আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে রুমেলা। আবাসনের কেয়ার টেকার হারাধন দা কে আগেই বলা ছিল, একটা ঘরের কাজের জন্য সবসময় থাকার লোক খুঁজে দিতে। বিয়ের পর যখন রুমেলা তার স্বামী অরিত্রর সাথে কলকাতায় এলো তখন এই তিন কামরার ঘরেরে জন্য কাজের লোকের দরকার ছিল না। সকাল সকাল রান্না সেরে নিতো, তারপর অরিত্র খেয়ে অফিস বেরিয়ে গেলে তার অখন্ড অবসর। ধীরে সুস্থে ঘরের কাজ সেরে নিয়েও সময় বেঁচে যেত। দুজনের সংসারে কতই বা কাজ থাকে।
অরিত্র পাক্কা সাহেবী মানুষ। স্বল্পহারী,ডাল ,সবজী অতো লাগেই না,ভাতের সাথে একটু বাটার,মাছ ভাজা বা চিকেন দিয়ে দিব্যি খেয়ে নিতে পারে। দুপুরে জুস, স্যালাড বা টোষ্ট দিয়ে অফিসেই কাজ চালিয়ে নেয়। আর কাজের মাঝে দু কাপ কফি।
রুমেলা নিজে একটা জয়েন্ট ফ্যামিলির মধ্যে বড় হলেও সবার হাঁড়ি আলাদা থাকায় কখনো বড় জ্যেঠার ঘরে কখনো ছোট কাকার ঘরের ভাই বোনদের সাথে নানা পদ খেয়ে বড় হয়েছে। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর মাছ, মাংসে রুচি নেই। গা বমি বমি করে, শুক্তো, ছেঁচকি খেতে মন চায়। শরীরের এমন অবস্থায় কেউ না থাকলে সব গুছিয়ে করে উঠতে পারে না।
হারাধনকে তাই কাজের লোক আনতে বলে রেখেছিলো অরিত্র, পিছটান হীন, নির্ঝঞ্ঝাটে এক মহিলা সবসময় যে রুমেলার সাথে থাকবে। সত্যি শহরে কাজের লোকের খুব অভাব এ কদিনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তারা। ছুটির দিনে কাজের জন্য লোককে আনতে বলা হয়েছে।
চা নিয়ে বসতেই কলিংবেল বেজে উঠল, রুমেলাকে থামিয়ে দিয়ে অরিত্র গিয়ে দরজা খুললো। হারাধন নমস্কার করে বললো, একজনকে পেয়েছি আপনাদের কাজের জন্য, দেখুন কথা বলে, পছন্দ হয় কিনা? আর দরদাম করে নেবেন প্রথমেই।
তাকে সরিয়ে দিয়ে ঘোমটা দেওয়া একটা মাঝ বয়সী মহিলা এগিয়ে এসে বললো, পসন্দ হয় কিনা মানে কি, আর দরদাম কিসের লগে, আমি কি হাট বাজারের আলু বেগুন নাকি? টিপে টিপে, বেছে বেছে থলের মধ্যে পুরে নিবে!
রুমেলা তাকে বললো,আপনি ভেতরে আসুন, হারাধন দা আপনি যান, আমরা কথা বলে নেবো। হারাধন চলে যেতে দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসে তাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে।
সে ঘোমটা খানা নামিয়ে থপ্ করে ঘরের মেঝেতে বসে রুমেলাকে বললো ফ্যানটা বাড়িয়ে দ্যান তো, গরমে শরীলডা হাঁসফাঁস করতিসে, হুমম বলে স্পীডটা বাড়িয়ে দেয় সে।
ফ্যানের গতি নিরীক্ষণ করে সে রুমেলাকে বললো, আপনে আরাম করে বসেন, ক’মাস আপনার? এটাই কি পেত্থম নাকি?
থতমত খেয়ে রুমেলা অরিত্রর দিকে তাকালো, অরিত্র মুচকি হেসে তাকে ইশারায় বসতে বলে, মহিলাটিকে বললেন, বলছি আপনার নাম কি? কোথায় থাকেন?
সে তার দিকে ভালোকরে তাকিয়ে বললো, আমার নাম মেনকা, তা নাম আর এখন কোন কাজে লাগে, পাড়ার সব আর চাঁপার বাপ আমাকে চাঁপার মা বলেই ডাকে। চাঁপা তো সাপে কেটে মরেছে কবেই, বকুল, জবা আরো দুটি মেয়ে আছে, তবু আমি সেই চাঁপার মা হয়েই রয়ে গেলাম বলে ঝট করে চোখের জলটা মুঁছে নিলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো,আপনারা আমাকে মেনকা বলে ডাকতে পারেন তবে ঐ মাসি বলে ডাকবেননি, ওটা আমার মোট্টে ভালো লাগে নি। একটু জল দেবেন, গলাটা কেমন যেন শুকনো লাগছে।
রুমেলা জল আনতে গেলো, অরিত্র দেখলো তাকে ভালোকরে। পুরোনো একটা তাঁতের শাড়ি পরা, সাধারণ চেহেরার একটি মানুষ। সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর, কপালে মাঝারি আকারের একটা টিপ, গলায় কালো লাল পুঁতির মালা, হাতে শাঁখা পলা।
রুমেলা জলের সাথে দুটো মিষ্টি নিয়ে এলো। সেদিকে তাকিয়ে সে বললো এসবের দরকার নাই, জলটুকু বলে ঢকঢক করে সবটা খেয়ে নিলো।
তারপর বললো, আমার কি থাকার ঘর আছে? নাকি ঘরের ইদিক-সিদিক পড়ে থাকতে হবে?
-না না একটা ছোটো ঘর আছে সেখানে থাকতে পারবেন।
-ও তাইলে ঠিক আছে, বলতেছি যে বাচ্চা হওয়ার পর কি রাখবেন আমাকে নাকি বউদিদি খালাস হয়ে গেলে চলে যেতি হবে!
-না না তখন তো আরো বেশী লোকের দরকার!
-হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলিছেন তখন কাঁচা পোয়াতি, কচি বাচ্ছা দুজনের জন্য লোকের দরকার।
তা দাদাবাবু কয়খান কাজের কথা বলে নি !
-হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন কি বলবেন?
-কিছু খরাপ মনে করবেননি, আগে যেখানে কাজ করতাম, ও বাড়িটা ভালো ছিলোনি তাই তো ছেড়ে দিলাম। সুযোগ পেলে ঐ লোকটা আমার পেছনে ঘুরঘুর করতো আর বউয়ের সামনে আপনি আজ্ঞে! বুঝলেন তো ওমন ভদ্রলোকের না ,দফারফা শেষ করে চলে এসেছিলাম। আমারে তাই আপনি আজ্ঞে না করলেই ভালো, অভাবে লোকের দুয়ারে কাজ করি, ইজ্জত বিক্রি করিনা।
এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না অরিত্র, রুমেলা সামলে নিয়ে বললো তো কত টাকা নেবে তুমি, মানে কতটাকা দিতে হবে মাইনে!
-দিবেন আপনারা বিচার বিবেচনা কইরে, চাঁপার বাপ তো ত্যাগ দিছে আমারে, পরপর তিনডা মেয়ে বিইয়েছি সেই অপরাধে, বেঁচে বর্তে আছি কিনা সেই খবর টুকু রাখলনি মানুষডা, যাক সুখে থাক, কপালডা মন্দ কারে আর দোষ দিব বলেন দিকিনি। মা তো, বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে যেতে পারিনি। চাঁপা তো মরেই যেন বাঁচিছে,ছোটো দুইটা পড়াশুনা করে, অনেক খরচ! আমার পেট লিয়ে চিন্তা নাই, ও দুটিই তো…
আগে দু’বাড়ি তে রান্নার কাজ করতাম, পাঁচ হাজার পেতাম ।আপনার ইখানে তো ফুল টাইম, দিবেন আট হাজার।
রাজি না হয়ে কোনো উপায় ছিলো না তাদের। তাই অরিত্র বললো কাল থেকে কাজে আসুন তবে। একগাল হেসে চাঁপা বললো থাকার ঘরটা দেখায় দ্যান দিকিনি, ফ্যান ঠিকমতো আছে কি না দেখে নি। দেখে বললো সব তো ঠিকই আছে, তবে ঐ অত্ত মোটা গদিতে ঘুম আসলে হয়! তো চল্লুম, কাল সক্কালেই চলে আসবো, আর বাজারে গেলে আমার জন্য একটু পান সুপুরি নে আসবেন।ঐ একখান নেশা আছে আমার, মুখে একখান পুরে দিলে ক্ষিদা তেষ্টা ভূইলে যাই।
ঘোমটা খানা আরেকটু টেনে চাঁপার মা চলে গেলো। মনে হলো যেন একটা ঝড় বয়ে গেল।
পরের দিন একটা ছোট পোটলা নিয়ে সকাল সাতটার আগে মেনকা এসে হাজির। দরজা খুলতেই একগাল হেসে বললো দাদাবাবু চা খাবেন তো! লাল চা নাকি দুধ চা, বৌদিদি কি উঠেছে? যদি না উঠে থাকে তো ঘুমুক, এ সময় ওটাও দরকার!শরীলডা বিশ্রাম পাক, এসব বলে রান্নাঘরে চলে গেলো।
একটু পরে এক কাপ চা নিয়ে এসে অরিত্রকে দিয়ে বললো নিন চা খেয়ে বাজার যান দিকিনি, শুধু দেখলাম ফ্রিজে কাটা পোনা রয়েছে, আজ ওগুলো রান্না করে নেবো,কাঁচা আনাজ কিছু নেই, শাক পাতা নে আসবেন, রোজ রোজ এতো বাসি মাছ বৌদিদি কে দেওয়া যাবে নি, খেতে চাইলে টাটকা সতেজ খাওয়াই ভালো।পুদিনা পাতা আর কাঁচা আম আনবেন, দু একখান কাঁচা মরিচ দিয়ে বেটে দেবো ,মুখে রুচি আসবে।
রুমেলাকে উঠে পড়তে দেখে বললো, আমি এসে পড়েছি,এখন থেকে আর সংসার নে ভাবতে হবেনি, শুধু নিজের আর পেটের ছাওয়ালের খেয়াল রাখবেন বুঝলেন। রুমেলা ওর কথা শুনে হেসে অরিত্রর দিকে চাইলো, অরিত্র
ফিসফিস করে বললো কড়া দিদিমনির হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি খুব নিশ্চিন্ত। রুমেলা কি যেন বলতে যাচ্ছিলো, চাঁপার মা কে দেখে থেমে গেলো।
চাঁপার মা সত্যি সত্যি পরিবারের একজন যত্নশীলা সদস্যা হয়ে উঠেছিলো। সে না থাকলে পরিবার থেকে দূরে থেকে সবদিক সামলে একটি সুস্থ স্বাভাবিক শিশুর জন্ম দেওয়া সম্ভব হতো না রুমেলার পক্ষে।
আমরা যারা তাদের সাহায্য ছাড়া অচল তারা যদি চাঁপার মায়ের মতো মানুষকে পরিবারের একজন মানুষ হিসাবে ভাবি তবে ক্ষতি কি? ভালোবাসার বিনিময়ে তো ভালোবাসা পাওয়া যায়, তাই না?