অভিমান

অভিমান

সুতপা বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে বালিশে মুখটা গুঁজে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে; আজও তুহিন রাগ দেখিয়ে না খেয়ে অফিস চলে গেল। কোন কথা না বলে, আদর না করে- একেবারে সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষের মতো। ও এরকমই। রাগ হলে একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায়।

সুতপাও ভাবে, সেও তো কম জেদী নয়! বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে। ছেলে বেলা থেকে আদরে মানুষ হয়েছে, রাগ তারও কম হয় না। শুধু ও তুহিনকে পাগলের মত ভালবাসে বলেই নিজেকে ফেটে পড়া থেকে বারবার আটকায়। নাহলে, এই তিন বছর বিয়ে হয়ে তুহিনের এরকম রাগ দেখানো নয় নয় করে পাঁচ বার হলো! সুতপা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেছে।

যখনই এরকম হয়, সুতপার মাথার ভেতরটা দপদপ করতে থাকে, যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যায়। কেউ অবিরাম হাতুড়ি পিটতে থাকে যেন। তখন ওর ভরসা ঘুমের ওষুধ।

মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয় ওর তুহিনের ওপর। এই সামান্য সামান্য ব্যাপারে কেউ কীভাবে এত রাগ দেখাতে পারে? তাহলে কি তুহিনের ভালোবাসাটা মিথ্যে?! তখন খুব ভয় করে ওর। তাই যদি হয় তাহলে ও বাঁচবে কী নিয়ে? তখন মনে হয় যেন একসাথে সব ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিই….

আজও মাথাটা দপদপ করছে ভীষণ। কিন্তু তার থেকেও বেশি হচ্ছে বুকের গভীরে অবিরত অসহ্য কষ্টটা। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি চিৎকার করে কেঁদে উঠি! সব চেপে রাখা যন্ত্রণা যেন বাঁধ ভাঙা নদীর জলের মতো আছড়ে পড়ুক।

বালিশ থেকে মুখটা তুলে নিয়ে খাটের পাশে রাখা টেবিলটার দিকে তাকায়— ঘুমের ওষুধের পাতাটা যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে!!! হাত বাড়িয়ে ওষুধের পাতাটা হাতে তুলে নেয়। একটা ওষুধ বের করে টপ করে মুখে নিয়ে টেবিলে রাখা জলের মগটা নিয়ে ঢকঢক করে জল ঢেলে নেয় গলায়। মগটা রেখে দেয়। কিন্তু ওষুধটা রাখে না।
আজ ওর ভীষণ ইচ্ছে করছে সব কটা ওষুধ একসাথে খেয়ে নিতে। অনেক ঘুম হবে তাই না? মাথার এই অসহ্য দপদপানি, বুকের ভেতর এই কষ্টকর খারাপ লাগা এই সবকিছু এক নিমিষেই দূর করে দেবে তাই না? সব যন্ত্রনার অবসান ঘটিয়ে দেবে, তাই না?

পিছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরেছে সুতপাকে। কিন্তু, চেষ্টা করেও চোখের পাতা খুলে দেখতে পারছে না, ঘুমে ভারী হয়ে আছে যেন। সারা শরীরেও কেমন এক অবশ ভাব! সেই যে বাঁ দিকে পাশ ফিরে শুয়েছিল, সেরকম ভাবেই শুয়ে আছে ও এখনও! চারদিকে কেমন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সন্ধ্যা হয়ে গেল নাকি?! ধড়ফড় করে উঠতে গেল। পারলনা। পিছন থেকে বাঁধনটা যেন আরও জোরালো হলো। একটা চাপা ফোঁপানি কান্নার সাথে সাথে পিছনের মানুষটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো! একসময় হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। আরে এতো তুহিনের গলা! নিশ্চয়ই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। রাগ ভেঙেছে তাহলে বাবুর। এতক্ষণে সুতপার ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কিন্তু, কষ্টও হয়। ওকে শুধু শুধু ভুল বুঝেছিল। ও যদি ভালোই না বাসতো তাহলে এরকম ভাবে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো? সুতপার খুব কষ্ট হতে থাকে। তাই ও ঝট করে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। বেশ হালকা লাগছে শরীরটা। যেন বাতাসে ভাসছে ও!

সত্যিই তো বাতাসে ভাসছে ও? কী আশ্চর্য! ওদের চেনা বেডরুমের প্রায় সিলিং সমান উঁচু থেকে ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে খাটে দু’টো মানুষ- ওর প্রিয় নীলচে ছাপা শাড়ি পরে একটি নিথর নারী শরীর বাঁ পাশ ফিরে শুয়ে আর তার পিছনে তাকে জড়িয়ে ধরে সমানে কেঁদে চলেছে একজন পুরুষ মানুষ। খাটের একধারে ঘুমের ওষুধের একটা ফাঁকা পাতা পড়ে। ওদের দুজনকেই ও খুব ভালো ভাবে চেনে। পুরুষটা তুহিন আর নারীটা ও নিজে!

ওর চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছেনা। গলা যেন বুজে রয়েছে! যেন বোবা হয়ে গেছে ও! ছুটে খাটের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে। তুহিনকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছেনা! গোটা শরীর যেন পাথর হয়ে গেছে। কেউ যেন কোন মন্ত্রবলে ওকে মূক আর স্থবির করে দিয়েছে! প্রচন্ড অস্থিরতায় ছটফট করতে করতে ও ওর গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করতেই হঠাৎ করে নীচে থেকে কে যেন দুটো হাত দিয়ে ওকে টেনে নামাতে থাকে! ভীষণ ভাবে পাগলের মতো ওর পা ধরে নাড়তে থাকে। সুতপা চেষ্টা করেও মাথাটা ঘুরিয়ে দেখতে পারে না! ভারী হয়ে রয়েছে মাথাটা! কোন এক দূর দূরান্ত থেকে কে যেন ওর নাম ধরে ডাকছে! খুব চেনা গলা। ভীষণ চেনা। চোখের সামনের সব দৃশ্যপট যেন হঠাৎ করে বদলে যেতে লাগলো! গাঢ় কালো আঁধার……. আবছা আবছা কুয়াশা… মিহি আলো…

–“সুতপা… একবার চোখ খুলে দ্যাখো সোনা আমার… একটি বার প্লিস একটি বার সুযোগ দাও আমায়…”
সুতপার ঘুম ঘোরটা, নেশাময় আবেশটা আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করেছে তখন যখন ওর কানে আবছা আবছা আলোর মতো ওপরের কান্না ভেজা কথা গুলো প্রবেশ করল। ও আস্তে আস্তে চোখটা খুলে দেখল, ওর পায়ের কাছে একটা মানুষ পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে ওর নাম ধরে অবিরত কত কথা বলে চলেছে।

পা টা একটু নাড়াচাড়া করতেই পায়ের কাছের মানুষ টা বাচ্চা ছেলের মতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে সুতপার দিকে কান্না ভেজা চোখে তাকালো। তুহিন। গালে তিন চার দিনের না কাটা দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল আর চোখের তলায় কালি দেখেই সুতপা বুঝতে পারে লোকটার ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে! কিন্তু, ও বুঝতে পারে না ওর হয়েছে টা কী? ধীরে ধীরে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে ও একটা হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে।

-” সিস্টার সিস্টার জ্ঞান এসেছে এসেছে জ্ঞান এসেছে” বলে তুহিন ততক্ষণে শিশুর মতো চেঁচাতে শুরু করেছে। তারপর, সুতপার মাথার কাছে উঠে এসে বসে ওর মাথায় স্নেহ ভরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। সুতপা পরম তৃপ্তিতে চোখ দুটো বুজে ফেলে। ভাবে, কী ভয়াবহ দুঃস্বপ্নই না দেখছিল ও! একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর, আস্তে আস্তে ওর সব মনে পড়তে থাকে। তুহিনের রাগ করে চলে যাওয়া……ওর মাথা যন্ত্রনায় ফেটে যাওয়া….. কাঁদতে কাঁদতে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়া…. ঘুমের ওষুধের পাতাটা টেনে নেওয়া। এর আগেও তো একটা করে ওষুধ ও রাগ করে রাতের জায়গায় দুপুরে খেয়েছে। কই হাসপাতালে তো ভর্তি হতে হয়নি! তাহলে??? হঠাৎ করে বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো মনে পড়ে গেল, পুরো পাতাটা খেয়ে নেবো কিনা সেই চিন্তা তে ও আবিষ্ট হয়ে ছিল। তাহলে কি চিন্তা মগ্ন অবস্থা তে রাগের মাথায় সব ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল?!

-“হ্যালো মিসেস বোস। কেমন আছো?”
প্রশ্নটা শুনে সুতপার চিন্তায় ছেদ পড়ল। ও মাথা ঘুরিয়ে দ্যাখে, একজন প্রায় ওর মায়ের বয়সী এক মহিলা ডাক্তার হাসি হাসি মুখে ওর দিকে চেয়ে আছে। সুতপা কিছু বলার আগেই উনি তুহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি খুব লাকি মিস্টার বোস। সাত সাতটি ঘুমের ওষুধ, তিন দিন কোমা… এসবের পরেও আপনি আপনার ওয়াইফ কে ফিরে পেলেন! সবার সে কপাল থাকে না। টেক গুড কেয়ার অফ হার।” তারপর, সুতপার দিকে ঘুরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “এত সহজে হেরে যেতে নেই মা। তুমি নারী। এটা মাথায় রেখো।”
তারপর, উনি সুতপাকে চেক করতে লাগলেন।

সুতপার চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। তুহিনেরও চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। অর্ধসিক্ত নয়নে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, দু’জনেরই ভিতরের দুটি অবুঝ অভিমানী শিশু যেন নিজেদের অভিমান ভেঙে একে অপরের বুকে ভেঙে পড়ার জন্য ছটফট করছে। বেডের পাশের জানালার কাঁচ থেকে দেখা গেল, গোটা শহরের মাথার ওপর কালবৈশাখীর কালো মেঘ ঘনীভূত হতে শুরু করেছে। আজ খুব বৃষ্টি হবে বোধ হয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত