বৈশাখ মাস, তপ্ত দুপুর, খুব তেজ রৌদ্রের। প্রখর রোদে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পুড়ে যাচ্ছে যেন স্বপ্নার সারা গা, তিন বাড়ির ঠিকে কাজ শেষ করে যখন বাড়ি ঢুকলো তখন ঘড়িতে প্রায় ১২টা বাজতে চললো।
উঠানে আসতেই দেখতে পায় চার বছরের শিশুকন্যা রিংকী পাশের ভাড়াটে ঘরের বাচ্চা বক্লুর সাথে খেলছে, স্বপ্না আর বক্লুর মা মিনতি কাজে চলে গেলে বক্লুর ঠাম্মা বক্লুর দেখাশোনার পাশাপাশি রিংকী কেও চোখে চোখে রাখেন।
স্বপ্না কে আসতে দেখেই রিংকী খেলা ছেড়ে ছুটে গেলো মায়ের কাছে। স্বপ্না রিংকী কে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করলো, “তুই দাদা কে বিরক্ত করিস নি তো?”
রিংকী বললো, ”না মা, দাদা তো শুয়ে আছে, আমি যন্ত্রনা করিনি”।
স্বপ্না বললো, “অনেক্ষন ধরে খেলছিস নাকি রে? খিদে পেয়েছে তো মনেহয়, তোর ঘোষ জেঠি আজ ডাল, তরকারি, মাংস দিয়েছে তোদের জন্য, আমি স্নান করে এসেই তোদের ভাই বোন দুটো কে খেতে দিচ্ছি, কেমন?”
রিংকী ঝট করে কোল থেকে নেমে বললো, ”না মা, আঙ্গুর খাবো, আঙ্গুর কিনে দাও না, বিশু কাকু (বক্লুর বাবা) নাকি কাল মিষ্টি মিষ্টি টসটসে আঙ্গুর এনেছিল বক্লুর জন্য, আমায়ও দাও না মা।”
স্বপ্না বললো, ”আচ্ছা আচ্ছা, এখন রান্তুর কাছে যাই, দেখি ছেলেটা কেমন আছে”। স্বপ্না ঘরে এসে আধ ঘুমে থাকা পুত্র রান্তুর মাথায় হাত দিয়ে দেখলো গা টা এখনও গরম, জ্বর ছেড়ে যায় নি পুরোপুরি। রান্তু এক প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, আজ শরীর ভালো নেই তাই স্কুল কামাই করেছে। স্বপ্না ভেবেছিল আজ কাজে যাবে না কিন্তু না গিয়েও উপায় ছিল না যে, ঘোষ বাড়িতে আজ ভোজের আয়োজন ছিল, ঘোষ গিন্নি আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন স্বপ্না যেন কাজে যায়, অগ্যতা….
রান্তুর মাথায় হাত বুলিয়ে স্বপ্না পাশেই রাখা ছোট টেবিলের দিকে চেয়ে দেখলো ঔষধ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আঁচলে বাধা টাকা গুলি নিয়ে গুনে দেখলো আর সামান্য কটি টাকা অবশিষ্ট আছে… সহসা মনে পড়লো ঔষধের সাথে আপেল, কলা, আঙ্গুর, বেদানা, এসবও তো খাওয়াতে হবে, তবে না রান্তু তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। কিন্তু এই গুটি কতক টাকায় কি করে… স্বপ্না হারিয়ে যাচ্ছিল স্মৃতির গভীরে, রান্তুর বাবা থাকতে এতোটা অভাব ছিল না সংসারে, কিন্তু অসময়ে রান্তুর বাবার মৃত্যু টা কাল হয়ে দাড়িয়েছে স্বপ্নার জন্য। দু – তিন বাড়ি কাজ করে যা পায় তাতে ঘরভাড়া আর খাওয়া-পরা তেই প্রায় সব শেষ হয়ে যায়। ঘোষ গিন্নি কে বললে উনি কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন ঠিকই, কিন্তু বারবার টাকা চাইতেও স্বপ্নার বড্ড বেমানান লাগে।
রিংকী আবার স্বপ্নার আঁচল ধরে টানতে টানতে বলতে লাগলো, “মা আঙ্গুর খাবো”।
স্বপ্না বিচলিত হয়ে বললো, “তোর জন্যে মাংস এনেছি না? তুই মাংস খাস, আর আঙ্গুর আপেল কমলা এসব তো অসুস্থ হলে পরে খায় রে পাগলী, বক্লুর ঠাম্মার তো শরীর টা ভালো যায় না সবসময় তাই বিশু দা আঙ্গুর এনেছিল। তোর বাবা থাকতেও তো তোদের কে কত ফল মূল এনে খাওয়াতো অসুস্থ হলে, তোর মনে নেই” ?
রিংকী বললো, ”অসুস্থ! মানে দাদা খেতে পারবে আঙ্গুর” ?
স্বপ্না জড়বৎ বসেছিল রান্তুর পাশেই, ভাবছিল ঘোষ গিন্নির দেওয়া ডাল তরকারি তে আজকের দিন টা তো চলে যাবে, এখন এই গুটি কতক টাকায় ছেলেটার জন্য ঔষধ আনবো না দুটো ফল না কালকের জন্য সবজি! স্বপ্না কে চুপ থাকতে দেখে রিংকী আবার জিজ্ঞেস করলো, “ও মা! বলো না, দাদা খেতে পারবে আঙ্গুর” ?
স্বপ্না বাচ্চা মেয়েটির কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য সংক্ষিপ্ত ভাবে বললো, ” হ্যাঁ “।
সহসা রিংকী ডাকলো, ”মা”??
স্বপ্না রিংকীর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললো,” হ্যাঁ, বল…”
রিংকী জিজ্ঞেস করলো, ” কি মজা হবে না বলো, দাদার মতন আমিও অসুস্থ হয়ে পড়লে আঙ্গুর খেতে পারবো, তাই না? মা আমি কবে অসুস্থ হবো? বলো না, ও মা, কিগো, বলো না, মা…..”