কাজলাদিদি

কাজলাদিদি

শিল্পী সাদি মুহম্মদের মায়াবী কণ্ঠে সেদিন গান শুনছিলাম- ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলাদিদি কই…’। গানটি যতই শুনছি ততই আমি আনমনা হয়ে যাচ্ছি। আমি যেন বোনের ভালবাসার স্বচ্ছ জলে অবগাহন করছি। একটি উপন্যাসে পড়েছিলাম, পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক হচ্ছে ভাই-বোনের সম্পর্ক। যে সম্পর্কের ভেতর কোন ফাঁক-ফাঁকি থাকে না, থাকে না কোনো স্বার্থপরতা, থাকে না শঠতার অপবিত্র পানির ছোঁয়া। থাকে শুধু ভালবাসার মধুর পরশ, মায়াময় স্পর্শ।

গানটির ভেতর এক ছোট ভাইয়ের আক্ষেপ আর ভালবাসা ফুটে উঠেছে। এটি ছিল মূলত: একটি কবিতা, পরে গান করা হয়েছে। লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি, যতীন্দ্রমোহন বাগচী। কী অসাধারণ কবিতার প্রতিটা লাইন! আশ্চর্য সব শব্দের মেলবন্ধন, অসাধারণ তার রচনাশৈলী। কবি হওয়ার জন্য এরকম একটি কবিতাই যথেষ্ট। এই কবিতাটি আমাদেরকে আমাদের সবুজ গ্রাম-বাংলা, নদীর জল, পুকুর পাড়, লেবুর ঘ্রাণ, ফুলের গন্ধ আর জোনাকজ্বলা রাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভিন্ন এক আবেশে আমরা হারিয়ে যাই, হাবুডুবু খাই সোনালী স্মৃতির সাগরে।

এই গানের ভেতর একজন বোনের মারা যাওয়ার কথা কবি বর্ণনা করেছেন। এরপর তার ভাইয়ের কি প্রতিক্রিয়া কবিতার প্রতিটি লাইনে আমরা তা দেখতে পেয়েছি। খুঁজে পেয়েছি ভালবাসার ছোঁয়া। ভাইয়ের আকুতি আর হাহাকারের মূর্তিপ্রতিকরূপে কবিতাটির প্রতিটি লাইন স্বর্থকতা পেয়েছে। ভাইটি তার মাকে জিজ্ঞাসা করছে, মা, আমার কাজলাদিদি কোথায়? যে তাকে শ্লোক শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়িয়ে দিত। মা ছেলের প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারে না। শুধু চোখেল জ্বলে ভাসতে থাকে তার নয়ন যুগল।

আমি আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট। আমার সাত ভাইবোন। তিনবোন, চারভাই। তিনবোন সবার বড়। আমার বড়বোনের বড় ছেলে আমার ক্লাশমেট। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমেস্টি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে। সে দৃষ্টিতে আমার বড়বোন আমার মায়ের মতো। দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে যায়। মাঝেমাঝে শাসনের সুরে কথা বলেন, তখন আমি চুপ করে শুনি আর হাসি। বেশ উপভোগ কবি আমার বড়বোনের কথাগুলো। তাদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে মা, বড়ভাই-ভাবী এদের কথা বেশী বলা হয়। কথার ঝুড়ি থেকে বের হতে থাকে মজার মজার অনেক স্মৃতি।

কথার মাঝে হাসিতে মাঝে মাঝে ফেটে পড়ার উপক্রম হয় আমাদের। ছোটবেলায় আমি বড়বোনের বাড়িতে গেলে আসতে চাইতাম না। অনেক জোরাজুরি করে আমাকে বাড়িতে আনা হতো। আমার মেজোবোন যিনি, আমি ভূমিষ্ট হওয়ার পর আমাকে সরিষার তেল আর মধু খাইয়েছেন। তার সাথে একবার আমার তুমুল ঝগড়া হয়। ঝগড়ার কারণ, আমি একবার তার কাছে পঞ্চাশ টাকা জমা রেখেছিলাম। একদিন টাকা চাইতেই তিনি বললেন টাকা দিয়ে দিয়েছি, আসলে আমি কোনো টাকা নিই নাই, এরপর শুরু হয় মারামারি। একথা মনে হলে আমার এখনো লজ্জ্বা হয়। আমার ছোটবোন পীরের মতো আদব-লেহাজ কথাবর্তায় অসাধারণ ধৈর্যশীলা এক মহিলা। বাঙালি নারীর সকল বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে লক্ষ করা যায়। তিনি আমার জন্য সার্বক্ষণিক এক পায়ে খাড়া।

শুধু আমার জন্য নয়, কখন কোন ভাইয়ের কি প্রয়োজন সেদিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমার এই বোনটি ভালো কোনো পুরুষের হাতে পড়েনি। তার স্বামীটি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বজ্জাত, আমার বোনকে কতদিন যে মেরেছে তার হিসাব নেই।

তবুও আমার বোনটি ধৈর্য্য ধরে তার ঘর করেছে। নামাজ পড়ে কতদিন যে, এই মমতাময়ী বোনটির জন্য বিধাতার কাছে প্রার্থনা করেছি তার হিসাব নেই। খোদা কেন সরলসোজা এমন বোনটিকে এমন স্বামী দিলেন আমার বুঝে আসে না। তবে সকল রহস্য তো আর আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সৃষ্টিকর্তা এক রহস্যের নাম।

এখন আর আগের মতো বোনদের সাথে দেখা হয় না। মাঝেমাঝে মন ছুটে যেতে চায় মমতাময়ী বোনদের কাছে। তাদের শাড়ির আঁচলে চোখ মুখে সকল দুঃখকে জলাঞ্জলি দিতে মন চায়। কিন্তু তবুও আর যাওয়া হয় না তেম আগের মতো করে। আমার কাজলাদিদিরা, তোমরা ভালো থেকো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত