ঠিক রাত নয়টার সময় প্রতিদিন বেল বেজে ওঠে.রুবি জানে এখন আসিফের আসার সময়.এক দৌড়ে সে চলে আসে দরজা খুলতে.আসিফের বাধা .রুটিন- এসেই গোসল তারপর টিভি ….. এর মধ্যেই খাবার খাবার বলে চিত্কার…. খাবার গরম হতেই গাপুস গুপুস করে খাবার খাওয়া,তারপর টুকটাক বাসার খবর নেয়া . রুবির সব জানা, আর গত ৩ বছর আসিফ এর সংসার করতে করতে আসিফ এর মনটা ও ভালই বুঝে ফেলেছে .আসলে খুব সাধারণ আসিফ এর চিন্তাভাবনা.স্বভাবে একটু অলস প্রকৃতির … আশে-পাশের সবাইকে নিয়ে ওর শুধু নালিশ. সেই নালিশ সরকার থেকে শুরু করে শশুর পর্যন্ত বিস্তৃত !
রুবি র চেহারাটা মাঝারির মানের ..মামাবাড়ি থেকে পড়াশোনা করেছে তাই সবার সাথে মানিয়ে চলার অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই নিজের মধ্যে রয়েছে . আর আছে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা সেটা হলো মানুষ কে অবসার্ভ করা, এটা ওর একটা শখের পর্যায়ে চলে এসেছে… এখন ও মানুষ দেখে রীতিমত বই পরার আগ্রহ নিয়ে .
আসিফ যথারীতি একটু কন্সারভেটিভ, তাই খুব একটা বাইরে যাওয়া হয়না. তাই বাসাটাই তার সমস্ত পৃথিবী… বাসার যে কাজের মেয়েটা, সেই তার একটা নতুন বই এর মত. আসিফ অফিস এ চলে যাওয়ার পর রান্নার ফাকেফাকে প্রতিদিনই রুবি কাজের মেয়েটার সাথে হরেক গল্প করে. কত রাজ্যের গল্প তার হিসেব নিলে হয়ত আসিফ অবাক হয়ে যাবে…… রুবির খুব পড়ার নেশা.পেপারটা প্রতিদিন মোটামুটি গেলে সে. বই মেলা এলে সে এই একটা আবদার করবে আসিফ এর কাছে.বইমেলাতে তাকে একবার নিয়ে যেতে হবেই. সারা বছর সে টাকা জমায় ,এই একুশের বইমেলা থেকে কিছু বই কিনবে বলে.আসিফ এর সাধারণ ব্যান্ক এর চাকরিতে এটাই তার একমাত্র বিলাসিতা.
কাজের মেয়েটাকে নিয়ে আজকাল একটু ঝামেলা হছে … এত অলস মেয়ে যে প্রায়ই ঘুম থেকে উঠতে দেরী করে ফেলে ,আর এর জন্য বকা খেতে হয় রুবি কে. আসিফ এমনি তে নিজে প্রতিদিন দেরী করবে কিন্তু যদি একদিন নাস্তা টেবিলে আসতে একটু ও দেরী হয় তাহলে খবরই আছে… চিত্কার করে বাড়ি মাথায় তুলবে. আসলে আসিফ অফিসে বের হয় প্রতিদিন দেরী করে তাই এই দেরী টুকু ওর একদমই ঠিক সহ্য হয় না. আর ব্যান্ক এর চাকরিতে দেরী করাটা খুব ঝামেলার কারণ ও বসে ক্যাশে . আর যদি ক্যাশ ঠিক সময়ে ওপেন না করা যায় তাহলে কাস্টমাররা ক্ষেপে যায় .প্রায়ই ও চেষ্টা করেছে ঠিক করতে বেপারটা, কিন্তু বশে আনতে পারছে না.
রুবি আজ সকালে উঠে দেখে কাজের মেয়েটা এখনো ঘুমাচ্ছে, অথচ এখন বাজে সকাল ৭: ৩০. এখনো যদি না ওঠে তবে কখন রুটি বানাবে আর কখন ভাজি ভাজবে ? খুব বিরক্ত লাগে কাজের মেয়েটার উপর.একটা ধাক্কা দিল মেয়েটাকে. মেয়েটা বলল “আপু আর দুইটা মিনিট!” রুবি চলে গেল… ৫ মিনিট পর এসে দেখে এখনো ঘুমাছে মেয়েটা ! এবার একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল .. আজ ওকে নিশ্চয়ই আসিফ এর বকা খেতে হবে !
আসিফ যথারীতি টেবিলে বসে ইচ্হা মত বকাঝকা শুরু করলো… সধারণত সে এরকম বকা দেয়ার সুযোগ পেলে ছাড়েও না. মুখ বুজে সব মেনে নিল রুবি ! এমনিতেও জানে কোনো জবাব দিলে আসিফ আরো রেগে যাবে…. শুধু একবার মৃদু মুখে বলল “সরি” … শুনে আসিফ যেন আরো রেগে গেল.. “এক ভুল এক বার করলে সেটা ভুল .. প্রতি দিন করলে সেটা অপরাধ” ইত্যাদি ইত্যাদি .. চলতে থাকলো .
আসিফের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল. আজও ওকে মানেজার সাহেব এর কালো মুখ দেখতে হবে… কিভাবে যে এই দেরী করে অফিসে যাওয়ার বেপারটা ঠিক করবে ….ভেবেই পায় না .এক এ ভুল তার প্রতিদিন ! সে নিজে যে খুব দেরী করে ওঠে তা না. কিন্তু অফিসে যেতে দেরী হবেই . সকালে যেন কি একটা ভর করে আসিফ এর উপর কখনো কম্পিউটার নিয়ে বসবে.. কখনো রুবি র বইগুলো ঘাটবে কখনো বা পেপার টা নিয়ে বসবে … পরিনতি অফিসে যেতে দেরী . আজ যখন অফিসে পৌছালো তখন দেখে মোটামুটি সবাই চলে এসেছে .. লজ্জায় মাথাটা নিচু হয়ে গেল.ডেস্কে বসে কম্পিউটার টায় লগিন করলো …..সামনে ১০ থেকে ১২ জন কাস্টমার দাড়িয়ে আছে. নানা রকম কথা ভেসে আসতে লাগলো. যেগুলো পরে মনে হলে ….ভাগ্যকুল এর মিষ্টিকে নিম এর মত তিতা মনে হবে….
সারে বারোটার দিকে ইউসুফ ভাই আসলেন ডেস্ক এ .ইউসুফ ভাই সিনিয়র অফ্ফিসার. মোটামুটি প্রভাবশালী একজন.. অনেকেই ওনাকে বস এর ডান হাত বলে আড়ালে.সেই ইউসুফ ভাই তার কাছে কেন বুঝতে পারছিল না আসিফ .
“আর কত কাজ করবে আসিফ? চল একটু কান্টীন এর দিকে যাই ” আসিফ এর কাছে অবাক লাগলো পুরো বেপারটা…. “জি ইউসুফ ভাই আসতেছি ” বলে উঠে আসল সে.
“তারপর বল তোমার দিনকাল কেমন যাছে ? সাব কুচ ঠিক ঠাক ? ভাবিজান ভালো আছে ?”
“জি ভাই ভালো আছে ”
“ভাবি র সরির খারাপ নাকি ?”
” না তো ! ” জবাবটা দিতে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আসিফ এর …
“তোমার শরীর কেমন ?”
“আমি তো ঠিক আচি ইউসুফ ভাই ..”
“সত্তি ?”
“কেন ভাই ?” জিগ্গেস করে বসলো আসিফ …
“সত্তি কথা বলতে কি ব্রাঞ্চ মানেজার তোমার বেপারে আমার সাথে কথা বলছিলেন … ” “তাই নাকি ? কি বললেন ? ” আগ্রহে জিগ্গেস করলো আসিফ .
“দিনাজপুরে আমাদের ব্রান্চ আছে একটা ওখানে একজন স্কিল্ড অফিসার দরকার. তোমার কথা জিগ্গেস করছিলেন”
“কেন ভাই এখানে আমার কোনো সমসসা হছে নাতো … ”
“কিন্তু ব্রান্চ এর হছে আসিফ. তুমি প্রায়ই দেরী করে আস এটা অফিস এর সবার চোখে লাগছে. ……….আমাকে তুমি খুলে বলবে তোমার আসল প্রবলেম তা কি ?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো আসিফ তারপর মনে হলো মন খুলে অর সমস্সাটার কথা ও বলবে ইউসুফ ভাইকে….
ইউসুফ ভাই বললেন :” আমাকে একদম মন খুলে বল তো মূল বেপারটা কি ?
“আসলে বেপারটা আপনাকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না কিন্তু অবশ্যই চেষ্টা করব.” একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলো আসিফ -“সকালে আমি যে খুব দেরী করে উঠি তা না ইউসুফ ভাই. আমি কিন্তু প্রায়ই ৬ টার দিকে উঠে পড়ি.তারপর যেন কি একটা হয় আমার. নানারকম চিন্তা আসে মাথায় . কখনো টিভি দেখতে বসে যাই, কখনো বই পড়তে বসে যাই ,কিম্বা শুধু পেপার নিয়েই কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা …. একই জিনিস প্রতিদিন.. যা আমি চাই না…….আমি চাই সকালে আসতে. আরো অনেক সিন্সেরেলি কাজ করতে.কিন্তু সকালে আমি যেন কেমন হয়ে যাই……..আমি আমার উপর বিরক্ত হয়ে গেছি ইউসুফ ভাই… প্লিজ হেল্প মি. কথা দিছি আমি চেষ্টা করব চেন্জ হবার জন্য” … এক নিশ্বাসে সব কথা বলে থামল সে..
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো ইউসুফ ভাই কিছুক্ষণ …তারপর হেসে বলল “এটা কোনো সমসসা না আসিফ .. আমার মনে হয় তুমি বেপারটা ওভারকাম করতে পারবে. লেট মি টেল ইউ সামথিং. প্রথমেই তোমাকে ঠিক করতে হবে তুমি কেন চাকরি কর ?আগে তোমাকে বুঝতে হবে চাকরির গুরুত্ব টা . চাকরি টা না থাকলে তোমার কি কোনো প্রবলেম হত ? অবশ্যই হত. তুমি ভাড়া বাসায় থাক না ? তুমি বেতন পাও কত ? ২০ থেকে ২৫ হাজার .. তোমার বাড়ি ভাড়া ১২ হাজার. বাকি যে টাকা থাকে তা দিয়ে তোমাদের দুজনের সংসার হয়ত ভালো করেই চলে যায়.কিন্তু তোমার যদি চাকরি টা না থাকত তাহলে কি হত একবার চিন্তা করে দেখো…বাড়িয়ালা বাসা থেকে নামিয়ে দিত. খাবার কিনতে পারতে না… আচ্ছা তোমাকে এগুলা আমি কেন বুঝাছি ? এগুলো তুমি ভালো করেই জান ! তোমার যেটা দরকার সেটা হলো একটা টু-ডু লিস্ট. ঠিক কখন গোসল করবা কখন খাবা আর কখন রেডি হবা এগুলো টাইমসহ লিখে রাখতে হবে এবং অবশ্যই মেনে চলতে হবে . তোমার কি মনে হয় তুমি চেন্জ হতে পারবা ?”
“অবশ্যই” বলল আসিফ.. আর মনে মনে বলল এগুলো আমি তোর চেয়ে ভালো বুঝতে পারি…. তারপর আরো কিছু এরকম উপদেশ নিয়ে তবে সে ছাড়া পেল. তবে যেটা বুঝলো এবার একটা কিছু করতে হবে… নইলে ট্রান্সফারটা ঠেকানো যাবে না .
সেদিন বাসায় ফিরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিল কি করা যায় ? তারপর কি মনে করে একটা কাগজের টুকরায় লিখল কাল কখন কোন কাজ করবে তার লিস্ট ..দেখা যাক কি হয়…
এর পর আরো দূ তিন দিন চলে গেল. আগের চেয়া কিছুটা ইম্প্রভ করেছে তার অফিস টাইমিং.কিন্তু খুব যে কনসিস্টেন্ট তা না . যাই হোক মন্দের ভালো …
অবশেষে শুক্র বার এলো. সপ্তাহে দুই দিন ছুটি তার খুব ভালো লাগে. প্রায়ই মনে হয় চাকরি টা না থাকলে খুব ভালো হত. এমন না তার যে খুব বেশি টাকা লাগবে .. কিন্তু এই রেগুলার অফিস যেতে তার ভালো লাগে না.
শুক্র বার দুপুরে সে হেব্বি করে লাঞ্চ করে একটা ঘুম দেয় .এইদিন রাতে সে তার বউকে ইছা মত আদর করে .. সকালে দেরী করে ওঠে… দুপুরে গরুর মাংশ খায় .. বিকেলে ঘুরতে যায় আর রাতে থাকে তার মনের মত …. করে…… সেদিন সকালে যথারীতি উঠলো দেরী করে ঘুম থেকে.কিছুক্ষণ পেপার পড়ল চা খেল …তারপর বউ এর পানপানানি তে গোসল করে গেল নামাজ পড়তে .নামাজ পরে এসে ভরপেট গরুর মাংশ আর ভাত খেল. গরুর মাংসটা আসলে একটা মারাত্মক জিনিস এর উপরে মাংশ হয় না ,যাই হোক বিছানায় এলো ঘুমাতে. রুবি সাধারণত দুপুরে ঘুমায় না… গল্পের বই পরে কিম্বা টিভি দেখে.দুপুরে নাকি তার ঘুম আসে না.. কি আর করা একা একাই ঘুমাতে আসল আসিফ. ঘুমে দুচোখ ভরে আসছে তার … এই অনুভুতি টা তার খুব ভালো লাগে.. ভরপেটে দুপুরে যে ঘুমটা দেয় তা তার কাছে খুব সুন্দর একটা সুখের সংগা…….ঘুমে যখন দু চোখ লেগে আসছিল তখন হটাত সে শুনতে পেল…. রুবি তার কাজের মেয়েটাকে ডাকছে … এই ডাকে তার ঘুমটা একটু চটে গেল … রুবি কাজের মেয়েটাকে জিগ্গেস করছিল যে সে খেয়েছে কিনা মেয়েটা বলল “আফা আমি খাইসি”… “শোন তোর সঙ্গে আমার খুব জরুরি একটা কথা আছে. তুই বারান্দায় গিয়ে বস আমি আসছি.” … আসিফ ঘুমের ঘরে সব ই শুনছিল.. তার একটু কৌতুহল হলো. সে কান পেতে থাকলো কি বলে রুবি শোনার জন্য.
“আচ্ছা তোর শরীর কেমন বলত”..
মেয়েটা বললা আফা “ভালোতো”
… কোনো সমস্যা ?
” না আফা “.
তাহলে বল তুই প্রতিদিন সকালে উঠতে দেরী করিস কেন ? চুপ করে থাকলো মেয়ে টা …রুবি র গলার সর হটাত অনেক নরম হয়ে গেল… একরাশ মায়া এনে মেয়েটার থুতনি তা নেড়ে দিয়ে বলল ” সত্তি করে বলত তর কি হয়েছে.. কথা দিলাম তোকে বকা দিব না ..দেখিস না তোর ভাইয়া আমাকে কত বকা দেয় দেরী করে নাশতা বানালে.. অফিস যেতে তো দেরী হয়ে যায় … আমাকে তুই বলবি তোর কি হয় সকালে, কেন দেরী করিস ?
মেয়েটা যেটা জানালো তা হলো, সকালে নাকি তার বাড়ির কথা মনে পরে. সে সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে তার মায়ের কথা, তার বোনের কথা, যে মাঠে মাঠে ঘুরত তার কথা .. মাঝে মাঝে সে কল্পনায় ডুবে যায় দুপুরে যে হিন্দী সিনেমা দেখে তার কাহিনীতে.
“কি যে বলবে রুবি কিছুক্ষণ ভেবে নিল তারপর বলল : “দেখ তুই প্রথমে ভাব তোর এই বাড়ির কাজটা দরকার আছে কিনা ? তুই কাজ শেষে প্রত্যেক মাসে যে ১০০০ টাকা পাস তা যদি না পাঠাতে পারিস বলত তাহলে তোর মা কি খেতে পাবে ? আবার তোর ভবিষ্যতের জন্য…. ….. …” ইত্যাদি ইত্যাদি …
আসিফ কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পেল …মিলটা অবস্য গভীর হবার আগেই তার দূ চোখ গভীর ঘুমে ভরে গেল…