— আম্মা , আমি আমার মায়ের সাথে আমাদের বাড়িতে যাবো ?
বিয়ের ১মাসের মাথায় মা যখন আমার শ্বশুর বাড়িতে আমাকে দেখতে আসে তখন আমার শাশুড়ির কাছে অনুমতি নেওয়ার জন্য যাই।
পারিবারিক ভাবে আমার আর হাসানের বিয়ে হয়।আমার স্বামীসহ আমার শ্বশুরের ৩ ছেলে এবং ৫ মেয়ে।আমার স্বামী ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় । আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার ননদ বা দেবরদের বয়স খুব একটা বেশি ছিলোনা।
সেদিন আম্মাকে অনেক আশা নিয়ে আবদার করেছিলাম কিন্তু আম্মা আমাকে যেতে দেন নি।আমার মাও বারবার মিনতি করেছিলো যেন আমাকে যেতে দেয়।তারপরেও দেননি যেতে।উনার চিন্তা ছিল আমি চলে গেলে ঘরের কাজ কে করবে ? কারণ এক সংসারের সকল কাজই আমি করতাম।ননদ দেবর সবাই তাদের স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।
কম বয়সে বিয়ে দিয়েছেন বাবা, কাজ করতে কষ্ট হতো ঠিকই তবে বয়সটা কম ছিল তো তাই খুব একটা মালুম হতো না।
সেদিন আমার মা যখন আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিলো তখন আমি চিৎকার করে কেঁদেছি, মায়ের সাথে নিজের বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য।কিন্তু আমার শাশুড়ি আমায় দেন নি ! উনি তো একজন মেয়ে, উনি কি আমার কষ্টটা বুঝতে পারছেন না !
সহ্য করে নিতে বাধ্য ছিলাম । কিন্তু ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো । আচ্ছা, বিয়ের পর কি মেয়েদের উপর তার বাবা মায়ের কোনো অধিকার থাকে না ?
আমার স্বামী সংসারের বড় ছেলে ছিলো তাই কখনো মায়ের সাথে বউয়ের হয়ে একটা কথাও বলতো না।কারণ উনি সবসময় বলতেন আমাকে দেখেই আমার ছোট ভাইবোনেরা শিখবে।আমি কষ্ট পেতাম খুব কিন্তু আমার স্বামীকে সবসময় সাপোর্ট করতাম।
বিয়ের একবছরের মাথায় আমার প্রথম সন্তান হয়।তারপর থেকে কেমন জানি বদলে যেতে শুরু করে হাসান।আমার মেয়ে হওয়ার সাতদিন পর হাসান আমার মেয়ের মুখ দেখতে আসে।আমি জানিনা উনি এতদিন কি করে নিজের সন্তানকে প্রথম দেখা দেখতে আসেন নি !
আমার মেয়ে হওয়ার পরপরই শুরু হয় হাসানের বদলে যাওয়া।রীতিমত ঘরে এসে মারধর পর্যন্ত করতো ও আমাকে।
জানিনা বাবার কানে কিভাবে এসব কথা যায় ? মাসখানেকের মধ্যে বাবা এসে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান।
বাবার বাড়িতে আসার পর থেকে হাসান বা অন্য কেউ, আমি তো দূরের কথা আমার এতটুকু মেয়েটারও খোঁজ নেয়নি।
সংসার জিনিসটা এমনই যার মায়া ছেড়ে দেওয়াটা খুবই কষ্টের।বাবার বাড়িতে মাসখানেক থাকার পর আমি আবার আমার শ্বশুর বাড়িতে ফিরে আসি।
আমার মেয়ের বয়স এখন তিন বছর।ওর নাম ফারিয়া।
আমার মেয়েটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। অনেকটা বুঝতেও শিখেছে।ওর বাবা যখন আমার উপর অত্যাচার করতো তখন আমার মেয়েটে চিৎকার করে কাঁদতো । তারপরেও হাসানের পাষাণ হৃদয় এতটুকু গলে যেতো না !
বাবার বাড়ি থেকে আসার কিছুদিন পর বাবা একদিন আমায় ফোন করে বললো,
–মা’রে এই স্বামীর ভাত তোর মত সহজ সরল মেয়ে খেতে পারবে না।তুই মার খেয়ে মরে যাবি মা।তার থেকে ভালো ওদের মেয়েকে (ফারিয়া) ওদের দিয়ে তুই চলে আয় মা।তোকে আমরা আবার বিয়ে দিবো।
বাবার কথা শুনে অবাক হলাম।কি করে আমি আমার মেয়েকে রেখে চলে যাবো ? বাবাকে শুধু একটি কথাই বলেছিলাম,
–বাবা,আমি যেমন তোমার মেয়ে, আমার জন্য যেমন তোমার মায়া হয় ঠিক তেমনি আমার মেয়েটার জন্য আমার মায়া হয়।ও তো আমার ই মেয়ে।
বাবা আমার কথা শুনে কিছুই বলেননি।ফোনটা কেটে দিয়েছিলেন।হয়তো ভেবেছেন,তার মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে !
সারাদিন রান্নাবান্না শেষে ঘরের আর সব কাজ শেষ করে অপেক্ষা করতাম।কখন সবার খাওয়া শেষ হবে ? বাড়ির বউ তো আমি ! বাড়ির বউদের সবার শেষে খেতে হয়।হয়তো মাঝে মাঝে পাতিলে তরকারিও থাকতো না।কি আর করার, পাতিলে ভাত দিয়ে লেগে থাকা ঝোল মুছে মাখাভাত গুলো খেতে শুরু করতাম।বাড়ির বউ যে আমি ! অথচ ক্ষুধা জিনিসটা কি তা কখনো বাবার বাড়িতে মালুম হত না।আমরা মেয়েরা আসলেই অদ্ভুত ! শ্বশুর বাড়িতে এসে কতটাই না বুঝতে শিখে যাই ! চরম বাস্তবতার সম্মুখেও পড়তে হয়।
এভাবে দিনগুলো অতিবাহিত হতে লাগলো।একটা মানুষ কতটা মানিয়ে নিতে পারে তা কেবল একজন সংসারি মেয়েই জানে। কারণ সংসারটাকে আগলে ধরে স্বামীর বাড়িতে সুখের আশায় একটা মেয়ে বেঁচে থাকে।একটা মেয়ে বিয়ের আগ পর্যন্ত একটা ভালো ঘর আর একটা ভালো বরের প্রার্থনা করে।
সংসার জীবনের ২৪বছর চলছে ।এই ২৪বছরে অনেক কিছুই দেখলাম আর শিখলাম ।কিন্তু কখনো শ্বশুর শাশুড়ি বা স্বামীর মুখের উপর কথা বলিনি।তবে আমার স্বামী এখন আমাকে অনেকটা বুঝে । ধৈর্য্যের ফল আসলেই মিষ্টি ।
আমার পরে এই বাড়িতে আরও দু’জন বউ এসেছে। যারা সম্পর্কে আমার জা হয়। ভালোই চলছিলো সংসার।যদিও পরবর্তীতে আমার শাশুড়ি আমার মত করে বাকি দুই বউকে পরিচালনা করতে পারেন নি।কারণ সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না।আমাকে যেমন পরিচালনা করেছিলেন আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পরবর্তীতে তা আর হয়ে উঠে নি।পৃথিবীতে সবাই তো আর ধৈর্য্যশীল নয়। যে চুপ করে সবকিছু মেনে নিবে।আমার দুই জা এসব মেনে নেয় নি।
ব্যস সংসার ভাগ হয়ে গেলো।এসবের মধ্যে দিয়ে আমার শ্বশুর মারা যায়।উনি দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন।
সংসার ভাগ হওয়ার পর শাশুড়ির ভার আর বাকি দুই সন্তান নিলোনা।তার একটাই কারণ উনার পিছনে এখন খরচ বেশি হবে,উনার ডাক্তার, ঔষধ এসবের পিছনে অনেক টাকা লাগবে।এগুলা ওরা কোথা থেকে দিবে ?
কিন্তু আমি আমার শাশুড়িকে বলেছিলাম,
আম্মা আমার সন্তানেরা যা খাবে আপনিও আমাদের সাথে থেকে ঠিক সেটাই খাবেন।হয়তো সবসময় ভালো খাওয়ানোর তৌফিক আল্লাহ্ আপনার বড় ছেলেকে দেন নি।কিন্তু খুব একটা খারাপ ভাবে আপনাকে পরিচালনা করবো না।কারণ সেই তৌফিক আল্লাহ্ আমাদের দিয়েছেন।আপনি শুধু দোয়া করুন আম্মা।আপনার সন্তানদের জন্য।
সেদিন প্রথম আমার শাশুড়ি আমাকে টেনে বুকে নিয়েছিলেন।সংসার জীবনে এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে আমি জানি না ! আমার এতদিনের যত অভিমান ছিল মুহূর্তে সব চলে গেলো।এটাই হয়তো ভালবাসার শক্তি !
আমার শাশুড়ি সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলেন। একদম ৩বছরের একটা বাচ্চার মত।২২ বছর আগে আমার ফারিয়া যেমন করে কান্না করতো ঠিক তেমন।
বৃদ্ধ বয়সে মানুষের আচরণগুলো যে বাচ্চাদের মত হয়ে যায় তা আমার শাশুড়ি, না না কেবল শাশুড়ি নয় আজ মনে হচ্ছে উনি সত্যি আমার মা, অর্থাৎ আমার মায়ের আচরণে ফুটে উঠলো !