দশটার মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে মলে ঢুকে হালকা টাচ আপ নিলো তানিয়া| আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ওদের প্রসাধনী স্টলটায় শুরু হয়ে যাবে কাস্টোমারদের যাতায়াত|যদিও অন্যদিন সকালের দিকটা ফাঁকা থাকে”|কিন্ত আজ যে ছুটির দিন তাই ওপরমহল থেকে অর্ডার আছে বেশি “অ্যাটেন্টিভ” থাকতে|নাহলে আজকের দিনটাতে ছুটি নিয়েই নিতো| রোজ রোজ ৯-১০ঘন্টা টানা আর পারা যায় !আজকাল বড্ড ক্লান্ত লাগে তানিয়ার সেই মেক আপ করে মেকি মেকি টোনটায় কাস্টোমারদের বোঝাতে| এমনিতেই শপিং মলগুলোতে বেশীরভাগ লোক আসে উইন্ডো শপিং করতে| কেউ কেউ তো সবটা বুঝে শুনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রাইজ ট্যাগটা দেখে বেশ ঝাঁঝালো স্বরে বলে ওঠে , এটা তো অমুক সাইটে এর অর্ধেক দামে পাওয়া যায়|তবু নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যায় তানিয়া আর ওর মতো সেলসগার্লরা যদি এবারের ইনসেন্টিভটা একটু বেশী পাওয়া যায়|পেট যে বড্ড বড় বালাই!
অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই ব্যস্ততা বড়পুকুরপাড়ের হনুমান মন্দিরের পাশের মিষ্টি দোকানটায়|একে ছুটির দিন তারপর আবার মঙ্গলবার|
সকাল সকাল বজরংবলী দর্শনের জন্য মিষ্টি কেনার হিড়িক পড়ে যায় রীতিমত| তারপর এই দোকানের কচুরি ছোলাডাল এচত্বরে সর্বজনবিদিত| সবমিলিয়ে ছোটুদের আজ চরম ব্যস্ততা| এমনিতেই দুপুরের ওই নাওয়া খাওয়ার জন্য বরাদ্দ একঘন্টা ছাড়া দোকান বন্ধ হওয়া অবধি মাথা তোলার সুযোগ থাকেনা ওদের| তবু জ্বর নিয়েও মালিকের হুকুম অনুযায়ী আজ আসতে হয়েছে ছোটুকে|কাল থেকে ছোটুর শরীরটা বিশেষ ভালো ছিলোনা কেমন যেন জ্বর জ্বর মাথাব্যথা| এদিকে সকাল ৭টা থেকে শুরু করে রাত্রি প্রায় ৯:৩০টা অবধি মাথা তোলার সুযোগ থাকেনা|কিন্তু মালিকের কথা রাখতে আসতেই হলো| গ্রামের বাড়িতে মা আর বোনটা যে সারামাস অপেক্ষা করে থাকে এই কটা টাকার জন্য|
স্নান করে মেয়ের জলখাবারটা তৈরী করে রীতিমত ছুটলো অপর্না| আজ ছুটির দিন বলে বৌদি কিটি পার্টি রেখেছে|সব আয়োজনের দায়িত্ব অপর্নারই|এদিকে মেয়েটার ছুটি তাই অপর্নাকে কিছুতেই কাজে বেরোতে দিচ্ছিলো না| কোনরকমে ওকে বুঝিয়ে বাড়ি থেকে বেড়োতে হলো| আসলে অন্যান্য বাড়ি হলে হয়তো এতোটা মাথা ঘামাতোনা অপর্না| কিন্তু বিপদে আপদে এই বৌদিকে সবসময়ে পাশে পায় অপর্ণা|কিছু চেয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে এমনটা হয়নি যে কখনোও|
ছোটবেলা থেকেই বৌ সাজার খুব শখ ছিলো রূপার|দুপুরে মা কাকীমা ঘুমিয়ে পড়লে পুজোর সময়ে টাকা জমিয়ে স্বল্পদামে কেনা সাজের জিনিসগুলো নিজেকে সাজাতে বসতো রূপা|রূপা আজও সাজায় তবে নিজেকে নয় অন্যদের| বাবা মারা যাওয়ার পর পাড়ার মেয়ে বলে লিপিকাদি হাতে ধরে একটু একটু করে তৈরী করেছে বেকার রূপাকে| ব্রাইডাল মেক আপে দিনদিন লিপিকাদির মতই এক্সপার্ট হয়ে উঠছে রূপা| ওর ওপরে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে লিপিকাদি|সেই লাল চেলি বেনারসী জুঁইফুলের মালার ঐ গন্ধটা সবমিলিয়ে নিজের মনের সবটুকু মাধুরী দিয়ে কনে সাজায় ও|আজ চারিদিকে ছুটি ছুটি রেশ দেখে খুব ইচ্ছে করছিলো মায়ের কাছে থাকতে| হঠাৎ লিপিকাদির বলা কথাটা মনে পড়লো–“আজকের ব্রাইডালটা বাঘা কাস্টোমার ভালো করে উৎড়ে দিলে মেটিরিয়ালের দামটা রেখে বাকিটা তোর”| এই এক্সট্রা টাকাটার যে বড় দরকার রূপার|জিনিসপত্রের যা দাম মাইনে থেকে কিছুই বাঁচেনা|আর হাজারটা টাকা পেলেই এমাসে মায়ের জন্য মিক্সিটা কিনে ফেলতে পারে রূপা|আজকাল শিল নোড়াতে বাটতে মায়ের বড্ড কষ্ট হয় যে|
চরিত্রগুলো হয়তো খুব চেনা আমাদের| হয়তো আমরাই লুকিয়ে আছি প্রতিটা চরিত্রের মধ্যে| কোথাও বিরক্তি,কোথাও কৃতজ্ঞতা,কোথাও শুধুই চাকরি বাঁচানোর তাড়না ,কোথাও আবার সুপ্ত বাসনা সবমিলিয়ে জীবনে শ্রমটাই বোধহয় মুখ্য হয়ে ওঠে| আপাতদৃষ্টিতে হয়তো ‘শ্রমিক’ শব্দটার আওতায় আমরা সবাই পড়িনা কিন্তু শ্রমের বিনিময়ে ঘন্টা দিনের হিসেব ভুলে কিনে আনি কাছের মানুষটার হাসি বা অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো|আজকে আমাদের কয়েকজনের কাছে একটা ছুটির দিন, কাউকে আজো ব্যাগ কাঁধে ছুটে যেতে হয়েছে নিজের কাজের জায়গায়| যদি আজ বিকেলে শপিং মলটায় আপনার দ্যাখা হয়ে যায় তানিয়ার সঙ্গে, কিংবা সকালে জলখাবার কিনতে যান ছোটুদের দোকানে বা অপর্ণা এসে নিজের হাতের ছোঁয়ায় হাসি ফোটায় আপনাদের মুখে বা ধরুন রূপার হাতে সাজতে গিয়ে একটু এদিক ওদিক হয়ে যায় আপনার সাধের মেক আপটা| চলুন একটু সহানুভূতিশীল আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করি নিজেদের মনের ভাষাটা|মনে রাখবেন দিনের শেষে আমরা সবাই আসলে গোটা সিস্টেমটার শ্রমিক| যে সিস্টেমটায় ধুকপুক করে সময়ের হিসেব কষছে আপনার আমার রুজিরোজগারের হৃদযন্ত্র|
(সমাপ্ত)