উপনিবেশ

উপনিবেশ

লণ্ঠনের আলোতে মুরারীর ভাঙাচোরা মুখ কাঁপতে থাকল । আলো ছায়ায় ভেঙে ভেঙে গেল গাল, নাকের গর্ত, কপালের শিরা, কুঁচকানো চামড়া। মাংকিক্যাপ সরিয়ে কানের পাশ থেকে বিড়ি বার করে এনে এলোমেলো হাতে ধরাল মুরারী। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে শ্লেষ্মামাখা ঘড়ঘড়ে শব্দে বলল “শালার এত মানুষ কলকাতা শহরে আসছেটা কী করে?”

সশব্দে হাই তুলল দেবনাথ। শীতকালের সন্ধে জাঁকিয়ে বসেছে। সংগত দিচ্ছে মশাদের কোরাস। আশপাশের ফ্ল্যাটে জেনারেটরের শব্দ শোনা যায়। প্রায় একশ বছরের পুরনো ভাঙাচোরা এই আড়াইতলা বাড়িতে জেনারেটর বসাবার সামর্থ্য নেই মুরারীর। তার দিন চলে গেছে।

বসে বসে কতক্ষণ মুরারীর প্যাঁচাল শুনতে হবে কে জানে! ভ্যাপসা ঘরের মধ্যে শীতের রাতেও দেবনাথের মোটা কালো ব্যাঙের মত শরীর ঘামছিল। সে মাথা উঁচু করে দেখছিল, ঘরের কড়ি-বরগার সাইড থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে। দেওয়ালের গায়ে অজস্র ফাটল এবং ড্যাম্পের দাগ। তবে ফার্নিচারগুলো দামী কাঠের। বার্মা টিকের একটা টেবিল আছে। পালিশ উঠে গেছে, ঝুল-ধুলো-বালির মোটা প্রলেপ। বোঝাই যায় বহুদিন আদরযত্ন পায়নি। কিন্তু কাঠ ভাল বলে ঘুণ ধরেনি।

“আগে চারপাশে ধূ ধূ করত জমি। বুঝলে? মাঝে মাঝে জলা। বুনোকুল-কাঁটাঝোপ, আশশ্যাওড়ার বন। হাতির দাঁতের মত সাদা গোখরোর আড্ডা ছিল ওখানে। সাঁওতালের দল আসত মাঝে মাঝে। সাপ ধরে পুড়িয়ে খেত। আর ছিল গোসাপ। আমরা বলতুম গোঁয়ারগেল। সড়সড় করে হাঁটত। ডিমের কী আঁশটে গন্ধ দেবনাথ! গা গুলিয়ে উঠত। এই সিরিটি-মুচিপাড়া-পুঁটিয়াড়ি, বুঝলে, পাশ দিয়ে আদি গঙ্গা বয়ে গেছে, আর দুইপাশে শুধু নাবাল ন্যাড়া জমি। ছটাকে দাম ধরা হত তখন। আমাদের যা জমি ছিল ছটাক ধরলে একটা আস্ত খাতা ফুরিয়ে যাবে দেবনাথ!”

একটু থেমে আবার বিড়িতে টান দিল মুরারী। কোনও এক বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে। মুরারী দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানাল কল্পিত দেবতার উদ্দেশ্যে। তারপর ঘড়ঘড়ে বুকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “সব চলে গেল দেবনাথ। ওই মুখার্জি ঠিকাদার আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে। আফিমের নেশায় কত কত জমি জলের দরে তুলে দিয়েছি ওর হাতে ! আর সব জমিতে ফ্ল্যাট তুলে দিল। এত মানুষ আসে কোথা থেকে দেবনাথ?”

দেবনাথ রুমাল দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছল, “প্রতিদিন একই বিলাপ করে আর কী করবে মুরারীদা ! যা আছে, যেটুকু আছে, সেটাকে বাঁচাবার কথা ভাবো।”

“কিচ্ছু নেই আর,” হতাশায় মাথা ঝাঁকাল মুরারী। “মুখার্জী কেড়েকুড়ে নিল সব। এই যে, চারপাশে ফ্ল্যাটবাড়ি দিয়ে ঘিরে ধরল আমাকে, সে কি এমনি এমনি? সব ষড়যন্ত্র। সব কিছু। আমাকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে একা করে দিল পুরোটা। কত জমি জবরদখল করে ফেলেছে ধারণা নেই তোমার। তুমি জানবেই বা কী করে ! এই দেখো, নামটাই গুলিয়ে ফেলেছি। কী নাম যেন তোমার? এই শালার অসুখ…”

আবছা ঘরে বসে মুরারীর হাহাকার শুনতে শুনতে দেবনাথের ঝিমুনি আসছিল। প্রতি সন্ধ্যেবেলা মুরারীর স্মৃতিলোপ পায়। স্নায়ুর রোগ হতে পারে, আফিমের দীর্ঘদিনের নেশার কারণেও সম্ভব। আগের দিন কী বলেছিল ভুলে যায়। মানুষজনের মুখ চিনতে পারে না। কিন্তু স্পষ্ট মনে থাকে তিরিশ বছর আগে ডাক্তারের বাগানে পিকনিকে তাদের কী মেনু ছিল। খড়গোলার জমি কীভাবে তার হাত থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিল মুখার্জি, সেই ইতিহাস বলে বলে তার মুখে ফেনা উঠে গিয়েছে। কিন্তু তার নিত্যদিনের যে মানুষ, বিছানাতে তার জন্য যে অপেক্ষা করে প্রতি রাত্রে, মুরারী সামন্ত তাকেই ভুলে যায়। দেবনাথ চটাস করে মশা মারল একটা। কীসের আশায় আটষট্টির স্মৃতিভ্রষ্ট মুরারীর সামনে প্রতি সন্ধ্যেবেলায় তুমি বসে থাকো, বাহান্ন’র দেবনাথ?

মুরারীর বিশাল বাড়ি এখন নিঝুম। বেশিরভাগ ঘরেই আর আলো জ্বলে না। ইলেক্ট্রিসিটির বিল টানা চাট্টিখানি কথা নয়। টিনের তোরঙ্গ, পঞ্চাশ ষাট বছরের পুরনো হিসেবের খাতা, গুরুদেবের পায়ের ছাপ, জ্যালজ্যালে কাঁথাপত্র, ভাঙা কুলুঙ্গি, অবহেলায় লুটোতে থাকা কয়েকটা চেয়ার, এসব নিয়ে মুখ গুঁজরে পড়ে আছে দুখানা ঘর। অথচ তিরিশ বছর আগেও কী অবস্থা ছিল, সে সব তো চাক্ষুষ করেছে দেবনাথ! রমরমিয়ে সুদের ব্যবসা, জমি বাড়ি ভাড়া দেবার কারবার তখন মুরারীর। দেবনাথের বাবা মুরারীদের পাটের দোকানে খাতা লিখত তখন। দেবনাথের চোখের সামনেই এই বিশাল সম্পদ ধীরে ধীরে ভেঙেছে। জমি বেহাত হয়েছে। লাটে উঠেছে পাটের ব্যবসা আর তেজারতী কারবার। জমানো কিছু টাকার সুদের পয়সায় এখন দিন চলে মুরারীর। এবং তার চারপাশে ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটবাড়ি। রংবেরঙের গাড়ি আসছে বেরচ্ছে। টাইট জামা জিনস পরা মেয়ের দল। সেট-টপ বক্স, এসি মেশিন প্রতি ফ্ল্যাটে। মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা বিদেশি গানের ঝিনচ্যাক সুর। পার্টি হয় কোনো ফ্ল্যাটে। উচ্ছল হাসির আওয়াজ, গেলাসের টুংটাং। রাত ঘন হয়। মুরারীর সাদা কালো আদ্যিকালের টিভিতে আজকের বিশেষ বিশেষ খবরেরা ঘুমিয়ে পড়ে।

পর্দা সরিয়ে মালতী ভেতরে ঢুকল। দেবনাথের সামনে নতমুখে চায়ের কাপ রেখে মুরারীকে বলল “তোমার দুধটা এখন দিয়ে দি?”

মাছি তাড়াবার মত করে হাত নাড়ল মুরারী, “এখন যাও তো ! বিরক্ত কোরো না”।

মালতী বেরিয়ে যাবার খানিকটা পর অবধি দরজার পর্দা আন্দোলিত হচ্ছিল। ফেলে যাওয়া কী একটা গন্ধ যেন মালতীর শরীরে, সেই গন্ধে পর্দাটা কাঁপছিল মনে হচ্ছিল । মুরারী বিড়বিড় করে বলল “নষ্ট মেয়েমানুষ কোথাকার ! ভাবে কিছুই বুঝি না ! দিন চলে গেছে, গায়ে আর বল নেই, বিছানাতে চাগ দেয় না দেবনাথ। তাই সব বেদখল হয়ে যায়”।

“আহ, কী উল্টোপাল্টা বকছ !” দেবনাথ বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঝাঁকায়। “ঘরের মেয়েছেলে– যা মুখে আসে তাই বলছ। মাথাটা একেবারেই গেছে না কী?”

“মেয়েছেলের মন তুমি বোঝো? জলের দরে বিকিয়ে যাওয়া মেয়েমানুষ নিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলো নাকি দেবনাথ?” মুরারী খ্যা খ্যা করে হাসতে হাসতে নাক খুঁটতে থাকল। হলুদ পোঁটা আঙুলের ডগায় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল “কি নাম যেন, ভুলে যাই আজকাল। এই শালার রোগটা হয়ে কত কী যে মাথায় থাকে না-”

“মালতী”।

“হ্যাঁ, মালতী। আমার মাথায় ভূত চেপেছিল তখন। অবস্থা পড়ে গেছে, কায়ক্লেশে দিন চলে। একের পর এক জমি হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু মালতীকে পেতেই হবে। তিন বছর আগে বিভা মরে গেছে। আমার শরীর তখন জমি চষতে উন্মুখ, বুঝলে কি না ! মালতীর তখন চক্কর চলছে পাড়ার এক লক্কা পায়রার সঙ্গে। টাকা ধার করে ওর বাবার কাছে গিয়ে থলি উপুড় করে দিলুম। অত টাকা চোখে দেখেছে ওই লক্কা পায়রা?”

“এসব প্রতিদিন একবার করে বলো মুরারীদা। সবাই সব জানে। কী পাও নিজের বউকে অপমান করে?”

মুরারী চুপ করে যায়। বসে বসে ঝিমোয়। দূরে কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসছে স্টার জলসার সিরিয়ালের সুর। হরলিক্সের সস্তা বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে মুখে পড়ল দেবনাথ। মুখের ভেতর কেমন আঠালো মিষ্টি হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে। তখন চা-য়ে চুমুক দিতেই হয়। দেবনাথ চট করে একবার উঠে ঘরের বাইরে আসল। মালতী চুপচাপ বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দেবনাথ মালতীর পাশে গিয়ে নিচু স্বরে বলে “মুরারীদার শরীরটা দিনে দিনে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে মালতী। কথা বলতে বলতেই আমার নাম ভুলে গেল। কাল আবার ভুলবে। মুখও ভুলবে। একজন ডাক্তার দেখালে হত না?”

মালতী ধীরে ধীরে মুখ ফেরায়। আলোছায়ার কাটাকুটি তার ডিমের গড়নের শ্যামলা মুখে। “তোমার অত দরদ তো তুমি নিয়ে যাও না! আমি একাবোকা মেয়েমানুষ, আমাকে বলছ কেন?”

মালতীর ঘাড় গলায় একটা খড়খড়ে রুক্ষতা। ঠোঁট বোলালে সম্ভবত সিমেন্ট ফেলার আগের লণ্ডভণ্ড জমি মনে হবে । ওই রুক্ষতা শরীরের লোম খাড়া করে দেয়। মালতীকে বুনো বেড়ালের মত লাগে তখন দেবনাথের। তার ইচ্ছে করছিল বাঘের মত ঘাড় কামড়ে ধরে মালতীকে সেই কবেকার আশশ্যাওড়ার জঙ্গল যা এখন গেটেড কমিউনিটির ভিতের তলায় কবরখানা হয়ে ঘুমোচ্ছে সেখানে টেনে নিয়ে যায়।

“তোমার বর। তুমিই তো মতামত দেবে ! আমরা তো বাইরের লোক। ”

“বর!” মালতী তাচ্ছিল্যের মত করে ঠোঁট ওলটাল। “কেমন বর সে তো পাড়ার লোকের আর জানতে কিছু বাকি নেই! সন্ধ্যে থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে লোককে বলে বেড়াচ্ছে আমি রেন্ডি, ঘরে ঘরে আমার নাগর ফিট করা। এরপরেও তুমি ভাবো যে তার ভালমন্দের দিকে খেয়াল রাখতে আমার ইচ্ছে করবে?”

“জায়গাজমি হারিয়ে মুরারীদার মাথাটা গেছে। তোমাকে ভালবাসে খুব-”

“তুমি হঠাৎ এত ওকালতি করতে নামলে কেন দেবনাথদা?” মালতী স্থির চোখে দেবনাথের দিকে তাকায়।

আরও পড়ুন, প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য বিষয়ক লেখা হত্যা হাহাকারে – অপরাধসাহিত্যে বিনির্মাণ ও আধুনিকতা

দেবনাথ ঢোঁক গিলল একটু। জিভ চাটল একবার। তারপর অনেক সাহসে ভর করে আলতো হাতে মালতীর কড়ে আঙুল ধরল, “তুমি কেমন মেয়ে আমরা কী আর জানি না মালতী? তোমাকে ভেবে আমার যে কী হয় সেটা তুমি বোঝো না এমন নয়। মেয়েমানুষের চোখ ধোঁকা দেওয়া অত সহজ নয় আমিও জানি। কিন্তু মুরারীদার সত্যিই মাথার ঠিক নেই। একে তো তার জমি হাতিয়ে নিল বলে যা নয় তাই গাল মারছে, তার ওপর তোমাকে আমাকেও চিনতে পারছে না এখন। ভুলে যাওয়ার এই রোগ, কী যেন নাম, অ্যালঝাম না কী যেন, এটা বাড়তে থাকলে একদম অথর্ব হয়ে যায় মানুষ। তখন তোমাকেই তার চান খাওয়া বাহ্যি সব করিয়ে দিতে হবে। আগে থাকতে সাবধান হওয়া ভাল নয়?” দেবনাথ খুব আলতো ভাবে মালতীর আঙুলে চাপ দিল।

মালতী হাত ছাড়াল না। কয়েক সেকেন্ড পর একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে নরম গলায় বলল “তোমাকে আমি বুঝি না দেবনাথদা। তোমার পয়সা আছে, বাড়িতে বউ বাচ্চা আছে। তা সত্বেও এখানে এসে পড়ে থাকো। মুখে বলো মুরারীদাকে ভালবাসো। কী যে সেই ভালবাসা তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আবার কখনো বলো আমাকে ভালোবাসো। বিশ্বাস হয়না ঠিক। আজকাল কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না । টাকার ঝাঁপি দেখে তিরিশ বছরের বড় দোজবরের গলায় বাবা মা ঝুলিয়ে দিল। সেদিন থেকেই আমি মরে গেছি মনে হয়। তোমার মুরারীদা এখন থাকল কী গেল, তাতে আমার অবস্থা কী পালটাবে বলতে পারো?”

পাশের বাড়ি থেকে ঠিকরে আসা আলতো আলোয় মালতীর কণ্ঠার হাড় চকচক করে। দেবনাথ সেই দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে কিছু টাকা বার করে। “এটা রাখো। মুরারীদাকে দিলে তো নেবে না, উলটে দূর দূর অপমান করবে। একটু মাছ আর দই এনে মানুষটাকে খাইও। কদিনই বা আর আছে ! নিজেও খেও”।

মালতী টাকাগুলো নেয়। তারপর মুরারীর দিকে শরীরের পুরোটা ঘোরায়। দেবনাথের আবার মনে হয়, বনবেড়ালটা এবার তার রোঁয়া খাড়া করে ফেলবে। মালতীর শরীর ঘিরে লোডশেডিং গলে গলে পড়তে থাকে। “তুমি চাওটা কী, দেবনাথদা?”

“ঘরে যাই মালতী। মুরারীদা একা বসে রয়েছে”।

দেবনাথ ঘরে ঢুকে দেখে, মুরারী তার চশমাটা পরে নিয়ে কীসের একটা দলিল দেখছে লণ্ঠনের আলোতে। দেবনাথকে দেখে দলিলটা তুলে ধরল। “শেষ প্রপার্টি ছিল সিরিটি বলখেলার মাঠের পাশে, বুঝলে? কী নাম যেন তোমার? সে যাক গে, নয় কাঠার ফাঁকা জমি। এখন মহাবীরতলা থেকে অটো আসে। ভাত রুটি তড়কার দোকান করেছে, বুঝলে? বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি। এত মানুষ আসে কোথা থেকে? আর মানুষের এত টাকা হয় কীসে বলো তো? এদিকে যে শুনি সব কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে?”

দেবনাথ ঘড়ি দেখে। কারেন্ট আজ আর আসবে না মনে হচ্ছে। এ শালা মশার প্রকোপে এই অন্ধকারে ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে আর ইচ্ছে করছে না।

“মুখার্জী আর সম্পত্তির মায়া কী বুঝবে ! সেদিনের ছোকরা। সম্পত্তি চোখে দেখেছে? ওর ফ্যামিলির তো জুতোর তলায় থাকবার কথা । ইশকুল পাশ করতে পারেনি ছোকরা। ইট বালির কারবার করে আর বড় প্রোমোটারের পেছন চেটে হঠাৎ বড়লোক হয়েছে এখন। হেঁঃ, আমাকে প্রপার্টি চেনাচ্ছে !”

দেবনাথ মুরারীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে যায়। “আমি দেবনাথ। আর এসব প্রতিদিন বলে কী হবে মুরারীদা? মালতীকে দেখো একটু। তোমার বউ শুকিয়ে যাচ্ছে। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতন করে না। অ্যানিমিয়া হয়েছে মনে হল। ”

“মালতী, মালতী,” অস্থির ভাবে মুরারী মাংকি ক্যাপের ওপর দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরে। “সব বেদখল হয়ে যাবে। কী কুক্ষণেই যে বিয়েটা করেছিলাম দেবনাথ! জানো, কোন একটা সময়ে যেন, নামটা ভুলে যাই, যখন অনেক ছেলে খুন হত পুলিশের হাতে, আমাদের জমিতে লাশ পোঁতা আছে অনেক। এখন তাদের ওপর ফ্ল্যাট, তারপর, কী যেন বলে, শপিং মল, ফ্লাইওভার। আমাদের গোয়ালে কয়েকটা ছেলে এসে লুকিয়ে ছিল। আমিই পুলিশে খবর দিই। পুলিশ এসে ধুধু মাঠের ওপর ছেড়ে দিয়ে বলেছিল ‘যা’। পালাতে যেতেই পেছন থেকে গুলি। সেই মাঠেই বডি পুঁতে ফেলে তারপর। পুরোটা আমার চোখের সামনে দেখা। দুদিনের ছোকরা মুখার্জি, নাক টিপলে দুধ বেরয়, সে এসব কী জানবে ! নতুন টাকা করে ধরাকে সরা দেখছে!”

“সে সব লাশ তারপর বাইরে আসেনি? যখন ভিত খোঁড়া হচ্ছে?”

“জানি না। বিক্রি করে দেবার পর আর দেখতে যাই না। বুকের ভেতর মোচড়ায় দেবনাথ ! শুনি, কলকাতা নাকি পালটে যাচ্ছে। অনেক আলো, অনেক মানুষ। প্রচুর দোকানপাট, বাজার। মেয়েছেলেরা পেটকাটা জামা পরে ঘোরে। আর ব্যাটাছেলেরা নাকি হিপিদের মত উল্কি আর কানে দুল পরে। সেসব দেখতে যাই না আর। টালিগঞ্জ পেরইনি আজ কতবছর হয়ে গেল ! কী হবে গিয়ে? সব অচেনা হয়ে গিয়েছে। পটকার চায়ের দোকান উঠে গেল। শুনেছি সে নাকি সুইসাইড করেছে। শ্মশানের কালীমন্দিরও ভেঙে গেছে নাকি। সেখানে আর লোক আসে এখন? দেবনাথ, আমাকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দেবে? যাতে ছবি তোলা যায়? আমার ফোনটা ভেঙে গেছে, গার্ডার জড়িয়ে চালাতে হয়। বেশ ছবি তুলব, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভিডিও করব।”

দেবনাথের একটু নিষ্ঠুর হতে ইচ্ছে করে। “তোমার নতুন মোবাইল ফোন দিয়ে আর কী হবে মুরারীদা? কেউ তো আর দেখতে আসে না, আমি ছাড়া। নতুন দিনের কাউকে তুমিও চেনো না আর। বাড়ির বাইরেই বেরোও না তো আর চেনা! তুমি ফোন নিয়ে খেলনাবাটি খেলবে নাকি?”

মুরারী একটু চুপ করে যায়। আরো ঘন হয়ে আসে অন্ধকার। একটু বাদে মুরারী বলে, “একটু শুই গিয়ে। আফিম নিতে হবে”।

পা অল্প টেনে টেনে অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে আরেকটা অন্ধকারের দিকে চলে যাওয়া মুরারীকে দেখতে দেখতে দেবনাথ উঠল । তাকেও কিছু দরকারি কাজ সারতে হবে।

বারান্দার এক কোণায় ছায়ার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে মালতী। দেবনাথের দিকে এগিয়ে আসে “যাচ্ছ?”

“চলি আজ। কাল আসতে পারব কী না জানি না। সামনের সপ্তাহে এসে একবার খবর নেব”।

দেবনাথের কোলা ব্যাঙের মত কালো ও মোটা শরীর ঘেঁসে দাঁড়াল মালতী। “এসো। আবার এসো। দেরি কোরো না। কেউ তো আসে না আর!”

দেবনাথের ইচ্ছে করছিল মালতীর সিমেন্টের জমির কোমরে তার খড়খড়ে হাত একবার বুলিয়ে দেয়। নিজেকে সংযত করে মালতীর বাহুতে আলতো হাত রাখে, “আবার আসব মালতী। আমি তো নিয়মিতই আসি। ভাল থেকো। একটু খাওয়া দাওয়া করো ঠিকঠাক। আমি দেখছি, যদি স্মৃতি ফিরে পাবার কোনও আয়ুর্বেদিকের সন্ধান পাওয়া যায়।”

মালতী অল্প হাসে, “উপকার করছ না কি সর্বনাশ সেটাও ঠিক বুঝি না আজকাল। এসো দেবনাথদা। সাবধানে যেও। গলির মুখে রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। অন্ধকারে হোঁচট খেও না আবার”।

দেবনাথ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোবার পর পেছন ফিরে দেখল মালতী স্থির হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

গলি থেকে বেরিয়ে দেবনাথ চারপাশে তাকাল। তারপর পকেট থেকে ক্লাসিকের প্যাকেটটা বার করে সিগারেট ধরাল একটা। চারিপাশে এখন গমগম করছে আলো, দোকানপাট। রাস্তা দিয়ে অনবরত গাড়ি ছুটছে বড় বড়। রাস্তার উল্টোদিকে একটা জিম সেন্টার হয়েছে নতুন। নানা বয়েসের লোকজনের ভিড় সেখানে। তার পাশেই এগরোলের সেন্টার, সাইবার ক্যাফে, মনজিনিসের দোকান। একটু এগোলে ইট বালি চুন সুরকির সার সার গুদাম। মোবাইল রিচার্জের স্টোর তার পাশেই। আর অসংখ্য ফ্ল্যাট, ছোট বড়, মাথা উঁচু করে আকাশ ছুঁতে চাইছে। তাদের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে মুরারী সামন্ত-র ভাঙা প্রাসাদ।

দেবনাথ একগাল ধোঁয়া ছেড়ে একটা তৃপ্তির শ্বাস ফেলল। সামনে পেছনে সব জমির বন্দোবস্তই হয়ে গিয়েছে। মুরারীর বাড়িটা হাতে পেতে, তার অভিজ্ঞ চোখ বলছে, আর বড় জোর মাস ছয়েক। একটা চারতলার ফ্ল্যাট উঠে যাবে আরামসে। মালতীকেও তার মধ্যেই কেড়ে নেবে সে। মেঘের মত চারপাশ থেকে ঘিরে ধরবে পুরনো মুরারীকে।

পাশের গলিতে দাঁড় করিয়ে রাখা ওয়াগনারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আরেকবার আকাশ দেখল দেবনাথ মুখার্জী। একটা উত্তুরে ঝোড়ো হাওয়া অনেকগুলো জংলী ফুল কোথা থেকে উড়িয়ে আনছে । কুচকুচে ব্যাঙের মত শরীরে ঝিকমিক করছে রুপোলী নক্ষত্রের দল। । গম্ভীর অন্ধকার এ চরাচর এখন কানায় কানায় পূর্ণ । ইচ্ছে করলেই এখন আদি গঙ্গার ঘাটে নৌকো ভিড়িয়ে যে কোনও সময়ে চার্ণক উঠে আসতে পারে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত