আমার আগের রচনা হইতে পাঠকগণ অবগত আছেন যে আমার চাকুরীজীবনের শুভারম্ভ একটি ছোট সংস্থায় শিক্ষানবিশি করিয়া| সেই কর্মসূত্রেই আমাদের নানা স্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইতো, বিভিন্ন লোকজন ও বিভিন্নতর কাজকর্মের সহিত পরিচিতি হইয়াছে, অভিজ্ঞতাও হইয়াছে অনেক| সেই সময়কার আরেকটি ঘটনার কথা আজ লিখিতে বসিয়াছি|
আমি তখন ডালহৌসি অঞ্চলের একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থায় অডিটের শিক্ষানবিশি শুরু করিয়াছি| সঙ্গে আছেন একজন Sir, বয়সে ও অভিজ্ঞতায় প্রবীণ, হাসিখুশি খোলামেলা স্বভাবের জন্য সবারই খুবই প্রিয় তিনি| এই মানুষটির সঙ্গে আমরা যাহারাই কাজ করিবার সুযোগ পাইয়াছি তাহারা বিশেষ ভাগ্যবান| অগাধ জ্ঞানের অধিকারী তিনি | হিসাবপত্রে জহুরির চোখ ও অদ্ভুত বিশ্লেষণী ক্ষমতা | কিন্ত গতানুগতিক নিরস টাকাপয়সার হিসাবগুলি তাঁহাকে রসকষহীন কাষ্ঠপুত্তলিকা বানাইয়া ফেলিতে পারে নাই | তাঁহার মনের শিশুসুলভ একটি দিক এই প্রবীণ বয়সেও বিদ্যমান ছিল, ছিল সূক্ষ রসবোধ, আর ছিল দুর্দমনীয় ভ্রমণের নেশা| স্বভাবতই অডিটের কাজে নানা জায়গায় ঘুরিতে হইতো , তাহা এই মানুষটি এতো বয়সেও যারপরনাই আনন্দের সহিত করিতেন ও সঙ্গের বালখিল্যগুলিকেও সেই রসে বঞ্চিত করিতেন না|
যেইবারের কথা কহিতেছি সেটি ‘আট সালের খুব সম্ভবত ফেব্রুয়ারীর শেষের দিক – হঠাৎ Sir বলিলেন যে কোম্পানির কলিকাতার কাজ গুটাইয়া আসিলে একবার ইহাদের কল্যাণীস্থিত কারখানাটিও দেখিয়া উচিৎ| কারখানার হিসাবের খাতাপত্রের সরেজমিনে তদারকিও হইবে , একটু ঘোরাও হইবে আর নতুন কাজ শেখাও হইবে|
সদ্য আগত মনোহারী বসন্ত ঋতু দরজায় কড়া নাড়িতেছে, দীর্ঘ শুষ্ক শীতের পর বহিঃপ্রকৃতিতে যেন প্রাণচাঞ্চল্য পড়িয়া গিয়াছে. বৎসরের এই দুর্দান্ত সময়টিতে শহরের ধোঁয়া ধূলা ধূসর মলিনতার বাহিরে বেড়াইতে যাইবার গন্ধ পাইয়াছি| অত্যন্ত উদগ্রীব হইয়া জানাইয়া দিলাম যে আমি খাতায় কলমে কাজ রপ্ত করিতে বিশেষ আগ্রহী| Sir তাঁহার এই ছাত্রীটিকে খুব ভালোই চিনিতেন, তিনি মুচকি হাসিলেন| কারখানার নিকটেই কোম্পানির অতিথিনিবাসে থাকা স্থির হইয়াছে| আমাকে লইয়া Sir বাহির হইয়া পড়িলেন কল্যাণীর উদ্দেশ্যে |
কল্যাণী পৌঁছাইতে ঘন্টা আড়াই লাগিল গাড়িতে| ছোট শহরতলি, ছিমছাম সুদৃশ্য বাড়িগুলি, প্রায় প্রত্যেকটির সাথেই এক চিলতে করিয়া ক্ষুদ্র জমি রহিয়াছে – গৃহস্থেরা মনের সাধ মিটাইয়া বাগান করিয়াছেন, শীতের মরশুমি ফুলে ভরাইয়া তুলিয়াছেন| বৈভবপূর্ণ না হইলেও বেশ সুরুচির ছাপ সর্বত্র | আমরা সরাসরি কারখানার কার্যালয়ের উদ্দেশেই রওনা হইয়া গেলাম| স্থির হইলো যে একেবারে কাজ মিটাইয়া সন্ধ্যাবেলায় অতিথিনিবাসে ফিরিয়া বিশ্রাম লইব |সারাবেলা কাজের মধ্য দিয়া কাটিয়া গেলো| বিকালে কর্মে ইতি টানিয়া আমরা উপিস্থিত হইলাম অতিথিনিবাসে|
অতিথিনিবাসটির আশপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা অনধিকৃত পড়িয়া আছে – সবুজ মাঠে যেন কে তৃণের গালিচা বিছাইয়া দিয়াছে| অদূরে কারখানাটি দেখা যাইলেও পদব্রজে যাওয়া চলেনা, বড়ো রাস্তা দিয়া ঘুরিয়া যাইতে হয়| মাঠের মধ্যে যেন এক ইন্দ্রপুরী বসিয়া গিয়াছে| অতিনিবাসটি আকারে বৃহৎ, ইংরেজ আমলের বাংলোবাড়ির মতো স্থাপত্য তাহার | পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দি, ভিতরে কেয়ারী করা বেশ বড়ো বাগান| শীতের নানা ফুল এই বসন্তেও বাগান আলো করিয়া রহিয়াছে| পাঁচিল বরাবর অনেকগুলো চাঁপা, কদম , কৃষ্ণচূড়া গাছ- তাহারা ঋতুবৈগুণ্যে প্রায় নেড়া হইয়া গিয়াছিল – এখন বসন্তের ছোঁয়া পাইয়া তাহাদের রিক্ত অবস্থার উন্নতি ঘটিতেছে, পেলব সবুজ কচি পাতা আসিতে শুরু করিয়াছে| অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু যেন কে অবহেলায় মাখাইয়া দিয়া গিয়াছে বাগানের ফুলগুলিতে, গাছে গাছে পাখিদের ঘরে ফেরার কলতান শুনা যাইতেছে|
অতিথিনিবাসটি একটু ঘুরিয়া দেখিবার লোভ সামলাইতে পারিলাম না| দ্বিতল বাড়িটিতে মোট ষোলোটি কক্ষ, দুটি তলাই বহুমূল্য আসবাবে ঠাসা | আপাতত অতিথির অভাবে সব সাদা চাদর চাপা রহিয়াছে| উপরে ও নীচে কক্ষগুলির বাহিরে লম্বা টানা বারান্দায় ঝাড়বাতিগুলি মৃদুমন্দ বাতাসে অল্প অল্প দুলিতেছে| নীচের তলায় একখানি পূর্বমুখী বিশাল কার্পেটমোড়া ঘরে আমার থাকিবার ব্যবস্থা হইয়াছে| Sir থাকিবেন উপরের তলায় পশ্চিমের দিকের একটি কক্ষে|
এই সুবিশাল গৃহে দুদিন থাকিব মনে করিয়া মন আনন্দে নাচিয়া উঠিল| চা পান ও ম্যানেজারের সহিত কিছুক্ষন খোশগল্প করিয়া যে যার কক্ষে চলিয়া গেলাম |আমি নিজ কক্ষে গিয়া হাতমুখ ধুইয়া একবারের জন্য বাগানে গিয়াছিলাম, সাঁঝবেলার স্তিমিত আলোয় তেমন কিছুই দৃষ্টিগোচর হইতেছিলোনা আর| দেখিলাম আকাশে বেশ বড়ো একখানি চাঁদ উঠিতেছে, এই নির্জন পরিপার্শ্ব তাহার জোছনায় আলোকিত হইয়া উঠিতে শুরু করিয়াছে| বড়ো মনোরম লাগিতেছিলো, ইচ্ছা হইতেছিল আরেকটুক্ষণ কাটাই চন্দ্রালোকস্নাত বাগানটিতে, কিন্তু নব বসন্তের পড়ন্ত সন্ধ্যার এই শীতভাবে বেশিক্ষন না দাঁড়াইয়া থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করিয়া ঘরে ফিরিলাম| রাত্রে খানসামা বাবুর্চি পরিবৃত হইয়া কেতাদুরস্ত কায়দায় অতি সুস্বাদু ভোজন সারিলাম| খাওয়া শেষ হইলে তাহারাও নিজ নিজ গৃহে প্রস্থান করিল | Sir উপরে চলিয়া গেলেন, আমিও নিজের ঘরে আসিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলাম|
কক্ষ পুরোপুরি নিষ্প্রদীপ করিলামনা, নৈশদীপ ও সংলগ্ন বাথরুমের আলোটি জ্বালাইয়া রাখিলাম| বিছানায় শুইয়া দুই চোখ ভরিয়া বাহিরের অপরূপ দৃশ্য দেখিতেছিলাম| জ্যোৎস্না আর দেখা যাইতেছেনা – কেমন একটা আবছা আলোয় বড়ো মায়াময়ী দেখাইতেছে ধরিত্রীকে| মনে হইতেছে মেঘরূপী অভিসারী আসিয়া পড়িয়াছে অতর্কিতে, লজ্জা পাইয়া জ্যোৎস্না তাহার পিছনে মুখ লুকাইয়াছে| এসময়ে থাকিয়া থাকিয়া অকালবর্ষণ হয় – শীত পুরোপুরি চলিয়া যাইবার পূর্বে এই বসন্তেও একটি অন্তিম মরণকামড় দিয়া যাইবার লোভ সামলাইতে পারেনা | এসমস্ত ভাবিতে ভাবিতে কখন যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছি|
রাত্রি প্রায় দেড় ঘটিকায় অকস্মাৎ নিদ্রা টুটিল, কেহ যেন হঠাৎ ঠেলা মারিয়া জাগাইয়া দিয়া গেলো|কোথায় আছি ঠাহর না করিতে পারিয়া ক্ষণকালের জন্য হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম| জানালার বাহিরে একটি আলোর ঝলক দেখিয়া বুঝিলাম বিদ্যুৎ চমকাইতেছে, সন্ধ্যার জ্যোৎস্নাস্নাত বিশ্বচরাচর ঘোর কালিমালিপ্ত, হঠাৎ হঠাৎ বজ্রপাতে বাগানের গাছগুলি ক্ষনিকের তরে দৃশ্যমান হইতেছে| বারান্দা হইতে তোয়ালেখানি লইয়া আসিলাম, রাত্রে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে যাইবে একদম| বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে, থমথমে পরিবেশ , হাওয়ার নামমাত্র নাই| জানালাগুলি উত্তমরূপে আঁটিয়া দিয়া আসিলাম, অন্ধকারে দেখিতে না পাইয়া কোনো পেরেকে আঙ্গুল ঘষিয়া বুঝি কাটিয়াই গেলো| পুনরায় বিছানায় ফিরিয়া আসিলাম|
ঘুম আসিলনা| প্রাথমিক ক্লান্তি কাটিয়া যাইবার পর এই এক মুশকিল – একবার মধ্যরাত্রে নিদ্রাভঙ্গ হইলে আর আসিতে চাহেনা| আঙুলটিও সদ্য চোট পাইয়া জ্বলিতেছে| অলস মস্তিষ্কে নানান অবান্তর পরস্পর সম্পর্কহীন এলোমেলো চিন্তা আসিয়া ভিড় করিতেছে, হঠাৎ চিন্তাজাল ছিন্ন হইয়া গেলো- দমকা হাওয়ায় একখানি কবাট সশব্দে খুলিয়া গেছে| প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নৈশদীপ ও বাথরুমের আলো টিও নিভিয়া গেলো| অকস্মাৎ অন্ধকার হইয়া হইয়া যাওয়াতে একটি স্নায়বিক ধাক্কা খাইলাম – মনকে বুঝাইলাম লোডশেডিং হইয়াছে দুর্যোগের রাতে| কিন্ত কিছুতেই বুঝিতে পারিলামনা জানালাটি কিরূপে খুলিল, বাহিরে হাওয়া নাই, তাছাড়া ছিটকিনি বেশ মজবুত, আমিও ভালো করিয়াই আঁটিয়া আসিয়াছিলাম হুড়কাগুলি| কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হইতে লাগিল, এই বিশাল জনমানবশূন্য অট্টলিকায় হঠাৎ নিজেকে বড়ো একাকী ও অসহায় মনে হইতে লাগিল|
আর ঘুমের চেষ্টা করা বৃথা | একটু পর বুঝিলাম বাহিরে বৃষ্টি থামিয়াছে, কিন্তু আকাশ মেঘমুক্ত হয় নাই| ইন্দ্রিয়গুলি অতিমাত্রায় সজাগ হইয়া উঠিয়াছে, এখন বোধ করি শিশির পড়িলেও তাহার শব্দ শুনিতে পাইব| সেদিনই দিনের বেলায় যে বাড়িটিকে এতো ভালো লাগিয়াছিল, চারিদিক মনের আনন্দে ঘুরিয়া দেখিয়াছিলাম, এখন মনে হইতে লাগিল এস্থানে আমি বন্দিনী হইয়া আছি| আমাকে এই অবস্থায় একাকী পাইয়া প্রকৃতি বড়োই নিষ্ঠুর পরিহাস করিতেছেন|
এইসময়ে নাকে খুব মিষ্টি একটি সুগন্ধ আসিয়া প্রবেশ করিল ও ক্রমশ তাহা তীক্ষ্ণতর হইতে লাগিল| জানালা দরজা সব বন্ধ রহিয়াছে, সহসা এই সুগন্ধের উৎস কি বুঝিতে পারিলামনা | মনে পড়িল বাল্যকালে আমাদের বাড়ির বাগানে একটি লেবুগাছ ছিল, এ তাহারি ফুলের গন্ধ| মোহময়ী নেশাধরানো এক আঘ্রাণ, অচিরেই মন কে কেমন উতলা করিয়া তোলে| বাহিরে বাগানে নিশ্চয়ই লেবুগাছ আছে, বসন্তে নতুন কুঁড়ির শুভাগমন ঘটিয়াছে| কাল কয়েকটা ফুল তুলিয়া আনিয়া ঘরে রাখিব – বড়ো মনোমুগ্ধকর সুবাসখানি|
যাহা হউক, লেবুফুলের সুগন্ধ যত ভালোই লাগুক, তাহা যেন এই মুহূর্তে ঠিক উপভোগ করিতে পারিলাম না| সারা সন্ধ্যা আশপাশে কোথাও এই আঘ্রাণ পাই নাই, এখন হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলো? ভারী পর্দাগুলির আড়ালে কোথাও বুঝি একটি টিকটিকি লুকাইয়াছিল, সেই এই মুহূর্তেই তাহার অস্তিত্ব জানান দিয়া নিজের সম্মতি জানাইল -টিক টিক টিক| সরীসৃপ শ্রেণীর প্রাণীদের আমি চিরদিনই ঘৃণা করিয়াছি – ভয় করিয়াছি আরো বেশি – কিন্তু ওই অদৃশ্য প্রাণীটি যেন এই কালরাত্রে আমার পরম বন্ধু হইয়া উঠিল| মনে হইতে লাগিল কেবল আমরা দুটি প্রাণী বাঁচিয়া আছি – বাকি সব চিরতরে লুপ্ত হইয়াছে পৃথিবী হইতে|
লেবুফুলের গন্ধ পূর্ববৎ রহিয়াছে| কি অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি ভাবিতে লাগিলাম| সহসা হৃদয়বিদারক শব্দ করিয়া একটি বিড়ালছানা কাঁদিয়া উঠিল – এতো জোর আওয়াজ হইলো মনে হইলো এই ঘরেই কোথাও লুকাইয়া ছিল সেটি | তারপর আবার অতল নিস্তব্ধতা |শব্দ আর গন্ধের যেন এক অদৃশ্য খেলা আরম্ভ হইয়াছে আমাকে ঘিরিয়া! নাঃ এরাত্রে আর ঘুম হইবেনা| কোনোমতে রাতটা কাটাইতে হইবে| বারবার মন কে বুঝাইতে লাগিলাম যে ভয়ঙ্কর কিছুই ঘটে নাই – খামোখাই আমি আতঙ্কিত হইতেছি|
অলৌকিক অতিপ্রাকৃত ইত্যাদি চিন্তাভাবনাকে আমি চিরকালই হিসেবের বাহিরেই রাখিয়াছি – কিন্তু আজ যেন তাহাদের আর কিছুতেই ঠেকাইয়া রাখিতে পারিতেছি না|
বাকি রাতটুকু চক্ষু মুদিবার আর সাহস হয় নাই| হয়তো নিজের অজান্তেই শেষ রাত্রে চোখ লাগিয়া গিয়াছিল – স্বপ্ন দেখিলাম একটি বিশাল বাগানে কয়েকটি লেবুগাছ ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ, নীচে একটি বিড়ালছানা আপনমনে খেলা করিতেছে| ভোরের সূর্যের প্রথম আলোটি চোখে লাগিতেই তন্দ্রার ঘোর ছুটিয়া গেলো| লেবুফুলের গন্ধ যে অদৃশ্য পথে অকস্মাৎ আসিয়াছিল, তাহা দিয়েই পুনরায় মিলাইয়া গিয়াছে| মেঘ সম্পূর্ণ কাটিয়া গিয়াছে – সেদিনকার মেঘহীন সেই সূর্যস্নাত ভোরের সহিত পূর্ব রাত্রের যেন কোনো সামঞ্জস্যই নাই – পুরোটাই দুঃস্বপ্ন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল| শয্যাত্যাগ করিয়া কনকনে ঠান্ডা জলে স্নান করিলাম, মাথাটা কিঞ্চিৎ ঠান্ডা হইলো| গা মুছিতে গিয়া দেখি তোয়ালেটি গত রাত্রের বৃষ্টিতে যেটুকু ভিজিয়েছিলো এখনো শুকনো হয় নাই| আঙুল একটুখানি কাটিয়াছে, কিঞ্চিৎ পরিমাণ রক্ত জমিয়া আছে, তাহাতে মলম লাগাইলাম| তারপর বাগানে বাহির হইলাম লেবুগাছের খোঁজ করিতে|
সারা বাগান তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও লেবুগাছ তো দূর, একটি চারাও খুঁজিয়া পাইলাম না| বড়োই অবাক হইলাম| পূর্বেই বলিয়াছি আশপাশে আর কোনো বসতি নাই.. ঢেউ খেলানো ঘাস জমি| তবে সারারাত ওই সুবাস আসিলো কোথা হইতে? মালি আসিয়াছিল বাগান পরিচর্যা করিতে – তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিলাম| সে বলিল বছর পাঁচেক আগে নাকি এই পাঁচিল বরাবরই বাগানে কয়েকটি লেবুগাছ ছিল – সহসা এমনি এক বসন্তের রাত্রে প্রবল বজ্রবিদ্যুৎ সহ অকালবর্ষণ শুরু হয়, এই বাগানেই বাজ পড়িয়া সবকটি কুসুমিত লেবুগাছ একত্রে পুড়িয়া ঝামা হইয়া যায়, এখানকার কয়েকটি পোষা বিড়ালছানার একটি বুঝি পথ ভুলিয়া আসিয়া পড়িয়া বৃষ্টিতে ভিজিয়া কাঁদিতেছিল, তারপর সেটিও সেই বজ্রাঘাতেই মরিয়া যায়|
এরপর আমি আর কিছু বলিবার অবস্থায় রহিলাম না| তবে কি গতরাত্রে যাহা ঘটিয়াছিল তাহা সেই বিগত ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি? লেবুগাছগুলি নিজেদের অন্তিম সুবাসটুকু ছড়াইতে ছড়াইতে চিরতরে বিদায় লইল, বিড়ালছানাটিও বাজ পড়িয়া অকালে মরিল| তাহাদের আজ আর কেহই মনে রাখে নাই| কিন্তু তাহারা ভোলে নাই এই বাগানটিকে, তাহাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ও ক্রীড়াক্ষেত্রটিকে| তাই কি সেদিনও অনুরূপ একটি রাতে তাহারা নিজেদের অন্তিম চরম মুহূর্তগুলি এই ভাবেই জানান দিয়া গেল? তাহারা কি মুক্ত হইতে পারে নাই ? এখনো এই বাগানে মনুষ্যেন্দ্রিয়ের অগোচরে রহিয়া গিয়াছে?
এ সমস্ত ঘটনা sir কে কিছুই বলি নাই| তিনি বলিলেন তিনি ভালোই ঘুমাইয়াছেন| কিন্তু ইহাও জানাইলেন যে সেদিন আর সে স্থানে আমরা থাকিব না – দুদিনের কাজ একদিনে গুটাইয়া সেদিন বিকেলেই যত শীঘ্র সম্ভব কলিকাতা ফিরিতে হইবে| কারণ কিছু জানাইলেন না| তারপর সমস্তদিন অন্যমনস্ক শুষ্ক মুখে বসিয়া রহিলেন এই সদাহাস্যময় মানুষটি | তিনি হঠাৎ কেন মত বদলাইলেন? কিছু কি লুকাইয়া গেলেন তিনি আমার কাছে? তিনিও কি সেরাত্রে কিছু উপলব্ধি করিয়াছিলেন – তাঁহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতেও যাহার ব্যাখ্যা মেলে নাই?
সেরাত্রের কোথা কোনোদিন বিস্মৃত হইতে পারিবনা| কখনো কাহাকেও কহি নাই – কেহই কি বিশ্বাস করিবে? আমারই মাঝেমাঝে অবিশ্বাস্য ঠেকে – সত্যই কি আমি সমস্ত রাত ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম – নাকি সত্যই কিছু ছিল? যদি সারারাত্রি ঘুমাইয়াইছিলাম, তাহা হইলে তোয়ালেখানি কে ঘরে আনিল? আমার আঙ্গুলই বা কাটিল কিরূপে? এসবের কোনো সদুত্তর পাই নাই| এখনো সহসা মনে পড়িলে সর্বাঙ্গ শিহরিত হইয়া উঠে – অনেক ভাবিয়াও সেই ঘটনাগুলির কোনো কিনারা করিতে পারি নাই, কোনো যুক্তিই মেলে নাই আজও| শেক্সপীয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তিটিই মনের অগোচরে বারবার ঘুরিয়া ফিরিয়া আসে –
“There are more things in Heaven and Earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy… “
—-সমাপ্ত—-