আচ্ছা ঠিক হ্যে

আচ্ছা ঠিক হ্যে

আমি শ্রীমতি দিশারী মুখার্জি। ছোটবেলার ইচ্ছা পূরণ করে, অনেক বৈপরীত্যের সাথে সংগ্রাম করে আমি এখন একজন শিক্ষিকা। শিক্ষা – যা সবার মৌলিক অধিকার। আমার আপনার প্রত্যেকের।

কলকাতার এক স্বনামধন্য ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলে আমি সায়েন্স পড়াই। অগণিত ক্লাস রুমের একটি রুমে বসে আমার এক ছাত্র রিতম গুপ্তা, যার গভীর চোখদুটো দেখলে বোঝা যায় জীবন ওর দিকে অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ছেলেটির প্রোফাউন্ড লেবেল হিয়ারিং লস্। যদিও ওর ছোটবেলাতেই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট হয়েছে এবং ওর স্পীচ ও অনেকাংশে পরিষ্কার কিন্তু তাও যেন কোথাও একটা কিন্তু ওর জীবনের চতুর্দিকে জাল পেতে রেখেছে। রোজ ক্লাসে এসে ঢুকলে সবাই যখন ‘গুড মর্নিং ম্যাম’ বলে ও তখন শুধু মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে আমায় ওয়েলকাম জানায় । ওর নিঃশব্দতা যেন বেশি করে আমার কানে বাজতো। একদিন ওর পাশে দাঁড়িয়ে তাই বললাম যে আমি কি ওর মুখ থেকেও সবার মত ‘গুড মর্নিং ম্যাম’ টা শুনতে পাব?? ও হেসে খুব নীচু স্বরে বলল ‘আচ্ছা ঠিক হে’।

সচরাচর কোন কথা সেভাবে বলত না ও শুধু পড়ার কথা ছাড়া। ওর চেষ্টাও আমি দেখেছি। টিফিন টাইমে অনেক সময় ও সবার সাথে মিলে খেলতে চাইত কিন্তু পরক্ষণেই ওকে সবাই আউট আউট বলে সরিয়ে দিত। ও আবার ক্লাসে এসে বইখাতা খুলে বসে পড়তো। না, ও সব সময় যে পড়তো তা না হয়তো এই তিরস্কারের হাত থেকে রেহাই পাবার আশায় বইয়ের সাথে বন্ধু বন্ধু খেলা খেলতে থাকত। আমি অনেক সময় এই ব্যাপারগুলো ক্লাস রুমে বসে থেকেই খেয়াল করতাম যখন কোন কোন দিন টিফিন ব্রেক এও আমাকে ক্লাসে বসে থাকতে হত। এটা এই স্কুলের নিয়ম যে ক্লাস টিচার এবং এ্যাসিসটেন্ট ক্লাস টিচার অলটারনেট করে একজনকে টিফিন টাইমেও ক্লাসে থাকতে হয়।

একদিন ওর অঙ্ক খাতা চেক করে যখন ওকে দি ওর মান্ডে টেস্টের, ও নম্বর দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। আমি ভাবতে পারিনি ওর বুকে এত বড় এক সমুদ্র বাঁধা আছে। আছড়ে পরেছিল সেদিন ওর চোখের জল। প্রথমবার সেদিন মনে হয়েছিল ওর এই হার তো শুধু ওর নয়, আমারও। কিন্তু কি করে কিভাবে এর সমাধান করা যেতে পারে কারন ওর যে language development সংক্রান্ত সমস্যা। ও যেটুকু বুঝতে সক্ষম ও সেটুকু খুব সুন্দর ভাবে করতে পারে, কিন্তু এখনও যেগুলো ওর কাছে আবছা সেগুলো কি করে ভেদ করে ওকে আগে নিয়ে যাওয়া যায়! পেরেন্টস টিচার মিটিং এ আমি ওর মায়ের সঙ্গে এই পুরো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। বুঝতে পারি ওর এগোনটা সম্ভব তখনই হবে যখন ওকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগটা ওর বাইরে আমাদের সকলের মধ্যেও আসবে।
অন্যান্য টিচারদের কাছে তখন আমি ‘তারে জমিন পর’ এর নিকুম্ভ স্যার। বিশ্বাস করুন যদি সত্যি আমি তাই হোতাম, আমি যদি নিজে ঐ এক সমস্যার স্বীকার হতাম হয়তো তা সমাধান করা সহজ হয়ে যেত কিন্তু এই সমস্যা থেকে মুক্তির সমাধানের মন্ত্র যে আমার সিলেবাসের বাইরে ছিল। শুধু একটাই রাস্তা ছিল আমার। সেটাই ধরলাম। প্রিন্সিপালের সাথে ডিসকাস করলাম যাতে কিছু স্কুলের মত আমাদের স্কুলেও স্পেশাল টিচার রাখা হয়। এত তো রোজ রোজ স্কুলে নিত্য নতুন সুবিধা সংক্রান্ত জিনিস বাড়ানো হচ্ছে। সেন্ট্রাল এ সি করা হচ্ছে অথচ যেটা করলে হয়তো রিতমের মত যারা অনেকে আছে তাদের হেল্প হবে সেরকম কিছু করা গেলে সেটা আরো ভালো হবে স্কুল ও স্টুডেন্ট উভয়ের ক্ষেত্রেই।

না… আমার কোন কথাতে সেদিন স্কুলে কোন কাজ হয়নি। ট্রাস্টিরা ঐ ফেসিলিটি দিতে মন্জুরি দেন নি। কিন্তু আমি থামিনি। অনেক লড়েছি আমি নিজের সাথেও। মনে হত এক একবার কেন আমি ওর জন্য এতটা চিন্তা করছি কিন্তু পরক্ষণেই মনে হত কেন আমি চিন্তা করব না! একটু যদি হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দি তাহলে তো ওর সাহসটা বাড়বে বৈ কমবে না। শুধু পয়সা রোজগারের জন্য আমরা স্কুলের পরেও কোচিং করাই আর তার জায়গায় ঐ দশটা স্টুডেন্ট কে ছেড়ে কি ওর জন্য আর একটু বেশি সময় দেয়া যাবে না? তবে এই চিন্তাটাই যথেষ্ট ছিল না। আরো একটু বেশি কিছুর দরকার ছিল। সেই দরকার টা শেখার জন্য আমার কমপ্লেক্সের এক বন্ধুর সাহায্য নিলাম। ও অডিওলজিস্ট পঙ্কজ সরকার। ও আমার কথা শুনে বলল ওর ক্লিনিকের স্পেশাল টিচারদের কথা। না কোন ফর্মাল ট্রেনিং আমি নিইনি কিন্তু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলাম রিতমের পেরেন্টস দের সাথে। আমি শুধু ওর থেরাপির টাইমে স্কুলের পর ওদের সেন্টারে যেতাম।অনেক কিছু শিখেছি আমিও আর তবেই গিয়ে রিতমকে পরে ওর মত করে বোঝাতে পেরেছি।

আজ ওর বোর্ডসের রেজাল্ট বেরিয়েছে। সেভেন্টিটু পার্সেন্ট পেয়েছে কিন্তু আমি জানি এর পিছনে কতটা পরিশ্রম ও করেছে। আজ আমায় আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে গেছিল। এই পাঁচ বছরে আমি একসময় ওর বন্ধু হয়ে গেছিলাম। আর কেউ তখনও সেভাবে ওর সাথে বসে কথা বলার মত ছিল না। তাই বোধহয় অনেকটা বেশি নির্ভর করতে শুরু করেছিল ও আমার উপর।আর ওর আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে উঠেছিল নিজের প্রতি। আজ অনেকদিন পর ওর চোখে জল দেখলাম। জিজ্ঞেস করাতে বলল ‘ম্যাম আই উইল নেভার মিস মাই স্কুল বাট আই উইল মিস ইউ’ বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। নিজেকে শক্ত রেখে বললাম ‘স্কুল ইস ওভার বাট ইউ হ্যাভ টু গো ফার এ্যাওয়ে, ইউ হ্যাভ টু টাচ্ দা স্কাই।’ ও হেসে আবার একই ভাবে বলল প্রথমবারের মত মাথাটা নীচু করে ‘আচ্ছা ঠিক হ্যে’।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত