দত্ত গিন্নি খুবই চিন্তিত, বেশ কয়েক মাস ধরে তার বড়ো ছেলের বৌয়ের অরুচি শুরু হয়েছে।খাবার খায় না,ওমন লক্ষ্মী প্রতিমার মতো দত্ত গিন্নীর বড়ো বৌ,বড়ো লক্ষ্মী মন্তর মেয়ে।দুই ছেলে গিন্নীর, ছোটো বৌ ছেলের সাথে বাইরে থাকে,ছেলের কর্মস্থলে।সেই বৌ কেও শাশুড়ি খুবই ভালোবাসেন।
দত্ত গিন্নি এখন বড়ো বৌয়ের হাতে সংসার তুলে দিয়ে বেশ শান্তিতেই ছিলো।কাল হলো,বেশ কয়েক মাস যাবৎ বড়ো বৌ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।বাড়িতে,কাজের লোকজন,গিন্নি।মা,বড়ো ছেলে,বৌ,আর এক নাতি,আর এক নাতনি। নাতি কলেজে পড়ে,নাতনি সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিলো।
বেশ সচ্ছল পরিবার,হাসি খুশীতে ভরা।হৈ চৈ….সবই আছে…..কিন্তু বড়ো বৌ কিছু খাচ্ছে না,বলে,অসুস্থ হয়ে পড়ছে,ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।
মাঝে মাঝে বৌয়ের আলতা রাঙা পায়ে হাত বুলিয়ে বলে,’ বৌমা!!! তোর কী হয়েছে,একটু পেয়ারা পাতা চিবোতো,বনমালী কে বলে পেয়েরা পাতা বুড়ি আনিয়ে নিয়ে বৌমা কে খাওয়ায়।পেয়ারা মাখা,আরো কতো কিছু।
সেদিন নাড়ু করতে করতে হাউ হাউ করে কেঁদে লতিকা কে বললো…মেয়েটি আমার খেতে পারবেনি রে!!! আগে কতো কিছু খাবে বলে আমায় আবদার করতো,আমি করতাম আর আমার লক্ষ্মী মা খেতো…বলে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে লাগলো।লতিকা বেশ মুখ বেঁকিয়ে বললো,তোমার ঘরেই শুধু বৌ আছে গিন্নিমা,আর কারোর যেন নেই!! অস্ফুটে বলে উঠলো আদিখ্যেতা দেখলে আর বাঁচি নে।
দাদা বাবু তো একবারও খপর নেই নেকো।শুধু কাজ আর কাজ।রাত করে কোতায় যায় কে জানে??? বিরাট দোকান,সব কিছু সামলাতে হয় বুঝি,কিন্তু রাতে পুরুষ মানুষের বাইরে বেরুনো বাপু আমার ঠিক ঠেকে না।মরুক গে যাক!!!. আমার কী!!! ভাবলেই গা জ্বলে যায়!!!
বড়ো ছেলে গত কয়েক মাস যাবৎ রাতে কোথায় যায় কেউ জানে না।গিন্নি মা শুয়ে পড়ার পর বাড়ি ঢোকে,বৌদি মণিও কিছু বলে না।ছেলে,মেয়েরা নিজেদের পড়াশোনা,নিজেদের বন্ধু বান্ধব নিয়ে আছে।শাশুড়ি আর বৌমা হলো একে অপরের সঙ্গী।
দুএক কথা বলে এখন,সেটাও কমে গেছে।বৌ শুধুই বলে,কিছুই ভালো লাগে না মা।শরীরটা খুব খারাপ লাগে,খেতে ইচ্ছাই করে না।খাবার নাম হলেই বমি পাই আমার মা।
বিকেল বেলার দিকে বনমালী, লতিকা এরা দেখতো,শাশুড়ি,বৌয়ের চুল বাঁধা, আর একটু দুষ্টু মিষ্টি হাসি।এখন সেটাও কমে গেছে।এখন দেখে বৌ শাশুড়ির কাঁধে মাথা দিয়ে চুপ করে বসে আছে। দূরের ঘরের মধ্য থেকে ভেসে আসে গান,ও তার তালে নাচ,আর হৈ চৈ।
….” মন ভালো করবে গো,মন ভালো!!…”
আওয়াজ টা রাস্তা দিয়ে আসছে,গিন্নি কান পেতে শুনছিলো….লতিকা কে বললো…ওকে এখানে ডেকে নিয়ে আয় তো!!! ও কী ধরণের মানুষ দেখি!!! মন ভালো করবে!!!! বলছে,আশ্চর্য তো!!!
একটু সময় পর লতিকার সাথে সাথে ঢুকলো, ময়লা কাপড় পড়া,চুল সাদা কালোয় মেশানো উশকো খুশকো চুল,কাঁধে একটা পোটলা,আরো নোংরা।
দূর থেকেই দত্ত গিন্নির নাকে বিকট বমি পাওয়া গন্ধ এলো,আর মালতি নাকে,মুখে রুমাল দিয়ে আসছে।কী দুর্গন্ধ!!!! গোটা বাড়িতে মনে হয় ছড়িয়ে গেলো।
দত্ত গিন্নিরও নাকে মুখে কাপড় দিতে হলো।তবুও কৌতূহল বশত গিন্নি তাকে দাওয়ায় বসতে বললো।
….বুড়ির প্রথম কথা….” কার মন খারাপ!!!” বলে কেমন ফ্যাঁক ফ্যাঁক করে ফোকলা দাঁতে হাসতে লাগলো।
গিন্নি বললো,মন খারাপ কী না জানি না,তবে….আমার বাড়ির বড়ো বৌমা কয়েক মাস ধরে কিছুই খাচ্ছে না,তেমন কথা কয়ছে না,আর হাসছেও না।
ও তাহলে তো বিচ্ছিরি রকমের মন খারাপ,বুড়ি বললো।
দত্ত গিন্নি সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন,কিচু মনে করবেন নি মা,বলি আপনি কেমনে মন খারাপ ভালো করবেন?!
বাছা বিশ্বাস করতি হবে,একবার সুযোগ দেও আমায়,আমি তোমার বৌমা কে সারিয়ে তুলবো। মালতি শুনে তো অবাক।বলেই ফেললো…তুমি এতো নোংরা,বৌদি মণি তো তোমার কাছে গেলে বমি করে মরবে,কী জানি গিন্নিমা,আমার কেমন সন্দেহ লাগছে।আমি চললুম।
আহা বাছা একটু বিশ্বাস করতে হবে।আমি যা বলবো তাই করতি হবে,রাজী তো!
গিন্নি মা তো বৌ কে ভালো করার জন্য অনেক কিছুই করলেন,কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।তো! এনাকে একটু বিশ্বাস করে দেখি।
দুপুর বেলা,বুড়ি বললো,আমি আর তোমার বৌমা মোটে ৮ ঘন্টা একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকবো।রাত দশটা নাগাদ আমরা বেরোবো,তোমরা এক কাজ করো,বৌমা যা যা খেতে ভালোবাসে সেই খাবার গুলো বানাও।বৌমা বেরিয়ে শাশুড়ি মায়ের কাছে খেতে চাইবে,হুম।বলে দিলুম।
একটা বেশ বড়ো ঘরে,বুড়ি ও বড়ো বৌ বেশ করে নাক চাপা দিয়ে ঢুকলো,দরজা বন্ধ হলো।মালতি এর মধ্যে অনেকবার কান পাততে চাইলো,কিছুই আওয়াজ পেলো না।ছুটে গিয়ে ছেলে মেয়েদের খবর দিতে গেলো,বলি হচ্ছেটা কী তোমরা একটু দেখো,বলে আগা থেকে মুড়ো আরো বেশ বানিয়ে রসিয়ে বললো।ছেলে ও মেয়ে বললো,ঠাকুমা ও মায়ের মধ্যে আমরা নেই,যাও তো।যত্তসব।জুটিয়েও আনে।
এদিকে শাশুড়ি মন দিয়ে অনেক কিছু রান্না করলো,মালতি, বনমালী,রান্নার ঠাকুর সবাই মিলে।অনেক কিছু আয়েজন।মাঝে মাঝেই দত্তগিন্নি দুই হাত জড়ো করে রাধামাধবের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,সব যেন ঠিক হয়ে যায়।ঠাকুর রক্কে করো।বৌমা আমার ঠিক হলে গোটা গ্রামের লোককে ভোজ করে খাওয়াবো,রাধামাধব কে ভোগ দেবো।
রাত দশটা,বড়ো ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশ বার ঘন্টা পড়লো।দরজা খুলে গেলো।সঙ্গে সঙ্গে বড়ো বৌমা শাশুড়ির কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,মা আমার খুব খিদে পেয়েছে,কী করেছো??? চলো খাবো,এই আজ আমরা সবাই মিলে খাবো,তোর দাদামণি কে বলতো আজ আর রাতে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে আমার জন্য পুজো দিতে হবে না।ছেলে মেয়েদের বল মা ডাকছে…
শাশুড়ি তো অবাক।দু চোখে আনন্দের জল।
বুড়িমা বুড়িমা কোথায়!
মালতি দৌড়ে আলো নিয়ে গেলো,সদর।দরজায়!!!বুড়িমা আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।মালতি ডাকলেও সাড়া নেই,আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো বুড়িমা।না,একটুও আর গন্ধ নেই….সব উধাও।
বাড়ির ভেতরে তখন খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা চলছে……অবাক হওয়া,দত্ত গিন্নি,ও বিশেষ করে মালতি বৌমণি কে জানতে চাইলো….তোমাকে কী ওষুধ দিলো গো,হ্যারে বৌ কী করলো তোরে বল তো?খুব জানতে ইচ্ছা করছে!!?
বৌমণি এবার মুখ খুললো….বললো,বুড়িমার ঝুলিতেও দুর্গন্ধ, তবুও উনি বলেন….আমার ঝুলির ভেতর মুখ ঢুকিয়ে বেশ করে বমি কর।গন্ধে বমি হওয়ারই জোগাড়, কিন্তু বুড়ি বললো,তার সাথে তোকে একটা কাজ করতে হবে,অনেক ছোটো থেকে অনেক কিছু দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছিস,বিয়ে হয়ে এসেও পেয়েছিস,যাদের খারাপ ব্যবহার,মন খুলে সেসব বমি কর,আর চিৎকার বলতে থাক,আর দুঃখ, কষ্ট কে উগড়ে দে মা।
আমি ঝোলায় মুখ ঢোকাতেই আমার গা পাক দিলো,ওয়াক করে বমি করতে করতে আমার চাওয়া,না পাওয়া গুলো উগড়ে দিলাম।বিনা দোষে আমাকে ছোটো বলায় একজন চোর বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলো,সেই গুলো লুকিয়ে সব ক্ষতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো,চিৎকার করে বললাম,আমি চোর।নই,চুরি করেছিলো আমার বান্ধবী রিমা।আমি চোর নই।বেশ কয়েক বছর আগে আমাকে আমার নিজের মাসী কয়েকটা কথা শুনিয়ে গিয়েছিলেন,আমি কিছুই বলতে পারিনি,হৃদয়ে কিছু কিছু করে না,প্রকাশ করতে পারা ব্যথা গুলো কালো জমাট বেঁধে
গিয়েছিলো,চিৎকার করে সেই জমাট কালো অন্ধকার কে উগড়ে দিলাম।আরো অনেক কিছুই…..না পাওয়া….সব। তারপরই বেশ হালকা বোধ করলাম।সব গন্ধ কোথায় উধাও।
বুড়িমা,আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন… যাও বাছা,কোনো কিছু কে নিজের অন্তরে জমাট বাঁধতে দেবে না।সোচ্চারে সেটা প্রকাশ করবে,ভয় পাবে না।দেখো তো তোমার খিদে পেয়েছে কী না!?
আমিও দেখলাম,বুড়িমার আর সেই ময়লা কাপড় নেই…সাদা ধব ধবে,গোটা ঘর সুগন্ধিতে ভরা,আনন্দে আত্মহারা হয়ে বেরিয়ে এলাম,তারপর…বুড়ি মা….জানি না তো!
মালতি বলে উঠলো,আমি স্পষ্ট দেখলুম….রাস্তার অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো….
শাশুড়ি আবার বৌমাকে জড়িয়ে ধরে,আদর করে সব প্রিয় খাবার সামনে রেখে খায়িয়ে দিলেন।গোটা বাড়িতে সবার আনন্দের রোল উঠলো। ….হিহিহি,হাহাহা…..আর কত্তো কত্তো ভালোবাসারা ঘুরতে লাগলো বুড়ির সেই সুগন্ধির মতো।