ছুটিতে বাড়ি আসার পরের কয়দিন রিক্সা চালাতে হয়।প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগতো,রাগও হত খুব।আমি কষ্ট করে পড়ালেখা করছি কি রিক্সা চালানোর জন্য!এ কথা বুড়ো বাপকে বোঝাতে পারলেও মাকে বোঝানো হত মুশকিল।তার এক কথা,বাজান তুমার বাপের শরীলডা ভালা না।কয়দিন যদি কষ্ট না করো টাকা কেমনে পাবা? কয়দিন পরই সেমিস্টার ফি জমা দিতে হবে।সাথে রিপার ঘ্যানঘ্যানানি তো আছেই।গত মাসে ইয়ারিং কিনে দেয়ার পর এই মাসে একটা শাড়ির বায়না ধরেছে।ওহ, রিপা আমার গার্লফ্রেন্ড।
ওক ে যে কতটা ভালোবাসি নিজেও জানি না।রিপাও বোধহয় ভালবাসে আমাকে।খুব কষ্টের পর পটেছে।প্রথমে তো পাত্তাই দিত না।তারপর টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে রোজ এটা সেটা গিফট করার পর রাজি হয়েছে।যদিও ও জানে না আমার বাপ রিক্সা চালায়।জানলে হইতো ব্রেকআপও হয়ে যেতে পারে।রিপা যা দেমাগি মেয়ে,তাতে এটাই স্বাভাবিক। শুধু ও না,আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সজীব সহ কেউই জানে না এ কথা।লজ্জা লাগে নিজের দৈন্যতা প্রকাশ করতে।যেদিন এগুলো প্রকাশ পাবে সেদিন কি হবে জানি না।আমাদের জীবনের এই ব্যাথাগুলো অনেকটা কুয়াশার চাদরের মতো।যখন কেউ পাশে থাকে তখন এটা উপভোগ করতে হয়।আর একা থাকলে দুর্ভোগ।
এ মাসের টিউশনির টাকা রিপার শাড়িতে চলে গেছে।তাই সেমিস্টার ফী নিতে বাড়ি আসা। এসে দেখি বুড়ো বাপ জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে।ওষুধও কেনা হয় নি।সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা।অগত্যা মা-র কথায় আমাকেই রিক্সা নিয়ে বের হতে হলো।
কোথাও বোধ হয় পড়েছিলাম,জীবনের মানে কখনো সমাজের ওপরতলায় বসে খুঁজে পাওয়া যায় না।ইহা নীচতলার অধিবাসী।এসির বাতাসে ঘাম শুকিয়ে না,বরং মাথার ফোঁটা ফোঁটা ঘাম পায়ের উপর পড়ার মধ্য দিয়েই জীবনের সেই মানেটা স্পষ্ট হয়।আজ মানেটা স্পষ্ট হচ্ছে।এক ঘন্টাও হয় নি,জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে। লোকলজ্জার ভয়ে মুখ বেঁধে রিক্সা চালাই।কিন্তু বিপদটা আসলো পিছন দিক থেকে।টাকা গুনছিলাম,এমন সময় কেউ ডাক দিলো।
-এই মামা যাবেন?
পিছনে তাকিয়ে দেখি আমার প্রাণের বন্ধু,সজীব।ওকে আমার এই প্রত্যন্ত এলাকায় দেখে অবাকের উপরে যা হওয়ার থাকে সেটাই হয়েছি।তবে আমাকে চিনেছে বলে মনে হল না।শতছিন্ন পোশাক,ঘর্মাক্ত কাপড়ে বাধা মুখ, এ অবস্থায় আমাকে ভাবতে না পারাটাই স্বাভাবিক।ও আবার জিজ্ঞাসা করলো,মামা দরগার মোড় যাবো।কত নিবেন?আমি কি করবো বুঝতে না পেরে ইশারায় ত্রিশ টাকা দেখালাম।সাধারনত পনের টাকা ভাড়া হলেও বিপদ ত্রিশ টাকাতেই রিক্সায় চেপে বসলো।কি আর করা।ওকে কোনভাবে বুঝতে না দিয়ে আস্তে আস্তে নিজেকে লুকিয়ে রিক্সা চালানো শুরু করলাম।
দুই মিনিট পর দেখলাম,না মানে শুনলাম ও কাউকে চৌরাস্তার মোড়ে আসতে বলছে ফোনে।বিপদ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।কারণ জায়গাটা আমার বাড়ির কাছেই।ওরা যদি আমার রিক্সাআলা পরিচয় জানতে পারে তাহলে হইতো আমার সাথে আর বন্ধু্ত্বই রাখবে না।সমাজের উপরতলার মানুষ ওরা।ওরা সব পারে।
দরগার মোড়ে আসার পর একটু স্বস্তি পেলাম।ভালোয় ভালোয় বিপদ ঘাড় থেকে নামলেই বাঁচি।সজীবকে বেশ ব্যস্ত মনে হলো।তাড়াহুড়ো করে আমার হাতে টাকাটা দিয়েই একটা গলির ভিতরে ঢুকে গেলো।তবে স্বস্তি না, এবার আমার অবাক হওয়ার পালা,কারণ আমার হাতের মুঠোয় এখন পাঁচটা এক হাজার টাকার নোট।ওকে ডাকবো নাকি ডাকবো না ভাবতে ভাবতে ফোনে একটা এসএমএস আসলো। কি লেখা ছিলো!?!”শালা মুখটা তো বেঁধেছিস,কিন্তু তোর ঘাড়ের জন্মদাগটা ঢাকিস নি কেন?হলে আয়, তোর খবর আছে!!”
আসলেই ওরা সব পারে।আর সমাজের সেই ওপরতলার লোকগুলো যদি সত্যিকারের বন্ধু হয় তাহলে তো কথায় নেই।মায়ের অনুপস্থিতিতে শাসন,বাবার অনুপস্থিতিতে বারণ থেকে শুরু করে কি খেয়েছি,কি পরেছি সহ প্রতিটা মুহূর্তের নিঃস্বার্থ সঙ্গি বন্ধু। বন্ধুরা সব পারে। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো।কিন্তু তা হলো না।ক্লান্ত,ঘর্মাসক্ত দেহে সন্ধ্যাবেলা যখন বাসায় ফিরলাম তখন আমার মাথায় শুধু আকাশ না পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভেঙে পড়েছে।রিপা বসে আছে আমার মলিন চৌকিটায়।আমি ওকে কিছু বলবো এমন সুযোগ না দিয়ে উঠে এসে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।তবে সেদিকে আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।মায়ের শরীরে ওকে দেয়া শাড়ি আর ইয়ারিং দেখে দুনিয়ার সব চাইতে সুখি মনে হচ্ছে নিজেকে।
-বাজান,এতদিনে তুমি একটা কামের মতো কাম করছো।
-ও কিছুই করে নি আম্মু।
সজীব ওর ডাইরি না পড়লে আর আমাকে কিছু না জানালে কিছুই হত না। মা-য়ের চোখে তখন সুখের হাসি ঠিকরে বের হচ্ছে।নাহ,মনের মতো বৌমা পাবার ভাললাগায় নয়;হইতো ছেলের সুখী দাম্পত্যজীবনের কথা ভেবে।মায়েরা নিজের কথা ভাবে না।আজ আমার সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।এখনো আফসোস করার সুযোগ পাই নি।
ভালোবাসার মহত্ত্ব টা বোধ এখানেই,কোন অতৃপ্তি থাকে না।সেই সাথে উপরতলা-নিচতলার প্রভেদটাও থাকে না।থাকে শুধু একরাশ ভরসা আর প্রাপ্তির চরম পরিণতি।সজীবকে একটা এসএমএস দিতে হবে।কি লিখবো!?!”শালা আমার ডাইরি পড়লি কেন,হলে আসি তারপর দেখ কি করি!”