শুকনো বকুলের ঘ্রাণ

শুকনো বকুলের ঘ্রাণ

“আমি রাহতিদকে চাইতাম। খুব করে চাইতাম। সবসময় পাশে চাইতাম।” আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো রাহতিদের স্ত্রী। মায়া মাখা শুভ্র মুখটা শক্ত হয়ে আসছে। তবে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। ধৈর্য্য শক্তি মন্দ নয়।
আমি এক ঝলক রাত্রির মুখটা দেখে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম, “তুমি আমার ‘ধূসর নীলাম্বর কিংবা শুভ্র বলাকার গল্প’ বইটা পড়েছো নিশ্চয়ই। তোমায় রাহতিদ দু’দুবার এই একটা বইই উপহার দিয়েছে তাই না!”
বিস্ফোরক দৃষ্টিতে এবার আমার দিকে চেয়ে রইল রাত্রি। ” সেটা আপনি কি করে জানলেন?,” এবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রাত্রি।

” আমি সব জানি। আমি রাহতিদের প্রতিটা গল্প জানি। শুধু তোমার থেকে নয় রাহতিদের নিজের থেকেও আমি ওকে বেশি জানি। দেখো অজান্তেই তোমায় একটা গোপন কথা বলে ফেললাম। এই বইটা যে আমার লেখা এটা আমি আর বইটার প্রকাশক ছাড়া কেউ জানে না। অথচ তুমি আজ জেনে ফেললে। ” রাহতিদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যই এমনটা করেছেন তাই না! সানবিনা হক নামে একটা ভারিক্কি ছদ্ম নাম দিয়েছেন নিজের যাতে ও ঘূর্ণাক্ষরেও টের না পায়। “বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিউত্তর করলো রাত্রি।

” ঠিক ধরেছো। আমি রাহতিদকে চাইলেও কোনোদিন ওকে জানানোর সাহস করতে পারি নি। তাই ওকে নিয়ে সমস্ত লেখাগুলো ছাপিয়ে ছিলাম সানবিনা হক নামে। বইটা যখন রাহতিদ পড়তো তখন ও প্রতিটা কবিতার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো। ওর নিজের প্রতিচ্ছবিই ও দেখতে পেত। অনেক চেষ্টাও করেছিল সানবিনা হকের সাথে দেখা করতে। কিন্তু প্রকাশনী থেকে বার বার ওকে ফিরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে লেখিকা প্রবাসী। শেষমেষ ওর আগ্রহের কোনো কমতি না হলেও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। সানবিনা হকের পেছনে ছোটা বন্ধ করে দেয়। ”

“এত কিছুর পরও আপনি ওকে কেন বলেননি কখনো আপনিই সেই যাকে ও খুঁজছে?”” আরাধ্য জিনিস মুঠোয় পেয়ে গেলে তার প্রতি ব্যাকুলতা কমে যায়। না পাওয়া কিছুতে যে উন্মাদনা থাকে, লাভ করা জিনিসে সে উন্মাদনা থাকে না। ভালোবাসা পাশে থাকলে কলম পাশে থাকে না। ভালোবাসা যদি দূরে থাকে তবে কলম পাশে থাকে সর্বদা। ”

” এত কঠিন কথা আমার মাথায় ঢুকে না। তবে আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম কখনোই রাহতিদকে অন্য কারো হতে দিতাম না। প্রিয় মানুষটিকে কাছে পাওয়ার জন্য কাব্য আর কবিতাকে বিসর্জন দিয়ে দিতাম আমি। ”
একটু স্মিত হেসে বললাম,

” সেজন্যই আমি তুমি নই। তুমি আমি নও। আমরা দুজন আলাদা দুটো সত্ত্বা। আমাদের প্রাপ্তির জগতটাও আলাদা। ”
“সত্যি ভীষণ জটিল একজন মানুষ আপনি। যেখানে রাহতিদ এত বছর আপনার পাশে থেকেও আপনাকে বুঝতে পারে নি সেখানে আর কেউই আপনাকে বুঝতে পারবে না। ” সন্ধ্যা হয়ে এলো এবার আমায় উঠতে হবে। তুমি ভালো থেকো। রাহতিদকেও ভালো রেখো।”আপনিও ভালো থাকবেন।”

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে হাঁটছি শহুরে আলো ছায়ার ঝলকানির মাঝে। ফুরিয়ে আসা দিনের আলোর সাথে স্তরে স্তরে জ্বলে থাকা নিয়নবাতির আলোয় সত্যিই বড্ড অচেনা লাগে চারপাশটাকে। এই নিয়নের আলোয় একটা সময় কত স্বপ্নই না সাজিয়েছি।

কত কল্পনা এঁকেছি মনের মাঝে এই বিরামহীন রাস্তার কথা ভেবে। দুটো মানুষ একসাথে এক তোড়া স্বপ্ন, এক তোড়া গল্প সাজিয়ে পাশে চলার স্বপ্ন গুলো আজ অতীতের ডায়েরিতে লেগে থাকা শুকিয়ে যাওয়া বকুলের ঘ্রাণের মতোই একটা মৃদু পরশ খেলে যায়। সমস্ত চাওয়া যদি পরিপূর্ণতায় রূপ নেয় তবে সে জীবনের কি কোনো পথচলার স্পৃহা আর জেগে থাকে!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত