“ভাবি আপনি আমার বাচ্চাকে ছোঁবেন না,আপনার তো বাচ্চা নেই না জানি কখন আমার বাচ্চার উপর আপনার বদ নজর লাগে।
এটা বলেই আমার কোল থেকে বাচ্চাটি ছিনিয়ে নিলো আমার ছোট জা।
কথা টা শুনেই আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম!চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছিলো শুধুই,কথাটা তীরের মতো এসে আমার হৃদয় টা রক্তাক্ত করে দিয়েছে,আচ্ছা আমার কি ইচ্ছে করেনা আমার একটা ছোট্ট জিবন্ত পুতুল থাকুক,হেসে খেলে মাতিয়ে রাখুক আমার রাজ্য টা,মা বলে ডাকুক আমায়!কিন্তু উপর ওয়ালা বলে তো একজন আছেন যিনি যাকে খুশি সন্তান দান করেন আর যাকে খুশি নিঃসন্তান রাখেন!ওনি হয়তো আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিচ্ছেন তাইতো বিয়ের সাত বছর পরেও মা হতে পারিনি।
আমার সন্তান নেই বলে আমার শশুড় বাড়ির সবাই আমাকে কথা শুনাতে একটু ও ছাড়েনা,প্রতি পদে পদে অপমান করে আমায়,আমি নাকি অপয়া,তাই নাকি আমি মা হতে পারছিনা,কিন্তু আমার স্বামী আবির এই নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগ করেনি,তার ভালোবাসায় একটু ও কমতি ছিলো না,সব সময় সাপোর্ট করে এসেছে আমায়,হয়তো এই মানুষটার জন্যই একটু শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারি।
.
আজ কেমন জানি খুব ভিষন্ন লাগছে,কোনো কাজেই মন বসাতে পারছিনা,হঠাৎ আমার শাশুড়ি মা এসে বললেন
–বউমা,আবির অফিস থেকে আসলে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও তো,তার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।
–আচ্ছা মা পাঠিয়ে দিবো।
ওনি এটা বলেই নিজের রুমে চলে গেলেন,আমার বুকের ভিতর টা ধ্ক করে উঠলো!কি বলবেন ওনি আবির কে??এক অজানা ভয়ে আতঙ্কিত হচ্ছি আমি!তার কারণ ও আছে অবশ্য তারা প্ল্যান করছে আবিরের দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়ার জন্য,আচ্ছা এই সুখ টাও কি আমি হারিয়ে ফেলবো!?আমার ভালোবাসা কে হারিয়ে ফেলবো আমি!?কিসের শাস্তি দিচ্ছো আল্লাহ্ আমায়!!?উফফ,ভাবতে পারছিনা আর।
.
আবির ডাকছে আমায়,মনে হয় চলে এসেছে সে,,
–নীরা…কই তুমি!?কখন থেকে কলিংবেল টা বাজিয়ে চলছি দরজা খুলে দিলেনা কেনো তুমি?জানোনা অফিস থেকে এসে আমার বউ টাকে না দেখলে আমার ক্লান্তি কাটেনা??
–সরি,,আসলে একটু বিজি ছিলাম কখন আসলে তুমি?
–এইতো কিছুক্ষণ হলো,আমেনা খালা(কাজের মেয়ে)দরজা টা খুলে দিয়েছে,তুমি নাকি মন মরা হয়ে বসে আছো,কি হয়েছে তোমার?শরীর খারাপ লাগছে?
–না আমি ঠিক আছি,তোমাকে মা একবার ডেকেছেন ওনার রুমে জরুরী কথা আছে তাই,তুমি ফ্রেশ হয়ে ওনার ঘরে যেয়ো।
–আচ্ছা যাচ্ছি এক কাপ চা নিয়ে এসো তো,আমার বউয়ের হাতের চা না খেলে আমার ক্লান্তি দূর হয়না যে!
–আচ্ছা নিয়ে যাচ্ছি মিস্টার এখন যান আপনি।
আবির ফ্রেশ হয়ে মায়ের ঘরের দিকে গেছে না জানি কি কথা হচ্ছে তাদের মধ্যে,এখন কি আমার যাওয়া টা ঠিক হবে?চা না পেলেও তো আবির রাগ করবে আবার!আচ্ছা যায় একবার,চা নিয়ে মায়ের ঘরের দিকে যাচ্ছি হঠাৎ ওনার কথা শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম!পুরো পৃথিবীটায় যেনো উলট পালট হয়ে যাচ্ছে আমার,ওনি আবির কে বলতেছেন
–বাবা আমি আর কয়দিন বা বাঁচবো বল?একটা নাতিপুতির মুখ দেখে মরতে চাই আমি,তোর আমি আরেকটা বিয়ে দিবো বাবা।তোর খালার মেয়ে সাইমা রুপে গুণে লক্ষি তোর আপত্তি না থাকলে আমি তোর খালার সাথে কথা বলবো মনে হয়না সে অমত করবে,নীরা কে তুই ডিবোর্স দিয়ে দে বাবা।
–কি বলছো মা এসব তুমি!?মা হতে পারছেনা বলে আমি নীরা কে ডিবোর্স দিয়ে দিবো?বাচ্চা হচ্ছে আল্লাহ্ তায়ালার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত,ওনার হুকুম ছাড়া ধুলো পর্যন্ত উড়েনা মা,কাজেই ওনি যেদিন চাইবেন সেদিন তিনি আমাদের সন্তান দান করবেন,প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো মা তুমি,আমি নীরার প্রতি এতো বড় অবিচার করতে পারবো না।
–ঠিক আছে যা ভালো বুঝিস তাই কর।
মা খুব রেগে গেছেন বুঝতে পারছি,আর ওনি প্রচন্ড জেদি,যায় বলেন তাই করেন আচ্ছা এবারো কি তিনি সেটাই করবেন যেটা তিনি চাইছেন?এ কোন পরিক্ষায় ফেললে তুমি খোদা?অঝোরে কেঁদে চলছি আমি
–কি ব্যাপার নীরা!?কাঁদছো কেনো তুমি?কি হয়ছে বলো!?
–বিয়েটা করে নাও আবির,আমি ডিভোর্স চাই,আমার পক্ষে তোমার সাথে থাকা আর সম্ভব নাহ।
–কিহ্!?তুমি কি পাগল হয়ে গেছো নীরা!?কি বলছো এসব?
–নাহ পাগল হইনি আমি,সুস্থ মস্তিষ্কে বলছি ডিভোর্স চাই আমি!প্লিজ মুক্তি দাও আমায়।
–এটাই কি তোমার শেষ কথা?যদি এতে তুমি ভালো থাকো তাহলে সেটাই হবে নীরা।মুক্তি দিবো তোমায় সাত বছর ধরে তিল তিল করে গড়া তোলা সম্পর্ক থেকে।
আবির চলে যাচ্ছে এটা বলে আর আমার কলিজা টা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে,আচ্ছা সে কি বুঝেনা এসব আমার অভিমান করে বলা কথা?আমি তাকে ছাড়ার কথা স্বপ্নেও যে ভাবতে পারিনা।
আজকাল আবির খুব পালটে যাচ্ছে,আগের মতো কথা বলেনা আমার সাথে,খুব প্রয়োজন ছাড়া তো কিছু চাই ও না,চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটি পালটে যাচ্ছে দেখে হৃদয়ে খুব রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে,অবশ্য পাল্টাবে নাই বা কেনো আমিতো চেয়েছিলাম এটা।
কয়েকদিন পর আমাদের বিবাহ্ বার্ষিকী।এই দিনে লাল বেনারসি গায়ে জড়িয়ে লাজুক লাজুক চেহেরা নিয়ে বউ সেজে আবিরের হাত ধরে এসেছিলাম এই বাড়িতে,আবির আমাকে কোলে করে রুমে নিয়ে গিয়েছিলো কত কত স্মৃতি আমাদের!আচ্ছা আবির কি সব ভুলে গেছে?ওর কি আমাদের বিয়ের দিন টা মনে নেই?অবশ্য থাকবেই বা কেনো আমিই তো আমার অস্তিত্ব ওর জিবন থেকে মুছে দিতে যাচ্ছি।
আবির কে দেখলাম মায়ের ঘর থেকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বের হচ্ছে,আচ্ছা আবির কি বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে?অবশ্য ভালোই হয়েছে এই অপয়া টা বিদায় হলে তাদের জিবনে শান্তি ফিরে আসবে,কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলছে আবির
–হ্যালো,কালকে যে বাড়িটাতে ডেকোরেশন করতে বলেছিলাম মনে আছে আপনার?জ্বি!খুব ভালো করে সাঝাতে হবে,ফুলে ফুলে সুসজ্জিত করতে হবে পুরো বাড়ি টা।আপনারা তাহলে কাল চলে আসুন,ওকে রাখছি।
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হতে চলেছে,নির্লজ্জ এই মুখ নিয়ে আবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম
–অভিনন্দন আবির,অনেক দোয়া রইলো তুমার জন্য।
–কেনো!?
–কেনো আবার তোমার নতুন জিবনের জন্য,যাকে নিয়ে তোমার নতুন জিবন শুরু করতে যাচ্ছো তার জন্য।
–ওহ্,ধন্যবাদ।
–(কলিজা টা যেনো কেউ ছিঁড়ে নিচ্ছে)আচ্ছা তোমার কি কিছুই মনে নেই আবির!?কাল আমাদের জিবনের একটা বিশেষ দিন।
–আসলে আমার কিছু মনে নেই,পুরনো কিছু মনে রাখতেও চাইনা,নতুন ভাবে নতুন জিবন শুরু করতে চাই,যাইহোক আমি এখন ব্যস্ত আছি অনেক কাজ পড়ে আছে আমার।
আমার চোখের পানি গুলো উপেক্ষা করে আবির চলে গেলো,এভাবে ভুলে যেতে পারলো ও?এতোই কি সহজ সব কিছু?আমার চোখের সামনে ও অন্য কারো হয়ে যাবে আমি সহ্য করতে পারবো না,বিধাতা মনে হয় নিজের স্বামী কে অন্য কারো সাথে ভাগ করে নেওয়ার মতো সহ্য ক্ষমতা কোনে নারীকে দেননি।সব থেকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি আমি,নিজেকে মুক্তি দিবো এই পৃথিবী থেকে,ঘুমের ঔষুধ গুলো শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম,এখন অপেক্ষা করছি সুযোগের।
বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন,আবির ও ঘুমোচ্ছে,শেষবারের মতো ও কে একটু দেখে নিচ্ছি।কি সুন্দর লাগছে ও কে!কত মায়া মিশ্রিত এই মুখ খানিতে,চোখ সরাতে পারছিনা,যত দেখছি মায়ার জাল আমাকে আটকে দিচ্ছে।নাহ আর দেখবো না মৃত্যু পথযাত্রী দের এতো মায়া বাড়াতে নেই তাহলে যেতে কষ্ট হবে।
ছোট্ট একটি চিরকুট লিখে নিলাম,’আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নই।স্লিপিং পিল গুলো সব হাতে নিয়ে মুখে পুরে এক ঢুক পানি দিয়ে গিলে ফেললাম,আস্তে আস্তে আমার চোখে যেনো অন্ধকার নেমে আসছে একে একে আবির আর আমার সব স্মৃতি গুলো চোখে ভাসছে,আমি জেনো গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি,মৃত্যু নিদ্রায়।
হঠাৎ চোখ মেলে দেখি আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি!তাহলে কি আমি মারা যায়নি!?চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে দেখছি পুরো রুম টাই ফুল দিয়ে সাঝানো,দেওয়ালে দেওয়ালে প্ল্যাকার্ডে লিখা “”Happy Marriage Anniversary “”বেডের পাশে চোখ যেতেই আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম!একটা ফুল দিয়ে সাঝানো ছোট্ট দোলনায় একটা জিবন্ত পরী ঘুমোচ্ছে,কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা।আবিরের ডাকে সম্ভিত ফিরে পেলাম
–নীরা তোমার জ্ঞান ফিরেছে!?কি করেছিলে এটা তুমি??আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো আমি কি নিয়ে বাঁচতাম বলো?তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কতো প্ল্যান করেছি জানো!?সেদিন মাকে বাচ্চা দত্তক নেওয়ার জন্য রাজি করিয়ে আসছিলাম আর তুমি ভেবে নিয়েছো অন্য কিছু?তুমাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে যে নিজেই এতো বড় সারপ্রাইজ পাবো কখনো ভাবিনি।
আবির কাঁদছে,কিন্তু আমার মনযোগ পরী টার দিকে।পরী টা কে কোলে নিয়ে বুকে ঝাপটে ধরলাম,চোখ দিয়ে প্রাপ্তির জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে,
–আবির আমাদের সন্তান তাইনা!?আমাদের পরী!
–হুম,আমাদের সন্তান ও,আর বিবাহ্ বার্ষিকীর উপহার তোমার জন্য।
হুম ও আমার নতুন জিবন আর খোদার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার।