সাজিয়া চাকলাদার : আমার দাদুর বাড়ী ছিল গ্রামে । বিক্রমপুরের লৌহজং থানার ধাইদা গ্রামে । আমাদের বাড়ীটা ছিল মধ্যিকখানে। অর্থাৎ আমাদের বিশাল বাড়িটা নিয়েই গ্রাম । চতুস্পার্শে ক্ষেত । তারপরে আবার গ্রাম । বিক্রমপুরে ছয় মাস থাকে পানি ছয় মাস থাকে শুকনা মৌসুম ।এমনি পানির সময় কোথা থেকে ভাসতে ভাসতে এক শিশুর মৃতদেহ নিয়ে একটি ভেলা এসে লাগল বাড়ির ঘাটে । বাড়ির লোকজন ভেলাটি আবার ভাসিয়ে দিল । কিন্তু ভেলাটি পুনরায় এসে লাগল । আবার ভাসিয়ে দিল । বাড়ির লোকজন সকলেই কুসংস্কারের অজানা আতঙ্কে ভীত হয়ে পরলো । তারা মৌলভি ডেকে বাড়ির চারপাশ বেঁধে দিল । অর্থাৎ সুরা পড়ে বাড়ির চরপাশটায় চারটা লোহা বসিয়ে দিল । এর ভেতর আর কিছুর উপদ্রব হবে না । এরপর সবাই শান্তিতেই ছিল । কিš‘ হঠাৎ শুরু হয়ে গেল ভূতের উপদ্রব । এমন কেউ নেই যে এই অজানা চীজটির বিভিন্ন ভয়াল রূপ দর্শন না করেছে । রাতে ঘর থেকে বের হওয়াই যেন মুশকিল হল । প্রাকৃতিক ডাক তো আর সময় অসময় বোঝে না । যখন তখন হানা দেয় । গ্রামে তো আর ঘরের মধ্যে বাথরুম ছিল না । তাই একটু দূরেই থাকত বাথরুম।
অতটুকু পথ যেতেই ভয়ে শরীর হিম হয়ে যেত । এমনকি দিনের বেলাতেও একাকী কেউ চলাচল করত না এ-ঘর ও-ঘর । ভর দুপুরে তো নয়ই । কেউ হয়তো দেখল ঐ গাব গাছটার একটা ডাল ধরে সাধারণ বিড়াল থেকে বড় একটা বিড়াল ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ঝুলছে । কেউ বা উচু গাছের মগ ডালের চিকন শাখায় মানুষ রূপের কেউ শুয়ে আছে ্ কিম্বা কোন সময় পুকুর ঘাটে নামতে যাচ্ছে তখন ঘাট থেকে আসা মানুষ রূপের কারো সাথে ঘষা লাগতেই মনে হত মাদার গাছের কাঁটার ঘষা লাগল । একবার তো ঘাটে অপেক্ষমান এক মহিলাকে মা মনে করে নৌকা ভিড়ালে ঐ মা লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে ওকে পানিতে নামিয়ে মাথার চুল ধরে চুবের পর চুব । আর ঐ গাব গাছটাই ছিল সকল অশরীরি এ সবের আস্তানা । আর ঐ গাছটার তলা দিয়ে ছিল পুকুরের এক মাত্র- পানি আসা যাওয়ার পথ। সন্ধ্যের পর তো কেউ নৌকা করে ঐ পথ দিয়ে বের ই হত না । এমনি আতঙ্কের ছিল দাদাদের বাড়িটা ।
একবার আমার দুই দাদু – মনু দাদু – বাদশা দাদু ঐ বাড়িতে এক সাথে থাকত বাহির বাড়ির বৈঠক খানাতে । রাতে এখানেই শোয়ার ব্যবস্থা । এর মধ্যে বাদশা দাদু ছিল ভীতু গোছের । মনু দাদু সাহসী । বাদশা দাদুর আবার রাতে বাথরুমে যাবার বাতিক ছিল । রাত হলেই বিশেষ করে গভীর রাতে তার এমন অবস্থা হত এবং হলোও । চাঁদ উঠেছে । সারা আকাশটায় এক টুকরা মেঘ নেই । নীল আকাশ জুড়ে চাঁদের হাসি ছড়িয়ে পরেছে । বৈঠক খানার সামনে উঠানে লেপ দেয়া । চাঁদের হাসিতে উঠোনটাকে আরো সুন্দর লাগতো । চাঁদের আলোয় প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনায় অবর্ননীয় । এমনি গ্রামীন রাতের দৃশ্য । বাদশা দাদু উঠে পড়ল ।
মনু দাদুকে ঘুম থেকে জাগাল । দুজনেই ঘড়ের বাইরে এল । বাইর বাড়ির পায়খানার পানে চললো ওরা । ঐ যে বলে না যে ভীতু তার চোখেই যেন ভয়ের কারণটি দেখা দেয় । তাই হল । উঠোনের ঐ পাশে কে দাঁড়িয়ে যেন । এমন আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে শরীর ঢেকে ? বাদশা দাদু বলল – মনি ভাই ঐ যে চোর । মনু দাদুতো দেখেই বুঝতে পেরেছে ওটা চোর নয় অন্য কিছু । মনু দাদু বলল বাসু তুই কাজ সেরে আয়, তারপর দুজনে মিলেই ঐ চোরটাকে পাকড়াও করব । ঠিক তাই হল । বাদশা দাদু কিন্তু বুঝে উঠতেই পারছিল না চোর কি কখনো এমন বেশে আসে ? মনু দাদু তখন এ অঞ্চলের একজন নামজাদা দৌড়বিদ । ফন্দি আঁটতে লাগল কি করবে তারা ।
এদিকে চোরটা কিন্তু ফন্দি এঁটে ফেলল । ও ঠিক ওদের নিয়ে চলল পুকুরের দিকে । চোর গতি বাড়াল । মনু দাদুও। কিন্তু কিছু পরেই চোরটা ঐ গাব গাছটার দিকে মোড় নিতেই মনু দাদু দৌড় থামিয়ে দিল । আর মনু দাদু এত ভাল দৌড়বিদ হয়েও কিন্তু চোর আর তার মধ্যে ব্যবধান কমাতে পারে নি । যেইনা চোরটি গাব গাছের দিকে মোর নিল দাদু দাঁড়ায়ে পড়ল এবং ঘরে ফিরে এল ্ আর বাদশা দাদু বলতে লাগল কি হল চোরটাকে ধরলে না – কি হল ? মনু দাদু বলল দরকার নেই চোর ধরার । বলল না ওটা চোর না ভূত ছিল ।
কারণ মনু দাদু জানে বাদশা দাদু কতটা ভীতু মানুষ ।ঐ রাতে তখন ওরা চোর ভূত জানিয়ে দিলে অপর দৃশ্যের সৃষ্টি হত । চলে এল বাইর বাড়ির খালে মুখ হাত ধুতে । আবার কিš‘ ঐ চোরটা এল,কিন্তু অন্য রূপে – জেলে সেজে । কাঁধে ঝাঁকি জাল জাতীয় কিছু নিয়ে – যেন মাছ ধরতে এসেছে । খালটা বড় করে পা ফেলে পার হয়ে গেল – চলে গেল দূর থেকে দূরেই । এরাও ঘরে ফিরে এল । এবার বাদশা দাদু মনু দাদুকে আক্রমণ করে বলল কি ব্যাপার চোরটাকে ধরলে না য়ে – কেন ? তখন মনু দাদু বলল হায়রে বাসু চোর কখনো ঐ রকম সাদা পোশাকে আপাদমস্তক ঢেকে আসে ? আর ঐ গাব গাছটার দিকেইবা চোরটা দৌড়ে গেল কেন ? পরে ঐ যে জেলে – কোন মানুষ কি ঐ খালটা এক লাফে পার হতে পারে ? এতক্ষণে বাদশা দাদুর যেন সম্বিত এল – হ্যাঁ – তাইতো ? তা হলে ? মনু দাদু বলল তুই তো ভূত দেখিসনি বলতিস – এখন থেকে বলবি ’দেখেছি’।