ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে শরীরটা টেনে দাওয়ায় এসে বসতেই, ঠাণ্ডা এক ঝলক বাতাস প্রাণটা জুড়িয়ে দিল বুধানের। সবে ঋতু বদল করছে প্রকৃতি। হেমন্তের শিশিরে ভেজা বুধানদের ছোট্ট উঠোন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বুধান দেখে – মা উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। পুব দিগন্তে ভোরের সূর্য সবেমাত্র ডিমের কুসুমের আকৃতি নিয়ে উঁকি দিয়েছে পাহাড়ের খাঁজে। বুধান হাত জোড় করে মনে মনে বলে, “হে সূর্য দেবতা, আমার শরীরে বল দাও। শক্তি দাও আমার কমজোর পা দুটোতে।” শহরের ডাক্তার বলে দিয়েছে বুধানের পা দুটো আর ভালো হবে না। পোলিও বুধানের পায়ের সব শক্তি কেড়ে নিয়েছে।
বুধানের ঠাকুরদা মাধো সিং একবস্তা ঘাস উঠোনে নামিয়ে কোমরে হাত দিয়ে হাঁফায়। তার শরীর ঝুঁকে থাকে বয়সের ভারে। উঠোনের এককোণে মুংলি গাই বাঁধা। এখুনি বস্তা থেকে ঘাসগুলো উঠোনে ছড়িয়ে মুংলিকে খেতে দেবে ঠাকুরদা। আর বুধানের মা উবু হয়ে বসে বালতি পেতে মুংলির দুধ দোয়াবে। বুধানের দাদা দিনু, অনেক ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে, দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করবে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা আর একবাটি মুড়ির জন্য।
সামনের মাঠ ছাড়িয়ে ওই দূরের পাহাড়ের মাথায় সূর্যটা লাফ দিয়ে উঠতেই বুধানের পেটে খিদে চড়চড়িয়ে উঠল। ডিমের কুসুমের রঙে রাঙানো সূর্য দেখতে দেখতে একটা আস্ত ডিম খাওয়ার স্বপ্ন মনে ভিড় করে আসে। অভাবের সংসারে ডিম কেন, দুবেলা ভাত জুটানোই দায়। বুধান দিনুর পুরনো খাতা টেনে নিয়ে পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকে – পাহাড়ের মাথায় সূর্য, তার ঢাল বেয়ে নেমে আসা রাইফেলধারী এক সৈনিক। বুধান বড় ভাল ছবি আঁকে।
বুধান আর দিনুর বাবা মেহের সিং ছিল লম্বা চওড়া পালোয়ান – সে ফৌজে গিয়েছিল। হটাত সীমান্তে লড়াই লেগেছিল, আবার থেমেও গিয়েছিল একসময়ে। কিন্তু মেহের সিং কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল – কেউ বলতে পারেনি। বাবাকে নিয়ে বেশি আলোচনা হয় না বাড়িতে। মা শুধু মাঝে মাঝে রান্নার উনুনে কাঠ গুঁজে দিতে দিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বুধান বোঝে মায়ের দুঃখ – সে তো আর ছোট্ট ছেলেটি নেই এখন! ইস্কুলে পড়লে নিশ্চয়ই এতদিনে সাত কী আট ক্লাসে উঠে যেত। ঠাকুরদা মাধো সিং শহরে গিয়ে অনেক তদবির করলেও বুধানের বাবা মেহের সিং আর ফিরে আসেনি।
বুধানের আঁকা ছবিটা দেখে উঠোনে পা দিতে গিয়ে থমকে যায় দিনু। ঘরে ঢুকে কোথা থেকে যেন পুরনো এক বাক্স রং পেন্সিল এনে ফেলে দেয় ভাইয়ের কোলে। বলে, “রং ভরে দে। বড় সুন্দর ছবি এঁকেছিস।” বুধান দ্রুত হাতে ছবির মানুষের গায়ে খাকি রং ভরে দেয়।
দিনু এখন আর ইস্কুল যায় না। বুধানের মায়ের কাছে একটা আয়না আছে – ঘরের ভাঙা প্লাস্টার খসা দেওয়ালে, পেরেকের সাথে টাঙানো। চওড়া শরীর নিয়ে গালের কচি দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে নিজের মুখ দেখে দিনু। লম্বা চুলে চিরুনি চালাতে চালতে দাওয়ায় এসে বুধানের মাথায় আলতো আদরের টোকা মেরে, লম্বা লম্বা পা ফেলে উঠোন পেরিয়ে, বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, চলে যেতে যেতে দিনু চেঁচিয়ে বলে, “ফৌজে ভর্তির জন্য লোক নেবে। মা’কে বলিস দিনু শহরে গেছে।”
দিনু ফৌজে ভর্তি হয়ে যেদিন সদরে চলে গেলো ট্রেনিং নিতে, বুধান খুব কেঁদেছিল। ঠাকুরদা মাধো সিং বুকে জড়িয়ে স্বান্তনা দিয়েছিল ওকে। ঘরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মা বলেছিল, ফৌজের পোশাক পরে দিনু নাকি তার বাবার মতো দেখতে হয়ে গিয়েছে।
খাতা টেনে আর একটা ছবি আঁকে বুধান – গভীর জঙ্গল, এক দশাসই জওয়ান, গালে কচি ঘাসের মতো দাড়ি, কাঁধে রাইফেল – হলুদ ডিমের কুসুমের মতো সূর্যের খোঁজে এগিয়ে সে এগিয়ে যায়।