এক
গত রাতে পুকুর পাড়ে বকুল গাছটির তলায় একা বসেছিলাম আর ছোট বেলার নানা কথা ভাবছিলাম। চাঁদের সামান্য আলো ছিল। সে আলোতে দেখতে পাচ্ছিলাম বকুল গাছটির তলায় বকুল ফুলগুলো সবুজ ঘাসের উপর পরে আছে। গাছের তলার ফুলগুলো কত দিন ধরে পরিষ্কার হয়না কে জানে।
পনের বছর পরে এখানে আসা। তাই একটু অনমনে হয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের ভেতরে প্রচন্ড গরম। এখানেই একটু আরামে ছিলাম। ভাবছিলাম ছোটবেলার কোন বন্ধু থাকলে চুটিয়ে গল্প করা যেত।
নানা কথা ভাবতে ভাবতেই বেশ কিছুক্ষন ধরে আমার নজর পুকুর পাড়ের দেয়াল ঘেসে একটা জায়গায় আটকে ছিল। মনে হচ্ছে কেউ যেন ওখানে চুপ করে বসে আছে। আমি সামনে এগিয়ে যেয়ে ডাকলাম। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলামনা। পেছনে আমার দাদীমা ডাক শুনতে পেয়ে বললেন, “কাকে ডাকিস দাদু? আয়, ভেতরে আয়, ভাত খাবি”। আমি দাদীমার কথায় পেছনে চাইলাম, তারপর আবার সামনে চাইলাম। কিন্তু এবার কাউকে দেখলামনা। আমি ভাবলাম চোখের ভুল হয়তবা। তাই আগের জায়গায় ফিরে আসলাম।
কিছুক্ষন পরে কাউকে আমার দিকে আসতে দেখলাম। আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছিলনা। তরপরেও আমার মনে হল যে আসছে সে খুব বেশী বয়সের নয়। ছোট একটা ছেলে এত রাতে কিভাবে আমাদের বাগানে ঢুকল তাতেই আমি আশ্চর্য হলাম। আমি দাড়োয়ানকে ডাকতেই সেই ছেলেটিকে আর দেখা গেলোনা। দুই দুইবার এইরকম চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে যাওয়ায় আমার কিছুটা ভয় লাগল। গা ছম ছম করে উঠল। কিন্তু এই বয়সে আমি নিশ্চয় ভূতের ভয় পাইনি।
দাড়োয়ান এসে চলে গেল। আমিও একা বসেই এর রহস্য বের করার চেষ্টা করতে থাকলাম। চারদিকে দেখতে লাগলাম ছেলেটি যাতে কোন মতেই নজর না এড়ায়। বেশ কিছুক্ষন এভাবেই কেটে গেল। কিছুই হলনা। আমিও মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর ঘরের ভেতরে চলে গেলাম।
রাতের খাওয়া সেরে ঘুমোতে গেলাম। কিছুতেই ঘুম আসছিলনা। তার উপর কারেন্ট চলে গেল। আমিও ঘর থকে বাইরে বেড়িয়ে বাগানে আসলাম। বাগানে এসেই প্রথমে দেয়ালের কোনে আমার চোখ পরল। সেখানে কিছুই দেখলামনা। বাগানের চারদিকে দেখতে দেখতে অবশেষে বকুল গাছের তলায় আমার চোখ পরল। এবারে আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। কিছুক্ষন আগে যে ছেলেটি দাড়োয়ান ডাকায় চলে গিয়েছিল সে আবার ফিরে এসে বকুল গাছের তলায় বসে থলেতে ফুল ভরছে। ব্যপারটা পুরোপুরি বোঝার পর আমার ভূতের ভয় অল্প কাটল। আমি বরং আশ্চর্য হতে লাগলাম এতটুকু ছেলের এত রাতে ফুল নেবার হেতু কি! আমি এখানে এসেছি সে তা টের পায়নি। পেছন থেকে একটু রাগত স্বরে বললাম, “এই ছেলে, এত রাতে এত কষ্ট করে ফুল চুরি করার কি প্রয়োজন ছিল! সকালে আমাকে বললেই পারতে”। তারপর দেখলাম ছেলেটি আমার দিকে একবার ফিরল তারপর আবার ফুল নিতে ব্যস্ত হয়ে পরল। আমি একটু আশ্চর্য হলাম। অচেনা একজন লোক পেছন থেকে বকাবকি করছে অথচ সে কোন পাত্তাই দিলনা। আমার ধমকানোর আওয়াজ পেয়ে দাদু বাইরে বেড়িয়ে এলেন। আমাকে ডেকে বললেন, “দাদু এত রাতে বাইরে কাকে ধমকাচ্ছিস, বাইরে আর কাউকেতো দেখছিনা”। দাদু বৃদ্ধ বয়সে না দেখলেও আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ছেলেটির মায়াবী চোখদুটো আমার দিকেই চেয়ে আছে। ওকে আমার কাছে অনেক চেনা মনে হল। আমি ছেলেটিকে ডাকতে যাব ঠিক তখনি সে পুকুর পাড়ের দিকে দৌড় দিল। তারপর হাড়িয়ে গেল। পেছন থেকে দাড়োয়ান আমাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “বাজান, আপনারে এইখানে আসতে আমি নিষেধ করছিলামনা, তাও আসছেন!”
দুই
পনের বছর আগেও বকুল ফুল নেবার জন্য আমি এই পুকুর পাড়ে আসতাম। তবে নিজেদের গাছের ফুল নিজেই চুরি করতাম। একটা সময় এখানে কত আনন্দ করতাম, সবচেয়ে বেশী পলাশকে মনে পড়ছিল। ওর জন্য একটা বকুল ফুলও গাছের তলায় থাকতনা।
আমার দাদা সমির মৃধা কাউকেও ফুল নিতে বা চুরি করতে দিতেননা। সেজন্য প্রতিদিন সকাল বেলায় বারান্দায় বসে থেকে গাছ পাহারা দিতেন। এত সাবধান থাকার পরেও পলাশ প্রতিদিন ফুল চুরি করতে আসত। আর কিছুনা কিছু ফুল নিয়ে যেতই। আমার দাদাও চেষ্টার ত্রুটি করতেননা ওকে ধরবার জন্য। কিন্তু পলাশ অত্যন্ত চালাক ছিল। সে ধরা দিতনা। কোন এক কারণে দাদা বাগানের চারপাশে মজবুত দেয়াল দিলেন। আর তাতেই পলাশের ভেতরে ঢুকা বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর দেখতাম পলাশ আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করে। একদিন সকাল বেলায় কোন এক সুযোগে সে বাগানে ঢুকে পরে। সেটা আমার দাদার চোখে পরে যায়। দাদা দাড়োয়ানকে দেখতে না পেয়ে আমাকেই ডাকেন ওকে ধরবার জন্য। আমি কাছে আসতেই ও দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়। আমি তখন ওকে বাগে না পেলেও স্কুলে যেয়ে ঠিকই ওকে ধরে ফেললাম। তারপর বন্ধুদের দিয়ে কিছু উত্তম মাধ্যম দিলাম।
এ ঘটনার কয়েক দিন পর মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে ফুটবল একটি বাড়িতে চলে যায়। আমি ফুটবল আনতে সে বাড়িতে ঢুকি। বাড়ির ভেতরে যেয়ে একটি ছোট্ট মেয়ের কন্ঠের শুনতে পাই। সে তার ভাইকে ডেকে বলছে, “দাদা ভাই, আজকেও আমাকে বকুল ফুলের মালা গেথে দিলেনা”। পেছন থেকে দেখলাম পলাশ আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে। আমি ভয় পেলাম, একা পেয়ে প্রতিশোধ নেবে নাতো আবার! কিন্তু সে আমাকে কিছুই বলল না। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ওর ছোট্ট বোনটির পাশে বসাল। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি বুঝলাম মেয়েটি তার ফুটফুটে সুন্দর মুখটি দেখবার ক্ষমতা রাখেনা। পলাশ তার এই জম্মান্ধ বোনটির শখ মেটাতেই প্রতিদিন এত বিপদ উপেক্ষা করে আমাদের বাড়িতে ফুল চুরি করতে আসত। আমার নিজের অপরাধের জন্য বারবার ওর কাছে ক্ষমা চাইলাম। পলাশ শুধু আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোর কি আমার মত ছোট একটা বোন আছে?” আমি উত্তরে শুধু মাথা ঝাকালাম। তারপর সে আমাকে খুব বিনয়ের সাথে তার বন্ধু হিসেবে গ্রহন করল। সেই থেকে আমি প্রতিদিন ওকে বকুল ফুল দিতাম।
এভাবেই আমাদের বন্ধুত্তের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। আমাদের বাড়ির ধরাবাধা নিয়মের বাইরের পৃথিবীটা কত সুন্দর তা পলাশের সাথে থেকে শিখেছিলাম। কিন্তু আমাদের এই দিনগুলো বেশীদিন স্থায়ী হলনা। পারিবারিক কোলাহলের জের ধরে আমার বাবা আমদের নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমালেন। তারপর থেকে পলাশের সাথে আমার যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ। আমি প্রতি সপ্তাহে ওর কাছে চিঠি লিখতাম, কিন্তু একটিও উত্তর পেতামনা। কারন আমার খেলনা চিঠিগুলো ডাকবাক্সের মধ্যেই পরে থাকল। পরে আমি শুনে ছিলাম, আমারা দেশ থেকে চলে আসার সপ্তাহ খানেক পরেই পলাশ হাড়িয়ে গেছে, ওকে আর খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা।
তিন
পুকুর পাড়ের বকুল তলায় বকূল ফুল গুলো এখনও সবুজ ঘাসের উপরে চাদরের মত বিছিয়ে পরে থাকে। পেছনে বারান্দায় বসে সমির মৃধা তার পাকা দাড়িগুলোতে হাত বোলাতে এতটুকুও ভোলেননা। কিন্তু ফুল চোর তাড়াতে ব্যবহার করা সেই লাঠিটা আর তার সাথে আর নেই। সেটার আর প্রয়োজন হয়না। কারন আগের মত কেউ আর চুপ চাপ দেয়ালের পাশে লুকিয়ে বসে ফুল চুরির পাঁয়তারা করে না। পলাশ যে আর বেঁচে নেই।
সেদিনের সেই ঘটনার পরে আমি দাড়োয়ানকে পলাশের ব্যপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। দাড়োয়ান আমার কাছে অনেক অনুরোধ করে বলেছিল আমি যেন কাউকে এই ঘটনা না বলি। কিন্তু আমি মুখ বন্ধ করতে পারিনি। রাতের বেলায় সে ঘটনা শুনেই দৌড়ে আমি বের হয়ে যেয়ে দেখি সেই ছোট্ট চেনা ছেলেটি পলাশ ছাড়া আর কেউ নয়। সে সেই আগের মতই একটা একটা করে ফুল উঠিয়ে নিচ্ছে তার ছোট্ট বোনটির জন্য। হয়তবা তার সে অন্ধ বোনও তাকে ভুলে গেছে কিন্তু সে ভোলেনি। রাতের বেলায় ফুল নিতে এসে আমার দাদু সমির মৃধার তাড়া খেয়ে পুকুরে পরে গিয়ে সাঁতার না জানার কারনে পলাশের মৃত্যু হবার পর এখানে এমনটি হয়ে যাচ্ছে। আমার নিষ্ঠুর দাদা ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্য ওর লাশটি বকুল তলেই পুতে ফেলে। সেই থেকে পলাশ নিখোজ।
পনের বছর পরে এই ঘটনা যানার পর আমি আমার নিষ্ঠুর দাদার কাছে জনতে চাইলাম, কী লাভ ছিল ছেলেটিকে দিনের পর দিন তাড়িয়ে দিয়ে? আজ তোমার ফুল নিতে কে আসে? পবিত্র এই ফুলগুলো ঘাসের উপরে পরে থেকে পচে দুর্গন্ধ বের হবার চেয়ে নিষ্পাপ জম্মান্ধ একটি মেয়ের হাতেই বেশী মানাতনা! পলাশ মারা যাবার পর ওর সে ছোট্ট আদরের বোনটি কী কান্নাটাই কেঁদেছিল। তুমি ওর বাবা মায়ের কাছে, সারা পৃথিবীর শিশুদের কাছে কি জবাব দিবে? ঝরে যাওয়া অল্প কয়টি ফুলের জন্য তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পার? এই কৃপণতা করে কি থাকল তোমার জীবনে? তুমিত আজ শুধু নিজেই নিজেকে নিয়ে আছ। সবাই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
ও বন্ধু আমার, আমি তোমাকে ভুলেছি, কিন্তু তুমি ভোলনি। আমাকে দেখে এতটুকুও ভয় পাওনি। চলে যাওনি। বকুল তোমাকে ভোলেনি, সে প্রতিদিন তোমাকে স্নিগ্ধ সৌ্রভে সিক্ত করে যাচ্ছে। আজ থেকে তোমায় সবাই মনে রাখবে। ইতিহাসের পাতায় রচিত হবে ফুল আর নিষ্পাপ বোনের তোমার প্রতি ভালবাসা।