-“জানো দিদিমণি আমি শুধু একবার ওকে বুকেই জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলুম গো! তারপরেই ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে দিতাম,বিশ্বেস কর দিদিমণি আমি ছেলেধরা নই”।
হাসপাতালে আজ সকালে সদ্য আসা গণপিটুনি খাওয়া কেসের পেশেন্টের মুখে কথা গুলো শুনে কয়েক মুহুর্ত থমকালাম।তারপরেই নিজের কাজে লেগে গেলাম আবার।একজন সরকারি হাসপাতালের নার্সকে প্রতিদিন বহু বিচিত্র রোগীর সংস্পর্শে আসতে হয়।সেবাযত্ন করে শুধু তাদের শরীরের নয়,মনের ক্ষতও সারাতে হয়।সেই উদ্দেশ্যেই একটু কৌতূহল নিয়ে সাধারণ কথাবার্তা চালাচ্ছিলাম লোকটার সাথে।আজ সকালে কোনও এক প্রসূতিসদনের থেকে একটা সদ্যজাত কন্যাশিশুকে নাকি চুরি করে পালাচ্ছিল লোকটা।জনতা গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলেদিয়েছিল।লকাপে পোরার আগে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে গেছে প্রাথমিক শুশ্রূষার জন্য।লোকটার বয়স আন্দাজ ষাটের কোঠায়।পাকা চুল দাঁড়ি,ক্ষয়িষ্ণু চেহারা তবে চোখ দুটো বড্ড উজ্বল আর অস্থির।সবসময়ই যেন কাকে খুঁজে চলেছে চোখদুটো।
একবার ভাবলাম লোকটা উন্মাদ নয় তো?সেই জন্যই কি বাচ্চা নিয়ে পালাচ্ছিল!? কেন জানিনা লোকটাকে কিছুতেই ছেলেধরা মানতে পারছিলাম না আমি।অতিসাধারণ চেহারায় ও তার কেমন মায়ামায়া ভাব।আজ হাসপাতালে তেমন কাজের চাপ নেই।তাই ভাবলাম অন্য নার্সদের সাথে গল্পগাছা না করে বরং এই লোকটার সাথেই একটু আলাপ জমাই।লোকটার মাথায় ব্যান্ডেজ করতে করতে বললাম-“বটে? তা হঠাত এমন শখ হল কেন? তোমার ঘরে নাতিপুতি নেই!?” লোকটা খুব উৎসাহের সাথে বলে উঠল-“আপনি শুনবেন আমার কথা দিদিমণি! কেউ আমার কথা শুনতে চায়না জানেন? বলে আমি নাকি পাগল”। আমি বললাম -“বেশ শুনব তোমার কথা। বল দেখি।” লোকটা অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে গুছিয়ে বসে দুবার কেশে নিয়ে বলতে শুরু করল-“জানেন দিদিমণি আমার না চিরকাল একটা মেয়ের খুব শখ।সেই যখন বিয়ে করলাম তারও আগে,বলতে পারেন সেই ছেলেবেলা থেকেই।আমার দিদির এক পুতুল ছিল তার নাম ছিল রাজকন্যা।
ও তাকে নাওয়াতো খাওয়াতো বিয়ে দিত ঘুম পারাত। কিন্তু আমাকে ধরতে দিত না,বলত তুই তো ছেলে তোর আবার পুতুল খেলা কিরে! আমি ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না ছেলে বলেই যে আমার পুতুল খেলা বারণ,আমি ছেলে বলেই আমার মনে কোনও নরম জায়গা থাকবে না এটা নয়। আমার খুব খুব ইচ্ছে হত আমিও রাজকন্যাকে নাওয়াই খাওয়াই ঘুম পারাই।কিন্তু আমি ছেলে বলে দিদি খেলতে নিত না।বলতে পারেন দিদিমণি তখন থেকেই একটা মেয়ের শখ আমার।এমনি করে দিন গেল দিদির বিয়ের বছর পাঁচেকের মাথায় আমারও বিয়ে দিলেন বাবা।তখন আমার বয়স এই কুড়ি একুশ।সোনাবউয়ের বয়স পনেরো। ফুলশয্যার রাতে সোনাবউয়ের কচি হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে আমি বলেছিলাম ‘বউ আমি আর কিচ্ছু চাই না,শুধু একখানা রাজকন্যে দিস আমাকে’। পনেরো বছরের ছোট্ট সোনাবউ খুব হেসে মাথা নাড়িয়েছিল।এর পরের বছরই বউ পেত্থমবার গভ্যে ধরল, আপনাকে কি বলব দিদিমণি টানা দশমাস দশদিন আমি ঠাকুরকে ডাকলাম আর বললাম আমারে রাজকন্যে দাও,আমি তারে মাথায় করে রাখব।দিদিমণি বানাবো তাকে।ডাক্তারনী বানাব। কিন্তু আমার সোনাবউ ছেলে পসব করলে।বাড়িতে আনন্দের বাণ এল।শুধু সোনাবউ আমার মনের ব্যাথা বুঝে চুপিচুপি বলেছিল ‘ভেবনা, এরপরের বারে তোমার রাজকন্যেই আসবে’। এর বছর খানেকের মাথায়ই আবার পা ভারী হল বউয়ের।
আমি আবার গীষ্যের চাতকের মত বউয়ের উঁচু পেটটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর রাজকন্যের আসার দিন গুনতাম।কিন্তু এবারেও বউয়ের কোল আলো করে এল ছেলে।আমার ছোটখোকা। বাড়িতে আবার আনন্দের বন্যা বইল,আমিও খুশিই হলুম কিন্তু মেয়ের বাপ হওয়ার সাধ মিটল না।কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগত।এরমধ্যে বউয়ের বড় অসুখ হল,অল্প বয়সে পরপর পোয়াতি হয়েছে বলে নাকি অসুখ করেছে ডাক্তার বলল।ততদিনে দিদির কোল আলো করে একজোড়া মেয়ে এসেছে।বাছারা মামাবাড়ি এলে আমি হা করে ওদের নিষ্পাপ মুখের দিকে চাইতাম,অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পরত আমার।একবার দিদি এই দৃশ্য দেখে আমার সামনে থেকে ওর ছোটখুঁকিকে বুকে নিয়ে দোর দিল।সেরাতেই খুঁকি ভারি অসুস্থ হয়ে পড়ল।বাড়িময় রটে গেল আমার চোখেই নাকি খুঁকির অসুখ হয়েছে।আমার চোখগুলো দেখেছেন দিদিমণি? সবাই বলে আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকলে নাকি সবার অন্তরাত্মাও কেঁপে ওঠে।এসকল আলোচনায় আমার বড় খারাপ লাগল।ভাবলাম আহা আমার জন্যই আজ খুঁকির এমন হল।তবে সবচেয়ে বেশি দু:খ পেল সোনাবউ।বড় ভালোবাসত আমারে সে। তারপরই কিছুটা জেদের বশেই সে ডাক্তারের বারণ অগ্রাহ্যি করে আবার পেটে ধরল।কিন্তু আমার রাজকন্যে কে জন্ম দিতে গিয়ে তার শরীর পরল ভেঙে। মাত্র,সতেরো বছর বয়সে তিনবার মা হবার ধকল নিতে পারল না তা রোগাশরীর।মেয়েটা জন্মেছিল সাতমাসের গভ্যে থাকতে।খুব অপুষ্ট ছিল কিন্তু কি অপরূপ মুখ ছিল মেয়ের!।তা মায়ের বুকের যত্ন পেলে সেই রুগ্ন মেয়েই আমার কত্ত বড়টি হত আজ!
কিন্তু ভাগ্যে না থাকলে কি আর কিছু পাওয়া যায়! মেয়ের জন্মের পরদিনই রক্তপাত হয়ে বউ চলে গেল মা খাকী মেয়েকে আমার বাড়ির কেউ বুকে তুলে নিলনা।আমার ছেলেদুটোর কি হবে তাই নিয়েই সবার চিন্তা তখন।আমি প্রাণপণ আঁকড়ে ধরেছিলাম তাকে জানেন দিদিমণি! বাপের বুকের সমস্ত মমতা উজার করে দিয়েছিলাম তার জন্যি।দুধের খুঁকি মায়ের বুকের দুধ না পেয়ে পরিত্তাহি চেঁচিয়ে কাঁদত আর বাটিতে গোলানো গরুর দুধ আর ঝিনুক হাতে বসে আমি ভাবতাম ঈশ্বর কেন আমার বুকে দুধ দিলেন না! পাক্কা বাইশ দিন বেঁচেছিল আমার রাজকন্যা।তারপর একদিন ভোররাতে তার মা আমার কোল থেকে তারে নিজের কাছে নে চলে গেল।ওই বাইশ দিন একবারের জন্যিও তারে ছেড়ে যাইনি আমি।তারে ফুল চিনিয়েছি পাখি চিনিয়েছি, গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছি।পিথিবির সক্কল আলো সক্কল ভালো তারে দিয়েছি।সে চলে গেলে বাড়ি থেকে আবার আমার বে’র তোড়জোড় শুরু করলে।না কি ছেলেদের মুখ চেয়ে বে করতে হবেই আমায়।আমার মন টানলনে,ছেলেদের দিদির জিম্মায় দিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পরলাম।তখন থেকে পথই আমার বাড়িঘর।যা পাই তাই খাই,লোকের ফাইফরমাশ খাটি।আর দিন শেষে আমার রাজকন্যের ছোট্ট নিমাখানা বের করে দেখি,গন্ধ শুকি।এটুকুই আমার মনের আরাম,ঘর ছেড়ে আসার সময় এটুকুই সংগে করে এনেছিলাম।আজ সকালে একজনের ফরমাশ খাটতেই গিয়েছিলাম হাসপাতালে।
ওখানে গিয়ে কি মনে হতে পসুতিদের ঘরে ঢুকে একটা ছোট্টমেয়েকে কোলে তুলে নিলাম।একদম যেন আমার রাজকন্যা।সেই মুখ সেই চোখ,গায়ে সেই গন্ধ।আমি প্রাণপণ গন্ধ নিচ্ছিলাম,আমার শরীল মনে খুব শান্তি হচ্ছিল জানেন দিদিমনি! তখনই ওরা দেখে ফেলে খুব চিৎকার করতে লাগল।খুঁকিকে ছিনিয়ে নিয়ে মারতে লাগল আমি কত বললাম আমি ছেলেধরা না গো,আমি বাপ বিশ্বেস কর! কেউ বিশ্বেস কল্লে না দারুন মার মারতে লাগল।এর আগেও দু একবার এমন হয়েছে।কেউ মানতেই চায়না যে আমি বাপ।ছেলেধরা নই।” এতখানি একটানা বলে হাঁফাতে লাগল লোকটা।আমি হহতবাক হয়ে বসে আছি দেখে সে আবার উজ্বল মুখে বললে-“আমার রাজকন্যে বেঁচে থাকলে আজ আপনার মত হত গো দিদিমণি! আমি কিছু বলতে পারলাম না।যান্ত্রিক ভাবে লোকটাকে সিডেটিভ দিয়ে উঠে গেলাম।রোগীকে শুশ্রূষা করলেও তাদের সাথে অতিরিক্ত একাত্ম হওয়া আমাদের নীতিবিরুদ্ধ।
লাঞ্চের সময় আমার সসহকর্মী আশাদি বলল -“কিরে ছেলেধরা টা অত কি বলছিল তোকে?” আমি শুকনো হেসে বললাম-“লোকটা ছেলেধরা নয় আশাদি,লোকটা বাপ “।