৯০ এর দশক এর কথা, গরমের ছুটি তে মামা বাড়ি বেড়াতে যেতাম, প্রায় ২০-২৫ দিন চুটিয়ে মজা করতাম মামা বাড়িতে। তুতো ভাইবোনেরা সবাই মিলে কি জমাটি আড্ডা, কত্ত কত্ত ধরনের খেলা, দিদার হাতে তৈরি আচার, মোরব্বা, কাঁচা আম ভর্তা, জাম ভর্তা আরো কত কি। সন্ধ্যে হলে মামীর হাতের মুড়ি মাখা, চিড়ে ভাজা, মুড়ির মোয়া, চিনা বাদাম ভাজা কত্ত লোভনীয় খাবার। পুরো সন্ধ্যা জুড়ে লুডো খেলা, সাপ-সিড়ি খেলা আর যেই না লাইট চলে গেলো ওমনি সকলে মিলে হইহই করতে করতে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে উঠোনে বসে তারা দেখা, চাঁদ দেখা। মনে পরে সকাল বেলায় মামী নিজ হাতে আমাদের সবাই কে উঠোনে নিয়ে বসতেন মাথায় তেল লাগিয়ে দেওয়ার জন্যে, জবজব করত মাথা তেলের প্রলেপে…. মনে পড়ে, তখন দিদা বলতেন ‘পুলাপাইনডির মাথায় ভালো কইরা তেল লাগাইইয়া দিও বউ, চুল না ঝাড়ু বুঝা যায় না, টিবি (টি. ভি) দেইখ্যা খালি শম্পু (শ্যাম্পু) লাগান শিখসে ‘। দিদার কোথায় খিলখিল করে হেসে উঠতাম আমরা, কি আনন্দের দিন ছিল….
রবিবারে তো আরো মজা হতো। মামা জেলে কাকাকে নিয়ে আসতেন চৌমাথা থেকে, সারা সকাল আমাদের কি উল্লাস! জেলে কাকা জাল ফেলবে আর আমরা মাছ ধরা দেখবো। মামী বলতেন ‘দেইখ্যা যা গুঁড়া সৈন্যরা, কতো মাছ আর কি লাফান লাফাইতাছে মাছ টি, নিজেরার পুকুরের মাছ, কত স্বাদ…’ দুপুরে গরম ভাত আর তাজা মাছের ঝোল, খুব সাদামাটা খাবার কিন্তু কি তৃপ্তি করেই না খেতাম’। খেয়ে-দেয়ে দিবানিদ্রা দিতুম আমরা দিদার মুখে গল্প শুনতে শুনতে, দিদা বলতেন ‘এক দেশে একটা রাজা আছলো, রাজার তিনটা বউ, রাজার দেশে মানুষের কুনু কষ্ট আছলো না কিন্তু হঠাৎ একদিন হইলো কি একটা রাইক্ষস….’ গল্প তো মাঝপথেই ছুটে যেত, আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়তাম যে…
না তখন ছিল না কোনো ক্যামেরা বা ক্যামেরা দেওয়া কোনো ফোন যে সে সব সোনালী স্মৃতি গুলো কে ফ্রেমবন্দী করে রাখবো… সত্যি বলতে দিদার সাথে এরকম কোনো ছবিই নেই যে দিদা কাঁচা আম ভর্তা করছে আর আমরা সেল্ফি নিচ্ছি, মামী কাঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আর আমরা কাঠাল গাছের ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে সেল্ফি নিচ্ছি, বা বৈশাখী ঝড়ের তান্ডব আর শিলা বৃষ্টি ধেয়ে আসছে আর আমরা সেল্ফি নিচ্ছি, না সেরকম কোনো সেল্ফি বা ফটো নেই, তবুও অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে সবকিছু। মামা বাড়িতে পুরোদিন আমরা দস্যিপনা করে দাপিয়ে বেড়াতাম। দিদা বলতেন ‘কর কর দাপাদাপি কর, কিচ্ছু হইতো না। তোরা অখন দাপাদাপি হুড়াহুড়ি না করলে কবে করবি?’ কি মনোরমই না ছিল সে সকল দিন গুলি…
সত্যি এত্ত দিন হয়ে গেলো এখনও কিছুই ভুলিনি ছোটোবেলাকার দিনে গ্রীষ্মের ছুটিতে মামা বাড়িতে কাটানো প্রতিটি পল, প্রতিটি ক্ষণের কথা। মনে পড়ে এখনও আমরা সবাই গোল হয়ে বসতুম রান্নাঘরের দাওয়ায়, দিদা আর মামী মিলে আমাদের খাওয়াতেন কত শত ছড়া-গল্প করতে করতে। স্মৃতি রোমন্থন করতে বসলে এখনও জ্বলজ্বল করে ওঠে স্মৃতি গুলো। তখন হয়ত হৃদয়ে অঙ্কিত হতো স্মৃতিগুলো তাই ভুলিনি আর এখন তো এত আধুনিক হয়েছি আমরা যে পরশু দিন বা তরশু দিন কোথায় কোথায় যেনো গেছিলাম ঘুরতে সেটাও ফোনের অ্যালবামে গিয়ে ফটো দেখে মনে করতে হয়… দিদা এখন নেই, গত হয়েছেন, থাকলে সারাদিন এইভাবে ফোনে ঢুকে বসে আছি দেখতে পেলে নিশ্চিত বলতেন ‘ কিতা একটা পাতলা ডিব্বার দিকে চাইয়া বইয়া থাকোস তোরা? এই ডিব্বার মইধ্যে কিতা এত গুতাগুতি করস আঙ্গুল দিয়া?’
কি সুখের ছিল সেইদিন গুলি আমার কন্যা রত্নটি তো শুনলেও হাসে যে এরকমও হতো নাকি তখন! হাসবারই কথা, এই শহুরে কংক্রিটের জঙ্গলে কোথায় পাবো পুকুর, কোথায় পাবো উঠান? লাইট যাওয়া কি সেটাই বা বুঝতে পারে কই ইনভার্টার আর জেনারেটারের কল্যাণে? সত্যি কত্ত অঢেল সময় ছিল তখন আমাদের, কত্ত মজা কত্ত খুনসুটি কত্ত খেলা কত্ত খাওয়া। কিন্তু এখন সেসব পেতে চাইলেও পাচ্ছি কই? অফিসে কাজের টার্গেট কমপ্লিট করার চাপ, বাড়িতে সংসারের কাজের চাপ, কন্যারত্নটির আজকে এই টেস্ট, কালকে ওই টেস্ট আরো কত কি! ছুটছি যেনো সবাই, দু দণ্ড বিশ্রাম নিচ্ছি না। সময়ের আকাল, একসাথে বসে কথা বলারও যেন সময় নেই। মনে পড়ে দিদার একটি কথা ‘আমারার বাড়িতে খালি একটাই ঘড়ি আছে, কিন্তু প্রাণ খুইল্লা কথা কইতে বসার লাইগ্গা ‘সময়’ সবাইর কাছে আছে…।