শেষ চিঠি

শেষ চিঠি

মা,
তিন বছর হল তোমাকে দেখি না। আর আমাদের দেখাও হবে না।তোমার থেকে আমাকে লক্ষ যোজন দূরে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি ভেবেছিলে আমি খুব সুখী হব।ছোটবেলা বাবা মারা যাবার পর থেকে কষ্ট করে আমাকে আর ভাইকে মানুষ করেছ তুমি , কঠোর অনুশাসনে বেঁধেছিলে আমাদের দৈনন্দিন যাপনকে।তোমার রক্তচক্ষুকে ভয় পেতে পেতে আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে।বাইশ বছরের জীবনে জেনেছিলাম যে, তোমার কোন কথার বিরুদ্ধাচারণ করা যাবে না।তোমার ভুল সিদ্ধান্তকে বেঠিক বলার সাহস আমাকে বাইশটা বসন্ত দিতে পারে নি।তাই যেদিন টিউশন থেকে ফেরার পথে আমাকে অজয়ের সঙ্গে হাঁটতে দেখে তুমি অন্যত্র আমাকে বিয়ে

দিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলে, সেদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি নি আমি। ভয়….শুধু ভয়… এই ভয়ই আমাকে শেষ করে দিল।

সারা গায়ে মধ্যবিত্ত গন্ধমাখা অগোছালো চুলের অজয় ছিল আমার কাছে শীতের দুপুরের রোদের মতো….আমার প্রতিটি ভালোলাগাকে সে আলোমাখা চাদরে মুড়ে রাখতো,যার উপস্থিতিতে সব দুঃখ মুখ ফিরিয়ে দূরে চলে যেত,ওর স্পর্শে মিশে থাকতো আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি । যে মানুষটির সংস্পর্শ আমাকে ‘ভালবাসা ‘ কি বুঝতে শিখিয়েছিল তাকে তুমি উপড়ে ফেলে দিলে।তোমার মতে ‘ আনস্মার্ট ‘ অজয় তোমার ‘সুন্দরী’ মেয়ের পাশে বেমানান।অবাধ্য হবার মতো শক্ত শিরদাঁড়া তৈরী হয়নি , তোমার অন্যায় সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য হলাম।

সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে যে মানুষটার হাত ধরে অচেনা পরিবেশে প্রবেশ করলাম, সে বিদেশে এসে তার মুখোশটা খুলে ফেলল।কি সাংঘাতিক ভয় পেলাম আমি….আবার সেই ভয় ! তোমার স্মার্ট জামাই এর বান্ধবীদের ভীড়ে এসেই আমি হারিয়ে গেলাম।তার পেশীশক্তি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে ক্ষতবিক্ষত হলাম আমি….তুমি জানতেও পারলে না।

জানো মা…. অজয় আমার শরীর নয়, আমার আত্মাকে স্পর্শ করেছিল , তোমার জামাই সেই আত্মাকে আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।এতো হৃদয়হীন কেউ হতে পারে রজতাভকে না দেখলে জানতাম না আমি।এখন আমি রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি মুছতে দু-চোখে গাঢ় কাজলের প্রলেপ দিই, ঠোঁটে ক্ষতের দাগ লুকোতে চড়া রঙের লিপস্টিক লাগাই,গালের উপর পড়ে থাকা আঙুলের দাগের ওপর পাউডারের পাফ্ বোলাই।তোমার ‘ সুন্দরী ‘ মেয়ে নিপুণ হাতে প্রসাধন করে শুধু যন্ত্রণার চিহ্ন গোপন করার জন্য।সারা জীবন এই অভিনয় চালিয়ে যাবার মতো এতোবড় অভিনেত্রী আমি নই।অপমানের আঁশটে গন্ধে দম নিতে কষ্ট হয় আমার…. জানলা খুলে বাতাসে ভাসিয়ে দিই জমানো দীর্ঘশ্বাস।

স্পর্ধার আধিক্যে রজতাভ যেদিন নেশার ঘোরে আমার মধ্যে বেড়ে ওঠা একটা প্রাণকে খুন করল, ঠিক সেদিন মৃত্যুভয়কে জয় করলাম আমি।ঠিক করলাম একটা জীবন বাঁচব বলে রোজ রোজ আর মরব না আমি।তাছাড়া এতো অবহেলা নিয়ে বাঁচা তো মৃত্যুরই সমান।

আর ভয় নেই আমার…. ভয়কে জয় করেছি।এই জয় উদ্ যাপনের আগে শুধু একটা অনুরোধ তোমায় করি মা…. ভাইকে তার নিজের শর্তে বাঁচতে দিও, তোমার সব মতামত ওর ওপর চাপিয়ে দিও না।ও খুব সুন্দর ছবি আঁকে, এই ব্যাপারটায় ওকে উৎসাহ দিও।

মৃত্যুকে দরজা খুলে দিলাম।অনন্ত এক ঘুমের দেশ আমাকে ডাকছে।বাইরে ভীষণ ঠান্ডা , সেই হিমের পরশ আমার শরীরকেও ছুঁয়ে

যাচ্ছে, একটা সাদা চাদর নিজেই নিজের গায়ে টেনে নিলাম।যখন এই চিঠি পাবে,তখন জীবন থেকে সরে গেছি আমি,তবে হারিয়ে যাই নি_

__আমায় দেখতে হলে অজয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েো, ওর দু-চোখে আমাকে ঠিক খুঁজে পাবে। নিজের অস্তিত্বকে মুছে ফেলা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না।তথাকথিত সফিস্টিকেটেড সমাজের মুখে একরাশ ঘৃণা ছিটিয়ে গেলাম।আমার জন্য দুঃখ পেয়ো না, জন্মান্তরে বিশ্বাসী এ মন কোন এক জন্মে ঠিক অজয়কে খুঁজে পাবে…

অমৃতা

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত