মেসে থেকে পড়াশুনা করতাম অাগে।সেখানে রত্না নামে এক বুয়া মহিলা দুবেলা রান্না করে দিত।রান্নায় একেবারে অন্নপূর্নার হাত ছিল যেন তার।যাই রান্না করত অামরা মেসের ছেলেরা তা ছেঁটেপুটে খেতাম।মাস শেষে তাকে সাড়ে তিনহাজার টাকা করে দিতে হত।এর অাগে বিশাখা নামে এক মহিলাকে রেখেছিলাম।সবকিছু ঠিকঠাক কেবল তরকারিতে ঝাল কম দিত।অাচ্ছা মুরগির মাংস যদি ডালের মত হয় তাহলে কেমন লাগে।অামরা চিটাংগ্যা মানুষ, একটু ভোজনপ্রিয়।তরকারি টক, ঝাল না হলে খেয়ে তৃপ্তি উঠেনা।কয়েকবার ভুল সংশোধনের সময় দেয়া হল তাকে।তবুও একটার পর একটা ভুল করতেই থাকল।তারপর বুদ্ধি করে মাস শেষে পাওনাটা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিলাম অাস্তে করে।দশ- পনেরদিন অাগে থেকেই মেসের বাকি ছেলেদের বলে রেখেছিলাম অাশেপাশে বুয়ার খোঁজ করতে।তাই রনি ঠিক করে রেখেছিল রত্নাকে।
রত্না অামার মায়ের বয়সি প্রায়।দেখতে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের।অামার নিজের কোন মাসি ছিলনা তাই তাকে রত্না মাসি বলেই সম্ভোধন করতাম।প্রায় একমাসের মত যাওয়ার পর রত্না মাসির সাথে অামার ভালো ভাব হয়ে যায়।নিজের কোন ছেলে ছিল না তার।তাই অামাকে নিজের ছেলের মতই করে তিনি।সপ্তাহে তিনদিন ভার্সিটিতে ক্লাস থাকত।অার বাকি চারদিন মেসে শুয়ে কাটাতাম।মেসে রান্না করতে এসে তার সুখ দুঃখের যত কথা সব অামাকেই শুনাত।অামিও কান খুলে শুনতাম।কারন এতে অামারও অলস সময় পার হয়ে যেত।তারপর একদিন তার জীবনের ইতিহাস শুনতে গিয়ে অামার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি বের হতে থাকল।এতটাই কষ্টের ছিল রত্না মাসির জীবনটা।
– অামি গ্রামের মেয়ে।চট্টগ্রামে অামার বাড়ি ছিল।তোমার বাড়িও তো চট্টগ্রামে তাই না??
– হ্যাঁ।
– কোন উপজেলায়??
– পটিয়া।অাপনার??
– অামিও পটিয়াতে ছিলাম।জানো অামি বাবা মায়ের অতি অাদুরে মেয়ে ছিলাম।যখন যেটা চাইতাম এনে দিত।বাবা পোস্ট অফিসে চাকুরি করত।মা গৃহিণী।সুখের সংসার ছিল অামাদের। রত্না মাসি এটুকু বলে থামলেন।অামি চেয়ার অারেকটু সামনে টেনে বসলাম।
– ক্লাস নাইনে উঠে একটা ছেলের সাথে অামার মনের মিল হয়ে যায়।ছেলেটার নাম রুপন।মধ্যপাড়ায় থাকত।অার অামরা পশ্চিম পাড়ায়।প্রথম প্রেম হিসেবে নিজের সবকিছু উজার করে ভালোবেসেছিলাম রুপনকে।যার ফলসরুপ কয়েকমাস পরেই প্রথমবারের মত অামার পেটে কিছু একটা অনুভব করি।বুঝতে পারি রুপনের সন্তান অামার পেটে এসে পড়েছে। এটুকু বলে রত্না মাসি জোরেসোরে নিশ্বাস ছাড়লেন যেন।অামি বললাম- তারপর কি হল মাসি??
– তারপর অার কি হবে।গ্রামে থাকলে যা হয় অার কি।কথা পাঁচকান হয়ে গেল।থাকা হলনা অার বাবা-মার সাথে।রাস্তায় বের হতে পারতামনা সবাই হাসি ঠাট্টা করত।মা বলছিল বাচ্চা নষ্ট করে দিতে কিন্তু করিনি।ভুল নাহয় অামরা করেছি।কিন্তু ওই নিষ্পাপ শিশুটার দোষ কি তাতে।সে তো নির্দোষ। তাহলে সে কেন পৃথিবীর অালো থেকে বঞ্চিত হবে।অামি অামার সিদ্বান্ত থেকে এক কদম নড়িনি।সেজন্য চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে দিল অামার মা।তারপর অামি এখানে অামার এক দুরসম্পর্কের মামির কাছে এসে থাকতে শুরু করলাম।
এটুকু বলে শেষ করতেই অামি জিজ্ঞাস করলাম- ওই লোকটা কোথায় ছিল তখন??
-কোন লোকটা? ও অাচ্ছা রুপন।সে তো বিদেশে ছিল তখন।শুনলাম এখনো বিদেশেই অাছে।বিয়েসাদি করেছে।একটা ছেলে অাছে।এর মাঝে একবার দেশে এসেছিল ওর মায়ের অন্তিম সৎকার করতে।অার ফেরেনি।
– অাপনার বাবা- মার সাথে নিশ্চয় ফোনে কথা চলে??
– না।গত বিশ বছরে এক সেকেন্ডের জন্য কথা বলিনি ওদের সাথে।কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ানোর।মেয়েকে নিয়ে ভালোই তো কাটছে সময়।
– অাপনার মেয়ে সে কি করছে এখন?
– অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।মেয়েটাকে নিয়েও অার পারিনা।কয়েকদিন ধরে রাতে নিজেও ঘুমাচ্ছেনা অামাকেও ঘুমাতে দিচ্ছেনা।
– কেন কি হয়েছে ওর?
– মাথা ব্যাথা নাকি।ডাক্তার দেখিয়েছি।এক্স-রে করিয়েছি বেশ কয়েকটা কিন্তু ফলাফল শূণ্য।মাথার যন্ত্রণা কমেনি।
– ওহ! অামার একটা পরিচিত ডাক্তার অাছে।ভালো চিকিৎসা করে।দেখাবেন নাকি ওকে একবার?
– তুমি যখন বলছ সেটা অার বাদ যাবে কেন।
– ঠিক অাছে অামি রাতে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে অাপনাকে বলব।
– অাচ্ছা বলিও।
রত্না মাসি কাজ শেষ করে চলে গেলেন।অামি চেয়ারে বসে রইলাম কতক্ষণ।রত্না মাসির জীবনটা অাসলেই কষ্টের।ভাবতেই অবাক লাগছে বিয়ের ফুল ফুটেনি তার জীবনে।ছোটবেলার পুতুল খেলার স্বপ্নটাও পূরন হয়নি।অার ওই মেয়েটার কতটা চাপা কষ্ট পিতৃস্নেহ পায়নি জীবনে।নিজের বাবার নামটা বলতে লিখতে পারেনা।তার বাবা বেঁচে অাছে কিনা সেটাও জানেনা।
বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি শুধু।চোখে ঘুম নেই।একটা অপরাধবোধ নিজের মধ্যে কাজ করছে।রুপন চরিত্রটা হুবহু বাবার সাথে মিলে যায়।কেউ সুখে নেই।সেদিন সামান্য ভুলের কারনে অাজও তিনদিকে ভাসছে তিনটি জীবন্তলাশ।