বুকের ভিতর বৃষ্টি পড়ে। বুকের ঠিক কোথায়? বুক মানে তো একটা গান। গিটারের তারে বৃষ্টি পড়লে সেই গানটা বেজে ওঠে। ভিজে ভিজে গান। মেঘ-পিওন এসে সেই গানটাকে নিয়ে যায়। কোথায়? তা কি জানা গিয়েছে আজও? আসলে, বৃষ্টির সঙ্গে অনেক গল্প হয়। ছেলেমানুষির গল্প। বুকের ভিতর যখন বৃষ্টি, তখন সেই গল্পটাই আবার গান হয়ে যায়। মন খারাপের নদীতে তখন প্লাবন। এ পার গঙ্গা ও পার গঙ্গার মাঝখানের চরটিতে তিন কন্যে নিয়ে বসে আছেন শিব সওদাগর। দুই কন্যে রান্নাবাড়ি সেরে পান মুখে দিলে আর এক কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ির পথ ধরেন। বাপের বাড়ির সেই পথেই কি কম বৃষ্টি-বাদল! ঝমঝম মল বাজিয়ে অভিমানী কন্যে বৃষ্টির পর্দা ফুঁড়ে হেঁটে যান। বৃষ্টির সঙ্গে ছেলেমানুষির গল্প হয়। কখনও ফুরোয় না সেই গল্প।
কখনও ফুরোয় না বৃষ্টিও। বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস। ‘এখানে’ মানে কোনখানে? ‘এখান’টা কি বুকের ভিতর? বারোমাসের বৃষ্টি সেখানে খুলে রাখে স্মৃতির তোরঙ্গ। হারিয়ে যাওয়া চাবি ঠিক জোগাড় করে দেয় বৃষ্টির টাপুরটুপুর। ভাবি, বারোমাস বৃষ্টি পড়লে কী অনাছিষ্টিটাই না হয়! তিন তলা-চার তলা-পাঁচ তলা বাড়ির দল সব ডুবে বসে আছে। শহরের রাস্তায় সাঁতার কাটছে মাছের দঙ্গল। বৃষ্টির মধ্যে বৃষ্টি এসে ঢোকে। বৃষ্টির গায়ে বৃষ্টি লেগে দিগভ্রান্ত হয়ে যায়। চোখের গভীরে বৃষ্টি এসে ঢোকে। স্মৃতির ভাঁড়ারে ঢুকে পড়ে বৃষ্টি। আর সেই ভাঁড়ার উপচে স্মৃতির দল নিয়ে যায় কবিতার কাছে, কবির কাছে। এক জন কবিই বৃষ্টিকে মেঘের মধ্যে আটকে রাখতে পারেন। এ পার স্মৃতি ও পার স্মৃতির মাঝখানের সাঁকো ধুয়ে যায় বৃষ্টিরেখায়। কী যেন মনে পড়ি পড়ি করে। মনে পড়ে কি সব কথা?
সব কথা বলা হয়ে উঠবে না কোনও দিন। জানি। তবু চারিদিক ভাসিয়ে নেওয়া বৃষ্টির দিনে মনে হয় সমস্ত অতীত যেন উঠেপড়ে লেগেছে সব কথা বলে ফেলার জন্য। সেই যে আপেল পড়া দেখে বুকের ভিতর বাজনা বেজে উঠেছিল এক ভাবুকের। ঠিক তেমনই আষাঢ়ের প্রথম মেঘটিকে দেখে কালিদাসও শুনতে পেয়েছিলেন সেই বাজনা। সেই বাজনা বুকের ভিতর বাজে। রবীন্দ্রনাথ, শক্তি চাটুজ্যে হয়ে সে বলে ওঠে— বৃষ্টির জয় হোক। কবি জয়ের কথা মনে পড়বেই এই ভাবনার স্রোতে। ছোট নদীর উপরকার সাঁকোটিকে জয়ই তো পেতে রেখেছেন বৃষ্টি পার হওয়ার জন্য। স্মৃতির এ পার আর স্মৃতির ও পার তখন একাকার। বৃষ্টি এসে ধুইয়ে দিচ্ছে সারা জীবনের পাওয়া না-পাওয়া।
স্মৃতির তোরঙ্গ খুললেই দেখতে পাই, আমাদের সেই উঠবন্দি সংসার। ক্রমাগত বাসা বদলের দিন। নতুন বাসার ছাদ চুঁইয়ে নামছে বৃষ্টির ফোঁটা। খাটের উপর শুয়ে রয়েছেন বাবা। বাবার চারপাশে মা পেতে রেখেছেন হাঁড়ি-পাতিল। ছাদ চুঁইয়ে বৃষ্টির ফোঁটারা এসে জমছে সেই পাত্রগুলোয়। বাবা শুয়ে আছেন। বাবার সঙ্গে শুয়ে আছে অনেক অনেক গান-বাজনার কাগজ, শুয়ে আছেন আবদুল করিম খান, শুয়ে রয়েছে যমুনা কি তীর। হাঁড়ি-পাতিলের মধ্যে বৃষ্টিফোঁটার দল যে বাজনা বাজাচ্ছে, তাকেই কি ‘জলতরঙ্গ’ বলে? নাকি একটা হারমোনিয়ম? সাদা-কালো রিডে কি ধরা রয়েছে বৃষ্টির নিজস্ব গান? মনে হয়, খাটের উপর শুয়ে বাবা সে গানটাই শুনতেন। রিমিকি ঝিমিকি বরিষণ। মল্লার এসে ছুঁয়ে যেত আমাদের উঠবন্দি সংসার। গরজত বরষত শাওন ছড়িয়ে পড়ত চারিধারে।
আর একটা দিন। ক্লাস থ্রি-তে পড়ি তখন। এক অঝোর বৃষ্টির দিন। স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে কখন। আমাকে নিতে মা আসেননি। বাড়ি দূরে নয়। স্কুলের এক দফতরিকাকুর ঘরে আমি দাঁড়িয়ে। কেউ কি আদৌ আসবে? বৃষ্টি থামলেই মা আসবেন, জানি। কিন্তু এই বৃষ্টি কি থামবে কখনও? কোনও দিন কি বাড়ি যেতে পারব? প্রতীক্ষার বৃষ্টি শেষ হয় নাকি! এমন একটা ঘরে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেই ঘরটার অস্তিত্ব আমি জানতামই না। অচেনা পরিবেশে আধো অন্ধকারে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি তখন। এমন সময় দেখি ছোট্ট একটা মেয়ে। আমারই বয়সী হবে। দফতরিকাকুর মেয়ে। পাশের মেয়েদের স্কুলে পড়ে। ভাব হল তার সঙ্গে। বৃষ্টি বেয়ে দৌড়ে গেল সে আমার জন্য খাবার আর জল আনতে। কোথা থেকে একটা স্টিলের গ্লাস নিয়ে এল। আমি তো তাকে কখনও দেখিনি আগে। বৃষ্টি তা হলে বন্ধুত্বও তৈরি করে? আজ সেই স্মৃতি অঝোর বৃষ্টির মতোই ঝাপসা। যখন বাড়ি থেকে আমাকে নিতে এল, তখন মনে হল কয়েক যুগ যেন আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি বৃষ্টির মধ্যে। বারো মাস যেন সেই বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। সেই মেয়ে আর আমার মাঝখানে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে বৃষ্টি-বোঝাই স্মৃতি।
এই স্মৃতিগুলোই এসে জমা হয় যে কোনও বৃষ্টির দিনে। রজার হুইটেকারের গলায় মাথার মধ্যে গান বাজে— ‘রেইনড্রপস আর ফলিং ফ্রম মাই উইন্ডো, টিয়ারড্রপস আর ফলিং ফ্রম মাই আইজ’। বেজে ওঠে জয়ের কবিতা— ‘বৃষ্টি তোমার বন্ধুকে মনে রেখো’। মনে রাখি সবটাই। মনে রাখতেই হয়। জানলা বেয়ে বৃষ্টিফোঁটারা পড়তে পড়তে কখন চোখের জল হয়ে যায়। অদ্ভুত একটা মন খারাপ ছেয়ে যায় মেঘের মতো। আবার বৃষ্টি আসে। চারিদিক ঝাপসা করে বৃষ্টি আসে।
স্মৃতি-বিস্মৃতির চাইতে কিছু বেশি যেন ঝরে পড়ে আষাঢ়-শ্রাবণ জুড়ে। এ পার গঙ্গা ও পার গঙ্গা বলে তখন আর কিছু চেনাই যায় না। মাঝখানের চরটি কখন যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। আমাদের উঠবন্দি সংসারে মায়ের পেতে রাখা হাঁড়ি-পাতিল উপচে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে ফেলে ‘যমুনা কি তীর’, ছুঁয়ে ফেলে গান-বাজনার বিশ্বজোড়া কাগজের দল। গান গড়ায় অনির্দেশের দিকে। সেখানেও তখন দারুণ বৃষ্টি। কেউ অপেক্ষায় থাকে সেখানে। সারা জীবন।