ছোটবেলা থেকেই আমরা চার ভাইবোন ভীষণ বইপোকা-মাকড়। ভাইয়া বিশ্বসাহিত্য ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি এর সদস্য হওয়ায় প্রতি সপ্তাহেই দু’টো করে বই পড়ার সুযোগ পেতাম আমরা। একটা থাকত উপন্যাস, আরেকটা রাজা-রাণীর বই (আমার জন্য)। আমার মেজো আপু ছিল হুমায়ুন আহমেদের অন্ধভক্ত। যেখান থেকে পারত যেভাবে পারত, সে হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ত, আর কিছু নিজের সংগ্রহে রাখত। সে তার এই প্রিয় লেখকের ১৮৪টা বই পড়েছে! যাই হোক, একটা সময় এই হুমায়ুন সাহেবের প্রতি আমার ভীষণ রাগ ছিল। কারণ আপু তার একটা বইও আমাকে পড়তে দিত না, ধরতে পর্যন্ত দিত না। বলত এগুলো নাকি বড়দের বই! আমার যে কি রাগ লাগত! বই তো বইই, বড়দের বই আর ছোটদের বই আবার কি? আমার জন্য রূপকথার বই আনলে সেগুলো তারা নাক ডুবিয়ে পড়ে, আর এই মহাজনের বই আনলে কিনা আমাকে সেটার প্রচ্ছদ দেখারও সুযোগ দেওয়া হয় না। এটা কোনো কথা?
আপু বইগুলো পড়ার সময়ে খুবই সাবধানে থাকত যেন আমার হাতের স্পর্শেও না আসে, এতোটাই সাবধানতা অবলম্বন করত যে সেটা পড়ার পর প্যাকেটিং করে ব্যাগে ভরে সেলফের উপর উঠিয়ে রাখত যেখানে আমার পুঁচকি হাত সহজে পৌঁছাবে না। অন্যদিকে ভাইয়া এতোটাই অসাবধান ছিল যে, বই পড়তে পড়তে মুখের উপর বই রেখে হাঁ করে ঘুমিয়ে যেত!
আপুকে জিজ্ঞেস করতাম, “আপু আমি এই বইগুলো কবে পড়তে পারব? কবে আমি বড় হব?”
আপু বলত, “ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর।”
আমি আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ভেবে পেতাম না, কিভাবে ম্যাট্রিক দেয়ার পর আমি চট করে বড় হয়ে যাব? হুমায়ুন আহমেদের বইয়ে এমন কি আছে যে ছোটরা পড়তে পারে না, আর বড়রা পড়ার জন্য পাগল হয়ে যায়! বইয়ের মধ্যে আবার ছোট-বড় এর কোনো ব্যাপার থাকে নাকি! মনের আক্রোশ থেকেই হোক বা আপুর এতো সাবধানতার জন্যই হোক(!), তাঁর বই পড়ার জন্য ভীষণ জিদ জন্মালো মনে। যেভাবেই হোক আমার একটা বই পড়তে হবে, জানতে হবে বইয়ের ভেতর কি লেখা আছে! আপু যখন পড়াতে যেত, চেয়ার নিয়ে সেলফ থেকে বইয়ের প্যাকেটগুলো নামাতাম, নামিয়ে বই পড়ে সুন্দর করে প্যাকেট করে আবার সেলফে রেখে দিতাম। আপু বুঝতেও পারত না। প্রথম বইটি পড়েছিলাম সেটি ছিল “ময়ুরাক্ষী।” নামটা বেশ আকর্ষণ করেছিল আমাকে। তারপর পড়লাম “কুটু মিঞা।” এর প্রচ্ছদ দেখে যেই ভয় পেতাম বাপরে! (এই বিটলামিটুকু এখনও আপু জানে না, জানলে আমার ব্যাকপেইনের মেডিসিন খেতে হবে।)
অইটুকুন বয়সে বইগুলো পড়ে আর কিছু না বুঝলেও এটা বুঝতাম যে, এগুলো আসলেই বড়দের বই। রাজা-রাণীর কাহিনীর মত এতো সহজ না যে চট করে বুঝতে পারব। সেই উদ্ভট কাহিনীগুলো বুঝার জন্য হাই লেভেলের মস্তিষ্ক প্রয়োজন। তাছাড়া, সেগুলো চুরি করে লুকিয়ে পড়তাম বলে এত্ত বুঝে বুঝে পড়ার সময় থাকত না।
হুমায়ুন সাহেবের প্রতি আমার এতই জিদ ছিল যে আপু যখন বইগুলো পড়ার সময় বই রেখে অন্য কোনো কাজে যেত, আমি বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাপাল্টা করে রেখে দিতাম। আপু যখন আবার পড়তে বসে দেখত কাহিনী খাপছাড়া তখন আবার কষ্ট করে বই ঘেঁটেঘুঁটে সেই পৃষ্ঠা বের করত। তখন ওর এই বিব্রতকর অবস্থা দেখে আমি যে পৈশাচিক হাসি হাসতাম মনে মনে! শান্তি লাগত কলিজায়।
গল্পের বইয়ের থেকে ছবি সংগ্রহ করার দারুণ শখ ছিল আমার। বিভিন্ন চোখ ধাঁধানো রঙিন সব চমৎকার ২০-২৫টা ছবি জমিয়েছিলাম আমি। সেদিন স্কুলে ছিলাম। আপু ঘর ঝাড়ার সময় আমার সমস্ত কাগজপত্রের (বগাজগা কিছু ছড়া-গল্পের পাণ্ডুলিপি!) সাথে সেই সংগ্রহ করা ছবিগুলো ছাদে ফেলে দিল পুরনো জিনিসের সাথে। স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি এই অবস্থা, তার উপর ঘায়ের মধ্যে পাঁচফোড়ন। বৃষ্টি এসে সব কাগজ ত্যানা-ত্যানা হয়ে গেছে। নাকের সর্দি মুছে টিস্যু ফেললেও এমন হালত হয় না, সেখানে আমার এতো সাধ করে জমানো ছবিগুলোর এমন করুণ দূর্দশা দেখে আপুর উপর রাগ আর সামলাতে পারলাম না। বড়বোন, না পারি কিছু কইতে, এদিকে না পারছি সইতে। রাগে কটমট করতে করতে দৌড়ে নিচে নেমে সেলফ থেকে তার হুমায়ুন সাহেবের বই নামিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম পাশের বাড়ির প্রেসের চিপায়। সাথে সাথে এতো শান্তি লাগল, আহা! পোড়া দিলের জখমটায় যেনো কেউ স্যাভলন লাগিয়ে ঠাণ্ডা করে দিল। তখনই পিছনে ঘুরে দেখি আপু আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কপালে সেদিন ৭নং মহাবিপদ সংকেতে টর্নেডো ছিল। এই ঝড়ের কবলে পড়ে আমি শান্তি পাই বা না পাই, আম্মু আমাদের অবস্থা দেখে সেদিন খুব মজা পেয়েছিল। খিকখিক করে হাসছিল।
পরিশিষ্ট: পরে আব্বু গিয়ে সেই পরিত্যাক্ত জায়গা থেকে বইগুলো তুলে এনেছিল। দুঃখের বিষয় বইগুলো অক্ষত ছিল।