গেল মাঘী পূর্ণিমায় কুসুম আটত্রিশে পরল। ছোট থেকেই ওর খুব সিঁদুর পরার শখ।মা কাকীমারা যখন দশমীর দিন সিঁদুর খেলতে তখন ও পিছু পিছু ঘুরে সিঁদুর মাখত। বড় হয়ে এক ঢাল সিঁদুর সিঁথিতে দিয়ে বউ সাজার ইচ্ছে ওর বরাবরের। একটু বড় হতেই লুকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে সিঁদুর পরতো নিজে নিজেই। হাতের শাঁখা পলা পড়লে কেমন লাগবে, এই ভেবে আকুল হয়ে উঠত। কিন্তু এমনই কপাল এই আটত্রিশ বছর বয়সে এসেও ওর সাধ মিটল না।’সতী সাবিত্রী হয়ে সারা জীবন ঘরকন্না করো’- এমন আশীর্বাদও ওর জুটলো না।
প্রেমে কুসুম কম বার পড়েনি। বয়স যখন ষোল, শিশির দার প্রেমে পাগলপারা ছিল। দাদার বন্ধু শিশির দা যখন বাড়ি আসত, লজ্জায় মুখ ঢাকত সাবিত্রী। শিশিরদার কোন বোন ছিল না।তাই তার বোনের শখ মেটাতে, কুসুমকে দাদার অনুরোধে যেদিন রাখি পড়াতে হলো, সেদিন মন ভেঙ্গে গেলো ওর। এরপর প্রেমে পরল যখন, তখন বয়স ঊনিশ। ওদের পাশের বাড়িতে ভাড়া এলো একটা পরিবার। তা তাদের ঘরে অরুন নামে একটা ছেলে ছিল। তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো কুসুম। কিন্তু সাত মাস গেল না তারা সেখান থেকে ভাড়া উঠে গেল। আর কুসুমের এ প্রেমেরও সমাপ্তি। যদিও অরুণ বলে ছেলেটি কখনো কুসুমের মনের কথা জানতে পারেনি।
এছাড়া রাস্তাঘাটে আত্মীয় বাড়িতে বেশ সুদর্শন কাউকে দেখলেই প্রেমে পড়তে কুসুম। আর তার পাশে বউ সেজে কেমন লাগবে ভেবে সারারাত জেগে কাটাত।
বাড়ির লোক যে ওর বিয়ের চেষ্টা করত না তা না। ওর বাবা ঘটক লাগিয়েছিল আর তাকে ভালো মতন ঘটক বিদায়ের লোভও দেখানো ছিল। প্রায় সময় পাত্রপক্ষ আসত, তারপর এক থালা মিষ্টি খেয়ে ‘পরে খবর দেব’ বলে কেটে পরত। পরে খবর যা আসত তাতে মনটা আরও ভেঙে যেত কুসুমের। আসলে কুসুমের গায়ের রংটা ছিল বেশ চাপা। লম্বাও খুব একটা নয়। বরং বলা যায় বেঁটে। উপরের পাটীর দাঁত বেশ উঁচু হাসলে দাঁত গুলো বেরিয়ে যায় অর্থাৎ বিয়ের বাজারে কুসুমের খুব একটা দাম নেই। বাড়িতে আর সব দিদি বোনের বিয়ে হয়ে গেল। কুসুমের আর বিয়ের পিঁড়িতে বসা হল না।
ওর ঠাকুমা থুতনিটা নেড়ে বলতো,
“কিরে মেয়ে, তোর কবে বিয়ের ফুল ফুটবে? নাতজামাই দেখতে সাধ যায় যে।”
আরে ধুর! কি যে বলে ঠাকুমা! কুসুমের নিজেরই সাধ আহ্লাদ কত। কিন্তু বিয়ের ফুল যে আর ফোটেনা। কুসুমের সাজগোজেরও বাহার খুব। সব বিয়ে বাড়িতে ওর সাজ দেখার মত। মাসি পিসির কেউ হয়তো বলতো,
” ওরে মুখে যে বড্ড পাউডার মেখেছিস। আর ঠোঁটের লিপস্টিকটা একটু হালকা কর।”
বিয়ে বাড়ি বলে কথা। একটু সাজগোজ না করলে হয় কখনো, বলে উঠতে কুসুম।
ওর থেকে বয়সে ছোট কোনো বোনের বিয়েতে বেশি সাজলে পড়শিরা হাসাহাসি করত। নিজের বিয়েতে আর সাজতে হচ্ছে না বোনের বিয়েতে সেজে শখ মেটাচ্ছে। ছোট বোনের বরের সাথে বাকি শালিরা যখন রঙ্গরসিকতা করত হিহি করে যোগ দিত কুসুম।ওর মা আড়ালে ডেকে নিয়ে বলত, “লজ্জা করে না বিয়ে হয়নি বলে বয়স কি তোর থেমে থাকছে। তুই যে সম্পর্কে বড়। হায় হায় এই মেয়ে কবে বুঝবে ? ”
একে একে বাবা-মা মারা গেল। ছোট দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। নতুন দুই বউ ঘরে এলো। কুসুম ওদের সাথে মিলেমিশে থাকতে চায়। কিন্তু তারা ঘরে বসা, বড় ননদকে সহ্য করতে পারেনা।
বরাবর রেডিওতে গান শোনা আর হলে গিয়ে সিনেমা দেখার শখ কুসুমের। কম বয়সে খুব সিনেমা দেখত। তারপর ওর সমবয়সী সবার বিয়ে হয়ে যেতে, একা একাও কত গেছে। নায়িকা যখন গাছের ডাল ধরে নায়ক এর সাথে নাচে গান করে,কুসুম সেখানে নিজেকে কল্পনা করে মশগুল হয়ে থাকে।
কুসুমের হাতের কাজ বরাবরই খুব ভাল। আসন বোনাই হোক বা উল বোনা। বাড়ির সাথে সাথে, পাড়ার এর ওর বাড়ির জন্যেও করে দেয়। বেশ কিছু রোজগার হয়। অন্তত নিজের সাজগোজ আর বাদাম- ফুচকার শখ মেটাতে ভাইদের কাছে হাত পাততে হয় না। মুখে পাউডার লাগিয়ে, চোখে কাজল দিয়ে, পাট ভাঙা শাড়ি পরে বেরোয় কুসুম। কাছাকাছি একটা পার্ক আছে।সেখানে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে থাকে। সন্ধ্যে হলে বাড়ি ফেরে। ওর এমন কান্ড দেখে লোকে হাসাহাসি করে ঠিকই। কিন্তু চরিত্রের কেউ দোষ দেয় না। দুই ভাইয়ের বউ মালা আর নীতা হেসে গড়িয়ে পড়ে,
“যাত্রার সঙ বেরোলেন।যদি কাউকে পাকড়াও করা যায়। অমন রূপের ধুচুনিকে কে পছন্দ করবে।”
যে পার্কে কুসুম যায়, সেখানে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই খেলতে যায় বা হাঁটতে যায়। তবে অনেকেই ‘বৃন্দাবন’ আখ্যা দিয়েছে পার্কটাকে।কেননা জোড়ায় জোড়ায় গাছের তলায়, বেঞ্চের ওপর প্রেমিক-প্রেমিকা বসে থাকে। কি সুন্দর গল্প করে কপোত-কপোতীর মত। কুসুমের তো বেশ দেখতে লাগে।
কদিন হল কুসুমের উল্টো দিকের বেঞ্চে এসে বসে এক মধ্যবয়স্ক লোক।কাঁচাপাকা চুল গায়ের রং মাজা। কার্তিক মাসের শেষের দিক। তাই কুসুমের হাতে উলবোনার জিনিস। এদিক ওদিক দেখছে আর পটু হাতে বুনে যাচ্ছে।ভদ্রলোক নিজেই একদিন যেচে আলাপ করলেন।
” আপনাকে দেখি, রোজই কি সুন্দর উল বোনেন। এখন তো লোকে বোনেই না। আমার মা জানেন এইভাবে বুনত।”
এই ভাবে আলাপের শুরু। কদিন পর নিজেই একখানা সোয়েটার ফরমায়েশ করলেন। তবে দাম দেবেন বললেন। কুসুমের কি মনে হল, সে শুধু উলের দাম টুকুই নিল। মজুরি নিল না। দুদিন বাদে প্রতুলবাবুর মাপ নেওয়ার প্রয়োজন হল। পিঠ স্পর্শ করে মাপ নিতে অকারণে শিহরণ জাগল কুসুমের মনে।
পৌষ মাসের গোড়ায় আলাপ জমে উঠল। একজন কোন কারণে অনুপস্থিত থাকলে, অন্য জনের ফাঁকা লাগে। কুসুমের এখন পার্কে যাওয়ার তাড়া। এমনি এমনি আর ঘুরতে যাওয়া হিসেবে নেই আর। কার টানে যেন যেতেই হয়! কে যেন অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য।
এত দিনে জেনেছে প্রতুল বাবুরও বিয়ে হয়নি। একটা ছোটখাটো ব্যবসা আছে। বাড়িতে কেউ নেই, নিজেই যাহোক রেঁধে খায়। কেউ তেমন নেই। তাই এত টাকার পেছনে দৌড়ে কি হবে! কাজ কমিয়ে সময় কাটাতে বিকালে পার্কে এসে বসেন।
মাঘ মাসের শেষের দিকে প্রতুল কুসুমের মধ্যে বন্ধন যেন দৃঢ় হয়ে উঠল। আজকাল প্রায় দিন এটা সেটা খাবার করে নিয়ে আসে কুসুম, প্রতুলের জন্য। টিফিন কৌটো করে আনে, আবার বাড়ির জন্যেও দিয়ে দেয়। কিন্তু কেউ কাউকে মন দেওয়া নেওয়ার কথা বলে উঠতে পারেনি।
বাড়ির লোক শুনেছে কুসুম পার্কে রোজ একটা আধা বয়স্ক মানুষের সাথে বসে। তার খাবার নিয়ে যাওয়া নিয়ে তাদের আপত্তি। ভাইয়েরা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উল্টো পাল্টা বলেছেও।
প্রতুলবাবু কুসুমকে কখনো অন্য কথা কিছু বলেন নি, ওনার আচরণও ভালো। কিন্তু কুসুমের মন কেন এমন হয়! মানুষটার জন্য সারাদিন চিন্তা হয়। কি খাচ্ছে কি করছে!
ফাল্গুন মাস পড়ে গেল। পার্কে কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া,শিমুল পলাশ আছে। গাছগুলো লালে লাল হয়ে আছে। কে যেন আগুন ধরিয়েছে চারিদিকে। অকারণে গাছের ফাঁকে কোকিল ডাকে কুহু কুহু। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছে আজ কুসুম। কি হলো, এত দেরি হচ্ছে কেন। গতকাল বলেছিল আজ যেন ও লাল পাড় হলুদ রঙের শাড়ি পড়ে আসে। কি সব নাকি বলবে। কি বলবে কি জানি! কুসুম নিজে হাতে মাড় দিয়ে, ইস্ত্রি করা একটা হলুদ তাঁতের শাড়ি পরে এসেছে। আর তাতে লাল লাল বুটি। চিন্তা হচ্ছে, কি হলো আসছে না কেন মানুষটা!
হঠাৎই মাথায় কিসের স্পর্শ। প্রতুলের হাতে কৃষ্ণচূড়া ফুল সমেত ছোট্ট ডাল।যেটা কুসুমের বড় খোঁপায় গুঁজতে গুঁজতে বললেন,
“আর যে অপেক্ষা করতে পারি না কুসুম। প্রথমে বয়সের কথা ভেবেছিলুম। কিন্তু কি আর এমন বয়স হয়েছে আমাদের। তুমি যদি রাজি থাকো, চলো আজই কাছের মন্দিরে গিয়ে তোমায় সিঁদুর পরাই। কাগজ কলমের বিয়ে না হয় দুদিন পর করে নেব। তুমি রাজি আছো
তো? ”
রাজি! সে তো আছেই কুসুম। শুধু লজ্জায় নিজের মুখ ফুটে বলতে পারেনি। আজ ওর সাধ পূর্ণ হবে। আর নকল বউ সেজে নিজের মনে আনন্দ করা নয়। এবার ও সত্যি সত্যি বউ সাজবে।তাহলে আর কিসের অপেক্ষা। প্রতুলের হাত ধরে কুসুম বলে,
“চলো কোথায় নিয়ে যাবে। আজই আমায় বিয়ে কর আর হ্যাঁ, দোকান থেকে একজোড়া শাঁখা পলা কিনে নিও। না হলে যে বিয়ে সম্পূর্ণ নয়। এক জোড়া গোড়ের মালাও লাগবে কিন্তু। বিয়ের ফুল ফুটল বলে কথা।”
সমাপ্ত