‘আমি যে বাসায় ভাড়া থাকতাম উনার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়েটা আমার আমার চার ক্লাস জুনিয়র। নাম রুপসা। ব্যালেচর দের বাসা ভাড়া পাওয়া কি যে দুঃসাধ্য কাজ তা তো সবাই ই জানে। বড় আকারের দুই টা ব্যাগ নিয়ে হাজির হলাম।
অনেক কষ্ট করে দুঃসম্পর্কের মামার জোরে বাসা টা ভাড়া পেয়েছি।রুমে এসে বিশ্রাম নিতেই বাড়িওয়ালা আংকেল আমায় তাঁর রুমে ডাক দিলো। রুমের দরজার এসে রুমের দিকে উঁকি দিলাম। আংকেল আধশোয়া অবস্থায় চোখ বুঁজে আছে। রুমের ভিতরে ঢুকবো কিনা বুঝতে পারছি না। উনি কিভাবে যেন আমার উপস্থিতি টের পেলো।বলল,
-‘আসো ভিতরে আসো।’
আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম। উনি সৌজন্যমূলক একটা হাসি দিয়ে বলল,
-‘বসো।’
আমি বসলাম। উনি বলল,
-‘বাবা কি করে? মাস থেকে ভাড়ার টাকা দিতে পারবে তো?’
কথা টা বুকে বিঁধলো তীরের মতো। আমার জানা মতে উনার টাকার অভাব নেই। কিন্তু স্বভাব যে ছোট লোকের মত তা বুঝার বাকী রইল না। উনি জানে আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তাই এভাবে কথাটা বলল। আমি কথাটা গায়ে মাখলাম না। কারন আমাদের মত ফ্যামিলির ছেলেরা এমন সব কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত। বললাম,
-‘হ্যাঁ পারবো দিতে।’
উনি আবার বললেন,
-‘বাবা কি করে তোমার?’
-‘বাবা নেই। তবে টেনশন করেন না আপনার টাকা মাস শেষে দিয়ে দিবো টিউশনি করে। তাছাড়া আমার স্কলারশীপের কিছু টাকা আছে।’
উনার সাথে কথা বলার ফাঁকে চোখ পড়লো জানালার দিকে। জানালার পর্দার কাপড়ের ফাঁক দিয়ে দুটি কৌতূহলি মেয়ে চক্ষু দেখা যাচ্ছে। উনি আমায় আবার বলল,
-‘ব্যাচেলর ছেলে দের বাসা ভাড়া দেওয়ার পক্ষপাতি আমি না। আমার বাসায় মেয়ে আছে। পড়ুয়া ছেলে তুমি আশা করি যা বলতে চাচ্ছি বুঝছো।’
আমি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
-‘জ্বী আংকেল বুঝেছি।’
রাতে রুমে বসে একা একা পড়তেছিলাম। রাত তখন 11টা। কারো পায়ের শব্দে চমকে যাই। রুমে এসেই মুখে আঙুল চেপে বলল,
-‘চুপ কোন কথা বলেন না।’
আমি ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘কে,কে আপনি?’
-‘আমি রুপসা। আপনার বাড়িওয়ালা আংকেলের মেয়ে।’
-‘এত রাতে আমার রুমে আসছেন কেন?’
আমার কথার উত্তর না দিয়ে টিফিন বক্স থেকে ভাত আর ইলিশ মাছ ভুনা বের করে আমার সামনে রাখলো। বলল,
-‘রাতে তো খান নি। খেয়ে নিন। আমার বাবার কথায় কষ্ট পেয়েন না। টাকাওয়ালা মানুষ ছাড়া উনি কাউকে দাম দেয় না।’
আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সাবলীল ভাবে কথা গুলো বলছে। বললাম,
-‘এগুলো নিয়ে যান আপনি। আপনার বাবা দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
-‘না আপনি খান,আমি যাচ্ছি।’
রুপসা রুম থেকে চলে গেলো আমি যেন ঘোরের মধ্যে আছি।সকালে উঠে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। রুপসা নাস্তা নিয়ে আমার রুমে হাজির। বলল,
-‘খেয়ে যান। নিচে একটু ওয়েট করেন আমিও যাবো।’
বুঝতে পারলাম বাপ-মেয়ে দুইজনই দুই মেরুর মেয়ে। আমি খেয়ে নিলাম। নিচে গিয়ে ভাবতে লাগলাম দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি চলে যাবো।কি মনে করে যেন দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষন পর রুপসা আসলো। মেয়ে টার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। রুপসা বলল,
-‘আপনার নামটা কিন্তু জানা হলো না?’
-‘সাবিদ।’
-‘বাহ্ ভালোই।’
-‘তুমি আর আমার রুমে খাবার নিয়ে যাবে না। তোমার বাবা দেখলে আমায় ঘাড় ধরে বের করে দিবে।’
-‘দেখবে না বাবা।’
এরপর থেকে প্রতিদিন আমার সাথে কলেজে যেত রুপসা। আমার কেয়ার করত খুব। একমাস শেষ প্রায়। কিন্তু টিউশনি পেলাম না। বাসা ভাড়া দিবো কি করে চিন্তায় মাথায় ধরে গেছে। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি। মায়ের শরীর টাও নাকি ভালো না।বড় ভাইয়ের বউ মাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। চিকিৎসার অভাবে দিনের পর দিন কষ্ট করছে না। বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল দিয়ে আমায় লেখাপড়া করিয়েছে এত বছর। মায়ের কষ্ট দেখলে ইচ্ছা করে লেখাপড়া ছেড়ে দেই। কিন্তু মা সব সময় বলে যতই কষ্ট হয় লেখাপড়া ছাড়িস না বাবা। মাস শেষ পটেকে বিষ টাকার নোট শুধু। আমার পাশে রুপসা এসে কখন দাঁড়িয়েছে টেরও পাই নি। বলল,
-‘মন খারাপ?’
আমি বললাম নাম,
-‘না।’
রুপসা আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল,
-‘ভাড়াটা বাবা কে দিয়েন।’
কারো কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেওয়ার অভ্যাস নেই। কিন্তু রুপসার কাছে হেরে গেলাম।
-‘একটা টিউশনির ব্যবস্থা করেছি আপনার জন্য। আমার ফ্রেন্ডের ছোট দুই ভাই-বোন কে পড়াবেন। মাস শেষে ভালোই বেতন পাবেন।’
রুপসার কথা শুনে কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ মুখ ছলছল করে উঠে। মেয়েটা কে যত দেখি মুগ্ধ হই। কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না।
এভাবে ভালোই কাটতে লাগলো দিন। ছয় মাস পেরিয়ে গেলো ঈদের ছুটি তে বাসায় যাবো । বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হওয়ার পর রুপসা এসে হাজির আমার রুমে। হাতে একটা রঙিন কাগজে মোড়ানো প্যাকেট। প্যাকেট টা আমার হাতে দিয়ে বলল ,
-‘আপনার আম্মুর জন্য এটা।’
-‘তোমার এত ঋন আমি শোধ করব কিভাবে?’
-‘আমায় একটা পায়েল কিনে দিলে সব ঋন শোধ হয়ে যাবে।’
ঈদের ছুটি শেষে বাসা থেকে আসি। মা কিছু নারকেলের নারু বানিয়ে দিয়েছে রুপসার জন্য। আর বলছে,
-‘বাবা রুপসা বড় লোকের মাইয়া ভুলেও ভালোবাসতে যাইস না কষ্ট পাবি।’
মায়ের কথা উপেক্ষা করে কিভাবে যে রুপসার সাথে সম্পর্ক জড়িয়ে যাই নিজেও টের পাই নি।
রিলেশনের কিছু দিন পর মনে পড়ে রুপসা আমার কাছে পায়েল চেয়েছিলো। টিউশনির মাস শেষ হওয়ার আগেই নির্লজ্জের মত টাকা চেয়ে এনেছিলাম। রুপসার জন্য ধূসর কালারের একটা শাড়ী কিনি। কি যে খুশি হয়েছে মেয়ে টা!
এভাবে আমাদের সম্পর্কের দুই বছর হয়ে যায়। রুপসার বাবা রুপসার বিয়ে ঠিক করে। রুপসা বলল,
-‘চলো আমরা পালিয়ে যাই।’
-‘এই অনিশ্চিত জীবনে পালিয়ে যাবো!’
-‘তাহলে বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেও।’
আমি জানতাম ওর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া নিছক বোকামী ছাড়ি কিছুই না। কিন্তু ওর জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেই।
এই পর্যায়ে সাবিদ স্যারের চোখে পানি ছলছল করছে। ক্লাসে সবাই উদগ্রীব হয়ে বলল,
-‘স্যার তারপর কি হয়েছে?’
পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখের কোনে জমে থাকা জল টুকু মুছে স্যার বলল,
-‘রুপসার বাবা বলেছে তুই যে লেবেলের মানুষ সে লেবেলের মেয়ে খুঁজে নে। আমার বাসার কাজের মানুষ হওয়ার যোগ্যতা তোর আছে ? আমার গালে কয়েকটা থাপ্পর দিয়ে আমায় বাসা থেকে বের করে দেয় ।’
আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না স্যারের কথা শুনে। বললাম,
-‘রুপসার শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়ে গিয়েছিল স্যার?’
-‘হুম।’
স্যার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-‘তবে কি জানো? রুপসার বাবার সেদিনের বলা কথা গুলোর জন্য আজকে এই অবস্থানে আসতে পেরেছি। সেদিনের পর রাত দিন পড়তাম। বি সি এস পরীক্ষায় টিকে যাই। তারপর তোমাদের ভার্সিটি তে জব হয়ে যায়। প্রত্যেক সফলতার পিছনেই থাকে ব্যর্থতার গল্প ।’
-‘স্যার বিয়ে করেন নি?’
-‘ না রুপসা কে এখনো ভুলতে পারি নি। তবে আমার মা এখন ভালো আছে এটাই আমার সব চেয়ে বড় পাওয়া।’
-‘স্যার রুপসা কে নিয়ে পালিয়ে গেলেন না কেন?’
-‘এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর সাথে ওকে জড়াতে চাই নি।’
-‘আজকে আর ক্লাস করব না।’
এই বলে স্যার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বুঝলাম পুরানো স্মৃতি নাড়া দিয়েছে।