দেওয়া নেওয়া

দেওয়া নেওয়া

প্রানপ্রিয় দিব্য,

চিঠির প্রথমেই তোমাকে জানাই এক আকাশ ভালোবাসা।তোমাকে না দেখে কিভাবে যে দিন কাটছে তা বর্ণনাতীত,এদিকে বাড়ি থেকেও বিয়ের চাপ ক্রমশ বাড়ছে।ছাব্বিশ বছরের সোমোত্ত মেয়ে বাড়িতে বসে থাকলে নাকি মা বাপের মুখ দেখে না সমাজ!?। জানো এই মাসে আরও দুটো টিউশনি নিয়েছি,বাবার ওষুধের খরচ বাড়ছে দিনদিন দাদাটা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে এই ছয়জনের সংসার চালাচ্ছে,মেয়ে হিসেবে আমারও যে দ্বায়িত্ব থাকে কিছু! আমি হিসেব করে দেখেছি বিয়ের পরে যদি এমন পাঁচ ছটা টিউশন করতে পারি তাহলে বাবার ওষুধ কিনে দেওয়ার পরেও আমাদের সংসারে কিছুটা দিতে পারব।তোমার একার ওপর চাপ পরবে না।তুমি কিছু একটা কর লক্ষীটি,আমার পরে ছুটকিও যে আছে!
ভালোবাসা নিও।

ইতি, তোমার নীতা

প্রিয়তমাষু নীতা,

চিঠির প্রথমেই জানাই একরাশ হলুদ পলাশের উষ্ণ ভালোবাসা।কতদিন তোমাকে দেখি না! ভাবতে বসলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।কাজে মন বসে না।এদিকে এমন অবস্থা যে বাড়িতে চারজনের সংসার ঠেলে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারছি না। তিন্নিটার বিয়ের বয়স হল,এই অঘ্রাণে ওকে পাত্রস্থ না করলেই নয়।মা শয্যাশায়ী আজ বহুদিন এই ঘুপচির সংসারে এসে তোমার মত শহুরে মেয়ের বড় কষ্ট হবে! তবুও একদিন স্বপ্ন দেখি লাল টকটকে শাড়ি পড়ে তুমি একমাথা সিঁদূর দিয়ে আমার বাড়িতে গৃহলক্ষ্মী হয়ে বিরাজ করবে।বাড়িতে আর কটা দিন ঠেকিয়ে রাখো।এক কাজ কর কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হয়ে যাও,আজকাল বহু জায়গাতেই সরকারি খরচে কম্পিউটার ট্রেনিং দেয়।এতে চাকরির রাস্তাও খোলা থাকবে আর অন্তত বাড়িতে ছ’মাস একবছরের মত বিয়ের কথাও চাপা দিতে পারবে।অনেক আদর নিও।

ইতি তোমার দিব্য।

প্রানপ্রিয় দিব্য,

অনেক ভালোবাসা নিয়ে চিঠি শুরু করছি।কম্পিউটার ট্রেনিং শেষ হল আজ মাস দেড়েক।ওরা বলেছিল চাকরি দেবে কিন্তু তারজন্য পাঁচহাজার টাকা জমা দিতে হবে।ওত টাকা পাব কই বল? তাই আর ওই রাস্তা মাড়াইনি।থাক সার্টিফিকেট তো রইলই!বিয়ের পরে দেখা যাবে বল? ছুটকি টা গত হপ্তায় পাড়ার এক বখাটে ছেলের সাথে পালিয়েছে,আমি শাসন করতে বলেছে আমার বিয়ের আশায় থাকলে না কি ওর বিয়েই হত না আর!। আশ্চর্য ব্যাপার মা বাবা ও চুপ থাকল,তবে কি ওরাও তাই ভাবে? ভালো থাকুক ছুটকি।জন্ম এয়োতি হোক।দাদা এই মাস থেকে সংসারে টাকা কম দেবে বলেছে,একটা পেট কমেছে যখন!। পাড়ার লোকে বলে দাদা খারাপ পাড়ায় যায়, সেখানেই কি তবে এখন থেকে বাড়তি টাকা টা ওড়াবে? কে জানে! তুমি কিছু কর দিব্য, আমি তোমার ঘুপচি ঘরের সংসার আলো করে দেব দেখ। অনেক অনেক চুম্বন রইল।

ইতি,
তোমার নীতা

প্রিয়তমাষু নীতা,

তোমার অবস্থার বর্ণনা পড়ে খুব মনোকষ্টে আছি।এমন অক্ষম প্রেমিক আমি,যে বুক ভরা ভালোবাসা টুকু ছাড়া আর কিছুই দিয়ে উঠতে পারব না তোমায়!।সিঁথির সিঁদূর টুকুও না। হয়ত খুব নিষ্ঠুর শোনাবে কিন্তু এটাই সত্যি যে কোনও কোনও ভালোবাসার কোনও পরিণতি হয় না! হয়ত আমাদের মত ছেলেমেয়েদের প্রেম বিবাহের স্বপ্ন দেখাই বাতুলতা। প্রায় মাসখানেক ধরে বাবার কাশি কমছিল না,ডাক্তার টেস্ট দিয়েছিলেন কয়েকটা খুব দামী।পরশু রিপোর্ট এসেছে।রাজরোগ। জানিনা চিকিৎসা কিভাবে করাব! হয়তো শেষ সম্বল এই বাড়িটাও বিক্রি করতে হবে। পুত্রকর্তব্য বলে কথা! তিন্নিটার বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গেছিল জানো! ব্যাবসায়ী ছেলে। ভালোঘর ছিল।ভালো থাকত বোন টা আমার।একটা দু চাকা চেয়েছিল শুধু। হয়েই যেত বিয়েটা বুঝলে,তারপরই তো সব ওলোটপালট হয়ে গেল! সেই থেকে তিন্নিটার মুখভার,চোখলাল।কাল একবার শহড়ে যাব, দেখি যদি ছেলের বাবার হাত পায়ে ধরে রাজি করাতে পারি,বাইকের কিস্তিটা নাহয় মাসে মাসে চালাব!আমাকে ক্ষমা করে দিও নীতা তোমার অক্ষম প্রেমিক তোমায় হয়ত জাগতিক কোনও সুখই দিতে পারব না কখনও। আমার এই সর্বনেশে জীবনের সাথে নিজেকে জড়াতে যেও না, তুমি বরং একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে নাও।রাজরানি হও তুমি এই আশির্বাদ করি।

ইতি তোমার একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী
দিব্য।

প্রাণাধিক দিব্য,

এই বেশ ভালো হল বুঝলে,রবি ঠাকুর বলেছেন যাকে ভালোবাসবে তাকে কখনও বিয়ে করবে না। স্বয়ং বিশ্বকবি যখন বলেছেন তার নিশ্চয়ই কোনও কারণ থাকবে বল!? আমার চিরকালের প্রেমিক – প্রেমিকা হয়েই থাকলাম না হয়।চারিদিকের এত দ্বায়িত্ব কর্তব্যে ভরা সম্পর্ক গুলোর মধ্যে আমাদের প্রেম টুকু না হয় বেঁচে থাকুক নি:স্বার্থ হয়ে।গত হপ্তায় দাদা খারাপ পাড়ার মেয়েটার বাড়ি গিয়ে উঠেছে।সংসারে আর একটি টাকাও দেবে না বলে দিয়েছে।এদিকে সারা শরীরে মারের দাগ আর পেটে চারমাসের বাচ্চা নিয়ে ছুটকি ফিরে এসেছে।ওর বর নাকি আবার বিয়ে করেছে।মরতে গেছিল জানো পাগলিটা! জোর করে নিয়ে এসেছি।আমার বিয়ের জন্য একজোড়া কানের দুল বাবা বহু আগে গড়িয়ে রেখেছিল সেটাই ভেঙে হাজার দশেক টাকা পেয়েছি।ওদের কথা মত পাঁচহাজার জমা রেখেছি।সামনের মাসে জয়েনিং।আপাতত হাজার তিনেক করে দেবে,পরে বাড়বে বেতন।আর টিউশনি তো আছেই! চলেই যাবে এই কটা পেট বল?বাকিটাকা ছুটকির বাচ্চার জন্য রাখা থাকল।ওর যাতে কোনও কষ্ট না হয় সেটা দেখতে হবে তো! বাচ্চাটা হয়ে গেলেই ছুটকিকে কলেজে ভর্তি করব আবার,কি বা বয়স ওর। ছানাটা কে বুকে করেই কাটিয়ে দেব বুঝলে!।মানুষের মত মানুষ করব ওকে।মনে আছে তুমি বলতে আমাদের প্রথম সন্তানের নাম রাখব টুকটুক? সে নামেই ডাকি আজকাল ছুটকির বাচ্চাটা কে।মাসি তো মা’ই হল।ওকে বুকে করেই সব কষ্ট সহ্য করতে পারব জানো!। তুমি ভেব না। তিন্নিটার বিয়ে ভালো হয়েছে জেনে খুশি হলাম খুব।ভালো থাকুক ও।স্বামী সোহাগ যেন পায়।শুনলাম তোমাদের বাড়িটা হালদারেরা কিনবেন,ভালো কথা।বাবার চিকিৎসার কোনও ত্রুটি যেন না হয়।টিউশনি করে দুশো চারশ জমাচ্ছিলাম, সেখান থেকে কিছু টাকা পাঠালাম।সাবধানে থেক তুমি আর ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখ।এক দিন সব ভালো হয়ে যাবে তখন আবার আমরা বসন্তের শেষ বিকেলের আলো গায়ে মাখতে মাখতে বহু রাস্তা হাঁটবো হাতে হাত রেখে।ততদিন এই অনন্ত অপেক্ষা চলুক!। আমার এই ব্যার্থ জীবনের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিলাম তোমায়।ভালো থেক।

ইতি শুধুমাত্র তোমারই নীতা।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত