সবে ক্লাস ফোর হলে কী হবে, ছেলের মান-স্বাভিমানের জ্ঞান টনটনে। সেদিন বলে কী, “ঠাকমা, তোমাকে না কত্ত করে বলি আমার স্কুল-ব্যাগ তোমার বয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই! আমার বন্ধুরা সবাই যে যার ব্যাগ পিঠে নিয়েই স্টপে দাঁড়ায়। ওরা হাসাহাসি করে, জানো!”
ঠাকমা জবাব দেন, “ক’দিনই বা আর আছি, দাদা। তাছাড়া জীবনভর তো বোঝা বইবিই। সবটাই তো পড়ে রইল সামনে।”
“সেজন্যেই বলি ঠাকমা, আমার জিনিস আমাকেই বইতে দাও। ক্লাসে প্রমিত স্যারও সবসময় বলেন, নিজের কাজ নিজেকেই করতে। এতে নাকি ভবিষ্যৎ শক্ত হয়।”
“ও বাবা, এত পাকা পাকা কথা! মানে বুঝিস? সন্ধেতে কী খাবি বল।”
“কথা ঘুরিও না। তাছাড়া গেটের কাছেই তো বাস দাঁড়ায়। তোমারই বা তিনতলা বেয়ে নেমে রাস্তায় দাঁড়ানোর কী দরকার? কোমরে ব্যথা না তোমার? মালিজেঠু একটু গেটে দাঁড়ালেই তো আমি বাসে উঠে যেতে পারি দিব্যি। তুমি ব্যালকনি থেকে চোখ রাখলেই পার।”
ঠাকমা চুপ দেখে ক্লাস ফোর আবার বলে, “তাছাড়া আমার ব্যাগ তেমন ভারী নয় ঠাকমা, আমাদের স্কুলে প্রত্যেক ক্লাসের বইয়ের আলাদা আলাদা ওজন নির্দিষ্ট করা আছে। এর বাইরে অ্যালাউ করে না। তাই দেখবে, আমাদের স্কুলের নার্সারির বাচ্চাগুলোও দিব্যি হাসিমুখে ব্যাগ বয়ে নিয়ে যায়।”
ঠাকমা গুম মেরে থাকেন, কিছু বলেন না। পরদিন আবার যে কে সেই। গেটের বাইরে নাতির একহাত চেপে ধরে তার বইয়ের ব্যাগ হাতে ঠাকমা দাঁড়িয়ে।
আজ কী এক ব্রত উপলক্ষে লুচি আর ক্ষীর প্রসাদ হয়েছে। ক্লাস ফোর ঠাকুরঘরের বারান্দায় বসেই তা খাচ্ছিল ঠাকমার হাতে। খেতে খেতে বলে, “আচ্ছা ঠাকমা, পিঁপড়েদের ঠাকমা নেই বুঝি?”
“সে কী কথা! খা শীগগিরই, সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।”
“উঁহু, এই দেখো না।”
ঠাকমা নাতির আঙুলের নিশানায় চোখ রেখে দেখেন, নিজের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বড়ো এক লুচির টুকরো কামড়ে ধরে কুচকুচে কালো এক পিঁপড়ের সে কী দৌড়।
পরদিন ক্লাস ফোর স্কুলে যাওয়ার সময় আড়চোখে দেখে যায় ঠাকুরঘরের দরজা বন্ধ। টিং টিং টিং টিং ঘণ্টা নড়েই চলেছে। মালিজেঠু গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে মুচকি হেসে।