চাঁদ দেখা

চাঁদ দেখা

আমার যে গার্লফ্রেন্ড গাজীপুর টঙ্গি কলেজ গেট থাকে, সে দুনিয়ার কিপ্টা একটা মেয়ে।। টাকা-পয়সাকে একদম যক্ষের ধনের মত আগলে রাখে।। নীলু নামের মেয়েটার মধ্যে নীলের কোন বালাই নাই, তার নাকি বরং নীল রঙ অপছন্দ।। তো গতকাল রাতে নীলু আমাকে আচমকা কল করে বলে- শুনো তুমি একটু রাতের দিকে আমাদের বাসায় আসতে পারবা?? ছাদে বসে দুজন চাঁদ দেখবো, আমার অনেক দিনের শখ একসাথে চাঁদ দেখার।। আব্বু-আম্মু ঘুমে থাকবে, আমরা ছাদে চলে যাবো।

আমার কাছে ব্যাপারটা খুব রোমাঞ্চকর মনে হলো, শুনেই শরীরের মধ্যে অন্যরকম একটা উত্তেজনা হচ্ছে।। আমি যথারীতি আমার আগারগাঁয়ের বাসা থেকে সন্ধ্যায় রওনা দিলাম।। রাত প্রায় ৯ টার দিকে বাস থেকে নামলাম কলেজ গেট।। আমি নীলুদের বাসা বেশ ভালো করেই চিনি, এর আগে কয়েকবার ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম।। ভাবলাম, ওর বাসায় যাবার আগে নীলুর জন্যে দোকান থেকে কিছু কিনে নিয়ে যাই, ছাদে বসে একসাথে খাওয়া যাবে।। আশেপাশে তাকিয়ে বড় একটা দোকান দেখলাম, আস্তে আস্তে হেঁটে সেখানে গিয়ে দেখি বেশ ভীড়।। আমি একটু খালি হবার অপেক্ষা করছি।

এক পিচ্চি মেয়ে সম্ভবত তার বাবার কোলে বসে, দোকানী ব্যাটাকে বলছে- আংকেল আংকেল শুনো, আমি বড় হলে তুমি কি তোমার ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিবা?

দোকানী কথাটা শুনে বেশ মজা পেলো মনে হচ্ছে, আমিও মুগ্ধ হয়ে পিচ্চির কথা শুনলাম। দোকানী মাথা নেড়ে সজোরে বললো- অবশ্যই দিবো মা মনি, কেনো নয়, এত কিউট বাবু তুমি।

মেয়েটা এবার আরো আল্লাদী ভঙ্গিমায় বললো- তাহলে তোমার হবু পূত্রবধূকে দুইটা আইসক্রিম ফ্রি দাও তো এখুনি।
পিচ্চির কথা শুনে আমি থ, দোকানীও থ, বাচ্চাটা যার কোলে ছিলো শুধু সে হাসছে।

আমি কোনরকম ফাঁকতালে দুই প্যাকেট এনার্জী প্লাস বিস্কুট কিনে নিয়ে দোকান থেকে বের হলাম।। নীলুকে কল দিলাম, সে বললো- তার ফোনে নাকি টাকা নেই, মিসড কল দেবার ব্যালেন্সও নাকি নেই।। আমি যেনো বাসার নিচে গিয়ে দাঁড়াই, সে সময়মত তিনতালার বারান্দা থেকে নিচে একটা কয়েন ছুঁড়ে দিবে, আমি তখন সিঁড়ি বেয়ে উঠে সোজা ছাদে চলে যাবো, তারপর সে ছাদে আসবে।

এই মেয়ের ফোনে জীবনেও ব্যালেন্স থাকে না। এ আর নতুন কি!!
কথামত আমি নীলুর বাসার নিচে গিয়ে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে রইলাম, বেশ খানিকক্ষণ পর উপর থেকে সে কয়েন ছুঁড়ে ফেললো।। কয়েন পড়ার ঝনঝন শব্দে মনে হলো, কয়েনটা আমার পাশেই পড়েছে।। ভাবলাম, নীলু যে কিপ্টা মেয়ে কয়েনটা খুঁজে নিয়ে যাই খুশিই হবে। প্রায় ১০মিনিট অন্ধকারে তন্য তন্য করে কয়েন খুঁজলাম, পেলাম না কোথায় পড়লো কে জানে!! তারপর নীলুকে আবার কল দিলাম- সে আমাকে প্রচন্ড ধমকের সুরে বললো, অই ছাগল তুই ছাদে আসিস না কেন?

আমি বললাম- আরে বাবা, তোমার কয়েনটা খুঁজতেছিলাম, ভাবলাম টাকা-পয়সা কি ফেলে দেয়ার জিনিস।।
নীলু এবার আধো আধো গলায় বললো- ও বাবা গো, তুমি কত লক্ষী।। কিন্তু, আমাকে কি এত বোকা পাইছো, আমি কয়েন সুতা দিয়ে বাইন্ধা তারপর নিচে ফালাইছি, পরে টান দিয়া উঠাই নিছি।। তবে শুনো যে ভাবে রাস্তা ঘাটে আজকাল কয়েন পড়ে থাকে, এই এতক্ষণে খুঁজলে অন্য মানুষের কয়েন তো দুই একটা পাওয়ার কথা, পাইছো কিছু?

আমি নীলুর কথা শুনে একদম স্তব্ধ, এই মেয়ের কিপ্টামীর লেভেলের যাস্ট কল্পনাতীত!
আমি ফোন রেখে, দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম।
গিয়ে দেখি নীলুর কোলে একটা ছোট্ট কুকুর ছানা, বুঝলাম না, এই কুকুর সে কই পাইলো!
আমি নীলুকে দেখেই বললাম- এই কুত্তার বাচ্চা কই পাইলা?

নীলু আমার মাথার মধ্যে জোরেসোরে গাট্টা মেরে বললো- খবরদার শোভন, এটাকে কুত্তার বাচ্চা বলবা না, এটার নাম টমি।। দেখছো কত কিউট, কত্ত সুইটা, একদম মায়া মায়া পুতুপুতু।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, এই আদরগুলোর আশায় আমি সেই ঢাকা থেকে এত ঝুঁকি নিয়ে এখানে ছুটে এসেছি, এখন দেখি সব আদর কই থেকে আমদানী কথা কুত্তার বাচ্চা টমির জন্যে।

ছাদে বসে নীলুর হাতে দুই প্যাকেট এনার্জী প্লাস বিস্কুট দিলাম, সে একটা সাইডে রেখে দিয়ে বললো- এইটা বাসায় নিয়ে যাবো, পরে একসময় খাবো।। আর এই প্যাকেট চলো খাই।

এদিকে চাঁদ দেখার জন্যে আসা অথচ চাঁদ কি দেখবো, আকাশ প্রায় অন্ধকার, মাঝে মাঝে একটু আকটু মেঘ ভেদ করে চাঁদ উঁকি দেয়, আবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে।

নীলু বেশ সাজগোছ করে এসেছে, হঠাৎ আমাকে বললো- শোভন আমাকে কেমন লাগছে বলো তো?
আমি বেশ ভেবে বললাম- একদম টমির মত লাগছে।

নীলু গাল চোখ মুখ ফুলিয়ে বললো- ফাইজলামী করো আমার সাথে, আমাকে একটা কুত্তার সাথে তুলনা করলা।।
আমি হেসে হেসে বললাম- হ, তুমি কত কিউট, কত্ত সুইটা একদম মায়া মায়া পুতুপুতু, টমির মতই তো!!
নীলু কোন কথা খুঁজে পেলো না।

কিছুক্ষণ পরে নীলু আবার খুব আল্লাদী কণ্ঠে বললো- আচ্ছা, শোভন আমি তোমার কি গো?
আমি সাথে সাথেই বললাম- তুমি আমার পৃথিবী!!
নীলু আরো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো- তাই বুঝি, তা তুমি আমার জন্যে কি কি করতে পারবে বলো তো??
আমি এবার ভেবে বললাম- আমি তোমার জন্যে পুরো দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে পারবো।।
নীলু ঠোঁট উল্টিয়ে বললো- কিন্তু তুমি তো শুধু আমার সাথেই লড়াই করো, আমার সাথেই ঝগড়া করো।।
আমি বললাম- তাই তো নীলু, বললাম না তুমিই আমার দুনিয়া, তুমিই আমার পৃথিবী।।
নীলু আবার চুপ মেরে গেছে।।
খানিক বাদে নীলু আবার বললো- জানো শোভন, আমার বাবা কি বলে??
আমি বললাম- কি বলে?

-বলে জানিস নীলু, আজকাল তোর মায়ের থেকে তোর মায়ের কাপড় চোপড় আমাকে বেশি সম্মান করে।।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম- মানে, কাপড় চোপড় সম্মান করে মানে?
নীলু হাসি হাসি মুখে বললো- আমিও বাবাকে বললাম, মানে কি আব্বু? আব্বু বলে, এই দেখ না আমি যখনি কোন দরকারে আলমারী খুলি, তোর মায়ের দুই-তিনটা কাপড় লাফ দিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে পড়ে।।
আমি হো হো করে হেসে দিলাম, মানে নীলুর বাবা নিশ্চই খুব রসিক মানুষ।। কিন্তু যত রসিক ব্যক্তিই হোক না কেনো, আমাদের যদি এই অবস্থায় দেখেন, উনি আমার রস সব বের করে দিবেন।।

আমি বললাম- নীলু শুনো, পুরুষ মানুষ সে যাই হোক না কেনো, বউ দেখে ভয় পাবেই।।
এই ধরো, পুলিশ বেটা, তারে দেখে সাধারণ মানুষ ভয় পায়, কিন্তু সে নিজে বাসায় এসে বউয়ের ভয়ে থরথর করে কাঁপে।

আবার ধরো, ডাক্তার সে সারাদিন মানুষের চিকিৎসা করে, কিন্তু বাসায় দেখা যাবে বউ তার চিকিৎসা করছে।।
শিক্ষক ধরো স্কুল-কলেজে সারাদিন লেকচার দেয়, ঘরে এসে বউয়ের লেকচার শুনে।
নীলু খানিক ভেবে বললো- আচ্ছা, আর তোমার মত যারা সাংবাদিক তারা?
আমি বললাম- তারা আর কি, সারাদিন চারদিকের খবর নিয়ে থাকে, ঘরে এলে নিজেরই খবর হয়ে যায়।

“আমি কিন্তু ভয় পাই না, বউ দেখে একদম ভয় পাই না।”
বুঝলাম না, পিছন থেকে মনে হলো মোটা একটা কর্কশ অপরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসলো। ভূত টুতের কোন কারবার কিনা? একটু ভয় পেলাম বটে, তবে পিছনে তাকাবো তাকাবো করে আমি নীলুর দিকে তাকালাম।
দেখি নীলু জমে বরফ হয়ে আছে, আতঙ্কিত চেহারা।

আসলে ঘটনাটা আমার উত্তম পুরুষে লিখা, তাই লিখেছি, মোটা কর্কশ অপরিচিত কণ্ঠ।। কিন্তু এই ঘটনাটা যদি নীলুর বর্ণনায় থাকতো, সে হয়তো লিখতো।। আচমকা পিছন থেকে বাবার কন্ঠ ভেসে এলো।।

কারো যদি আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে থাকে, তবে ঢাকা মেডিকেলের দুই তালার ২২০ নাম্বার ওয়ার্ডের পেয়িং ৩ নাম্বর বেডে এসে দেখা করে যেতে পারেন।। কিন্তু, দয়া করে গাজীপুরের কেউ আসবেন না, একদম না!!

তবে আমার নীলু এসেছে হাসপাতালে , হাতে এক প্যাকেট এনার্জি প্লাস বিস্কুট নিয়ে।। যাক্‌, যতটা কিপ্টা ভাবতাম মেয়েটাকে, সে ততটা কিপ্টা না!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত