ভয়

ভয়

মা ও মা, একবার নিচে এসো তো বৈশাখী মাসী এসেছেন,বললো উজান। নামতে নামতে শুনলো বৈশাখী বলছে- এখন তোমার মায়ের শরীর কেমন আছে বাবা?

-মা, মা তো ভালোই আছে, কেন কিছু হয়েছে নাকি মায়ের? কই কিছু জানিনা তো?
-সে কি কিছু জানোনা? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুললো বৈশাখী।

-আরে বৈশাখী, কখন এলি? সোজা ওপরে এলেই তো আমার ঘর, চল চল ওপরে চল, সেখানে বসেই গল্প করি, বললেন শ্রাবণী দেবী।

ভালো করে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে উজান বললো- মা তোমার কিছু হয়েছে নাকি? মাসি জিগ্যেস করছিলো?
-না না সেদিন মন্দিরার বাড়ি থেকে ফিরতে গিয়ে একটু ভিজে গোছিলাম তো, তাই ভাবছে কিছু হয়েছে হয়তো! চল আমার ঘরে আয় তুই বোলে বৈশাখীকে ডাকলেন।

তাদের যাওয়া দেখে উজান বললো আমি বেরোলাম একটু, বিল্টু ফেরার সময় টা খেয়াল রেখো। বাস থেকে নামাতে হবে, গল্পের তালে ভুলে যেওনা যেন!

ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে বিছানায় বসতে বলতে বৈশাখীকে বললেন- তুই কি রে, উজান কে
আরেকটু হলেই সব বলে দিচ্ছিলি তো? ওরা কিছু জানে না, আর আমি কিছু জানাতেও চাই না রে।
বৈশাখী বলে – মিথ্যা একটা অভিমান নিয়ে বসে থাকিস না, নিজের বুঝ তো পাগলেও বোঝে আর তুই একটা পরের ছেলের জন্য…

-প্লিজ তুই চুপকর, আমি আর কোনোকিছু শুনতে চাই না,প্লিজ!
আমায় ক্ষমা করে দিস, আসলে তোকে দুঃখ দিয়ে কিছু বলতে চাইনি, তুই তোর চিকিৎসাটা করা প্লিজ শ্রাবণী। -তুই বোস একটু, আমি চা নিয়ে আসছি বলে বেরিয়ে গেল শ্রাবণী।

সেদিন মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার সময় রাস্তায় ভীড় দেখে রিক্সা থেকে নেমে যায় বৈশাখী। এগিয়ে গিয়ে দেখে রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে শ্রাবণী কাঁদছে, আর বলছে আমায় কেউ বাড়ি দিয়ে আসবে, আমি বাড়ি চিনতে পারছি না। লেকেরা অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে তার দিকে, হাসাহাসি করছে, আর শ্রাবণী একবার একে তো আরেক বার তাকে এই কথা বলে যাচ্ছে। বৈশাখী এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে বললো, এই শ্রাবণী কি হয়েছে, শরীর খারাপ করছে নাকি? বাড়ি খুঁজে পাচ্ছিস না, এসব কি বলছিস? চল, চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসছি, বৃষ্টি আসছে যে। তাকে ধরে কেঁদে ফেলে শ্রাবণী। রিক্সা ডেকে তাকে তুলে বাড়ি নিয়ে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন তিনি।

চা খেতে খেতে জানতো চাইলেন – ডাক্তারের কাছে গেছিলি তুই? কি বললো ডাক্তার?
শ্রাবণী বললো- আমি বাড়ি তে কাউকে কিছু বলিনি অযথা চিন্তা করবে বলে। আমি ডাক্তারের কাছে গেছিলাম, তিনি বললেন আমি নাকি ডিমেনশিয়া নামক রোগে আক্রান্ত।

বৈশাখী বললো- এ আবার কি রোগ রে? আমি তো শুনিনি আগে? তো তুই উজানকে জানাচ্ছিস না কেন?

শ্রাবণী বললো- সব বলছি তোকে, তবে তোকে অনুরোধ করছি তুই এসব কথা ওদের বলিস না।
তুই তো জানিস উজান আমার ছেলে নয়, তবে আমি ওকে সেই ছোট থেকে একাই বড় করেছি, নিজে বিয়ে না করে ও ওর মা হয়ে থেকেছি। ওর বড় হওয়া, বিয়ে দেওয়া সব একাই করেছি।

আমার যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে নিজেকে অনাথ আশ্রমে পেয়েছি। বাবা মা না থাকলে তাদের অনাথ বলে। ভালো করে পড়াশোনা করে যখন একটা হাসপাতালে নার্সের কাজ করতাম, তখন ঐ হাসপাতালে উজানের জন্ম হয়, তারপর তার মা তাকে ফেলে রেখে রাতের অন্ধকারে চলে যায়।

একটু জল খেয়ে বললেন, তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় তাকে কোনো অনাথ আশ্রমে রেখে আসবে। আমি তা হতে দিইনি, কারণ আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি তাই সবসময় কোনো ছেলে মেয়েকে তাদের বাবা মায়ের সাথে দেখলে আমার খুব কষ্ট হতো, তাই ফুলের মতো একটা শিশু কষ্ট পাক চাইনি, ওকে কোলে তুলে নিয়ে ওর মা হয়ে গেছিলাম সেদিন।

বৈশাখী বললো- আমি সব জানি শ্রাবণী, সবাই যেন ওকে তার জন্ম বৃত্তান্ত না জানাতে পারে তাই তুই সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছিলি এখানে, তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে সব কিছু তুই একা সামলেছিস। বিয়ে না করেও বিধবার জীবন কাটিয়েছিস, এসব তো আমি সব জানি।

-হ্যাঁ শুধু তুই জানিস সেসব কথা, তাই আমার ভয় করে রে খুব ভয় করে উজান যদি আমায় ছেড়ে চলে যায় তখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো। কেঁদে ফেললো শ্রাবণী। বললো ক্রমশ এই ভয়টা আমার বাড়ছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে। রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারি না, অস্থির লাগে, মনে হয় কেউ যেন আমার কাছ থেকে উজানকে কেড়ে নিচ্ছে।
সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমি ওর ঘরের সামনে বসে থাকি, ওকে পাহারা দি। বউমা একদিন আমায় দেখে ফেলে রাগারাগি, অশান্তি করেছে। ছেলে, বৌমার ঘরে আঁড়ি পাতছি বলে ভেবেছে। আমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি রে দিন দিন। সব ভূলে যাচ্ছি, কিছু সময়ের জন্য আমি কে, কোথায় থাকি সব ভুলে যাচ্ছি।

ওরা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে আমি চাই, আমি নিজেই ওদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। তাই কোনো রকম চিকিৎসা করাতে চাই না রে। তাহলে নিজেই একদিন সব ভূলে যাবো তখন আমার কোনো কষ্ট থাকবে না। বলতে বলতে তার হাঁফ ধরে গেছিলো।

“ঠাম্মি, ও ঠাম্মি” বলে ছুটে এসে বিল্টু শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরলো। সে চমকে উঠে বললো- তুমি, তুমি কার সাথে এলে দাদুভাই ?আমি তো যেতেই….

উজান ঘরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো – তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না মা, তোমাকে ছাড়া আমি… বলে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো।

শ্রাবণী ও বৈশাখী দুজনেই চমকে উঠেছিলো উজানের কথা শুনে।

-তুই, তুই বাবা!
-হ্যাঁ মা আমি তোমার সব কথা শুনে ফেলেছি, তুমি না থাকলে হয়তো আমার কোনো অস্তিত্বই থাকতো না।
বৈশাখী মাসী তোমার শরীর কেমন জানতে চাইলে আমার সন্দেহ হয়, শুভ্রা কয়েকদিন ধরে তোমার কথা বলছিলো। তুমি নাকি সারা রাত আমার ঘরের সামনে…

মা তুমি কোথাও যাবেনা আমাদের ছেড়ে, আমি তোমাকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তুলবো। কোথায় যাবো গো মা, তোমায় ছেড়ে, তুমি ছাড়া আমার কি আর কোনো পরিচয় আছে?

বুকে জড়িয়ে ধরলো উজানকে শ্রাবণী, বৈশাখী বললো- তুই তোর ছেলেকে পেলি তো?আর মিথ্যে ভয় পাস না, চল আমিও তোদের সাথে ডাক্তারের কাছে যাবো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত