানিক মুচকি হেসে বললেন :
-আল্লাহর আদেশ হয়েছে তাই আমরা আপনার নিকট আসতে বাধ্য হয়েছি।
– মানে…???
-মানে হলো গিয়ে…আল্লাহ চাহেন তো এবার ইনশাআল্লাহ আমাদের সাথেই আপনার সেই মহৎ স্বপ্নটি পূরণ হবে, এবং এর সকল দায়ভার আমার।

একথা শুনে আনন্দে রিক্সাচালক যেন তার মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললো এবং কি বলে তাকে ধন্যবাদ জানাবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা, তার গাল বেয়ে অঝোরে অশ্রু বইতে লাগলো, এই অশ্রু তো দুঃখের নয় বরং এই অশ্রু তো আনন্দের.. মহা আনন্দের, সে কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরলো রাহিব আশরাফীকে এবং কানের কাছে মুখ এনে বলল স্যার আপনে মানুষ না আপনে ফেরেশতা, আপনেরে দিয়া আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করছে, এই বলে ফুপিয়ে কাদতে লাগলো সে, এখনো তার গাল বেয়ে বয়ে চলছে আনন্দের অশ্রু।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত