“মাসিমা তাড়াতাড়ি চলুন নিচে সবাই অপেক্ষা করছে “একটু আনমনা হয়ে তাকালেন প্রভাতী দেবী – দরজায় দাঁড়িয়ে গার্গী । এখানে এর সান্নিধ্যই একমাত্র প্রভাতী দেবীকে ভীষণভাবে স্পর্শ করে, ভীষণ আন্তরিক। কতই বা বয়স হবে- তরীর বয়সী ! “কি মাসিমা কি ভাবছেন?
চলুন…” হুঁশ ফিরলো দ্বিতীয়বারের ডাকে “হুম তুমি যাও আমি আসছি ” । হাতের ছবিটা রেখে চশমাটা চোঁখে দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলেন প্রভাতী দেবী ।সিঁড়ি দিয়ে নেমেই দুপাশে সুন্দর ফুলের বাহার, সাথে চলতে থাকে মৃদুমন্দ হাওয়া , “ছায়ার” এই রূপ দেখে মাঝে মাঝে প্রভাতী দেবীর মনে হয় ছেলে তার দেখভালে কোনো কার্পণ্য করেনি ,মায়ের শেষজীবনের দায়িত্ব ভালো জায়গাতেই দিয়েছে , একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই । গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখলেন সবাই তার জন্যই অপেক্ষায় – সব বন্ধুরা, শেষজীবনে আত্মীয়রা ।
আজ পঞ্চম দোলে সকাল সকাল সকলে মিলে পাশের মদনমোহন মন্দিরে যাওয়ার কথা।মন্দিরে আজ প্রচুর ভিড়, এখানে মোটামুটি বিখ্যাত এই পঞ্চম দোলের উৎসবটি , রাতে আবার মেলাও বসে ।ভালোই কাটছিলো সময়টি !হঠাৎ
“কাকিমা ভালো আছো?”
অবাক হয়েই একটু তাকিয়েই বললেন “চেনা লাগছে কে বলোতো ?”
“কাকিমা শুভ তোমাদের শ্যামবাজার বাড়ির পাড়ায় থাকি ।”
“বুঝতে পেরেছি , কেমন আছিস বাবা সব ভালো তো ?” বললেন প্রভাতী দেবী
পাশে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বললো শুভ “কেকা প্রণাম করো কাকিমাকে, তোমাকে বলেছিলাম না আমাদের পাড়ার জুয়েল রণদার কথা? তার মা ।”
কেকা তাড়াতাড়ি টুক করে প্রণাম সারলো।
“সোনারপুরে আমার শশুরবাড়ি , আগের বছর বিয়ে করেছি ।তা কাকিমা তোমার ইয়েটা মানে আশ্রমটা কি কাছেই?” একটু যেন লজ্জা পেয়েই বললো শুভ ।কেকার সাথে আলাপ করার অছিলায় শুধু “হুম ” এ কাজ সারলেন প্রভাতী দেবী । “রণ দাতো কলকাতায় এখন না? “বেশ উত্তেজনামূলক প্রশ্ন ছিল শুভর। তার থেকেও বেশি উত্তেজনা লক্ষ্য করা গেলো প্রভাতী দেবীর চোখেমুখে , হতবম্ব হয়ে গেলেন। “না আসলে কাল গাড়িয়া হাটে তরী বৌদিকে দেখলাম মনে হলো,ভুল হতে পারি , আচ্ছা কাকিমা আসি আজ ” কোনোরকমে তুতলিয়ে কথাকটা বলেই একরকম পালিয়েই গেলো শুভ ।
আশ্রমে ফিরলেই রামলাল বললো ” মা জি ফোন ছিল , বলেছি বারো বাজেকে পর করতে “। ঘড়িতে বারোটা বাজতে বেশি বাকি নেই অগত্যা ওখানেই সোফাতে একটু ঠান্ডাতে বসে পড়লেন প্রভাতী দেবী ।মনে চলেছে নানা প্রশ্ন- বাবু কলকাতায় !পাঁচদিন আগে দোল গেলো , হয়তো এসেছে , তরীর বাপের বাড়ি উঠেছে , আর কোথায় উঠবে?
শ্যামবাজারের বাড়িটাও তো বিক্রি করে দিলো । ছয়বছর হলো চাকরি করছে তখন থেকেই ব্যাঙ্গালোরে, বছরখানেক পর বিয়ে করে তরীকে নিয়ে চলে গেলো সাততাড়াতাড়ি ।মনে মনে ভাবতে লাগলেন প্রভাতী দেবী যে তিনি চিরকালের একা ।বাবুর বাবা চলে গেলেন বাবু তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে ,কলকাতার বড় বাড়ি আঁকড়ে পরে থাকতেন তিনি আর তাদের পুরোনো কাজের লোক নকুড়। দিব্বি চলছিল হঠাৎ বছর তিনেক আগে এসে বাড়ির বিক্রির কথা বললো বাবু , একটু অবাক! কিন্তু ওর জোরের সাথে কখনো পেরে ওঠেননি প্রভাতী দেবী ,আমি কোথায় থাকবো জিজ্ঞাসা করাতে তরী সরাসরি বলে দিলো দারুন একটা জায়গা দেখে এসেছে সোনারপুরে নাম “ছায়া” , ওখানে নাকি দারুন সময় কাটবে অনেক বান্ধবী হবে এই বয়সে ।কথাগুলোর এতো জোর ছিল যে পেনশন হোল্ডার হয়েও নিজের মতামত টুকু বলে উঠতে পারেননি তিনি। তাই আজ এখানে , এই সোফায় বসে !
“মা জি ফোন টা নিন” তন্দ্রাটা ভাঙলো রামলালের কথায়। ফোন টা কানে নিতেই ” মামিমা আমি পঞ্চু ,অনেক কষ্টে তোমার নম্বর টা পেলাম ,”
প্রভাতী দেবী : ” হুম বল , সব ভালো তো?”
পঞ্চু : “ওসব ছাড়ো , আগে বলো রণ কি কলকাতায় চলে এসেছে? ”
প্রভাতী দেবী: “না তো!”
পঞ্চু : “না বললে হবে ওর বৌ একটা স্কুলে পড়ায় ,উত্তরীয় বালিকা বিদ্যালয় ।”
আজও কি ভীষণ বাজে বকে ছেলেটা , প্রভাতী দেবী একটু গলা চরিয়েই বললেন ” আগের সপ্তাহে মানি অর্ডার এসেছে ব্যাঙ্গালোরে থেকে ”
পঞ্চু : ” ধুস হতেই পারে না , ওর বৌয়ের স্কুলের পাশের বাড়িতে আমার শালার প্রোমোটারিং অফিস , ২ সপ্তাহ শালা ঘুরতে গেছে আমার ওপর দায়িত্ব দিয়ে ।আমি রণের বৌকে তিনদিন পর পর দেখে তোমায় ফোন করলাম।”
গলাটা চরিয়েই প্রভাতী দেবী: ” প্রমান দিতে পারবি?”
তৈরী ছিল পঞ্চু, বললো : ” কাল সকালে এগারোটায় যদি ও স্কুলে যায় তোমায় ফোন করবো বিকেলে তৈরী থেকো আমি এসে নিয়ে যাবো তিনটে নাগাদ , সোনারপুর থেকে গড়িয়াহাট খুব দূরে না ।” বলেই ফোন কেটে দিলো । গড়িয়াহাট শুনে যেন একটু তাক লাগলো কারণ সকালেই শুভ বলছিলো গড়িয়াহাটে নাকি তরী কে দেখেছে !
খুব দোলাচলের মধ্যে দিয়ে কাটতে থাকলো দিনটা । যদিও শান্তির নয় তাও রাতের ওই ঘুমটুকুও কেঁড়ে নেবে ছেলে মেয়ে দুটো , স্বল্পভাষী শান্ত স্বভাবটাকেই লোকে ওর দুর্বলতা ভেবে নেয়।কি জানি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো নাকি? দিব্বি তো ভাব ভালোবাসা ছিল !
পরের দিন ঠিক সাড়ে এগারোটায় ফোন পঞ্চুর : “মামিমা বিকেলে তৈরী থেকো আমি আসবো নিতে তোমায়, ঠিক তিনটে”।প্ল্যানমাফিক সব চলছিল ।প্রভাতী দেবীও গিয়ে বসেছিলেন পঞ্চুর সাথে সত্যি পাঁচটা বেজে যখন পনেরো হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো তরী , কি রোগা হয়ে গেছে ! খুব ঝড় ঝাপ্টার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে মনে হলো , ভাবতে ভাবতেই ও চোখের বাইরে চলে গেলো । কিন্তু এবার কি হবে ? সত্যিটাই বা কিভাবে জানবে? রোজ রোজ আসাও সম্ভব না ,বাবু তো ছয় সাত মাস ফোন করা ছেড়ে দিয়েছে তরী তাও মাসে একবার কি দুবার করে , নিজের পেটের ছেলের ছয় সাত মাসে একবার মার গলাটা পর্যন্ত শুনতে ইচ্ছে হয় নি ,তাই প্রভাতী দেবীও অভিমানের পাহাড় সরিয়ে আর ফোন করেন না , কিন্তু আজ করবে জানতেই হবে কি হয়েছে !
আশ্রমে ফিরেই রামলাল কে একটা নম্বর দিয়ে বললো ফোন করতে “মা জি সুইচ অফ বলছে ” সেটাই তো স্বাভাবিক , ছাড়াছাড়ি হলে কি আর পুরোনো নম্বর কেউ রাখে ! অফিসের নম্বরে একটা ফোন করে দেখা যাক সবে সাড়ে ছটা, বাবু অনেক রাত অবধি থাকে বলে জানি । আবার রামলাল কে অফিসের নম্বরটা দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন প্রভাতী দেবী ,” মা জি’ বলে ফোন টা এগিয়ে দেয় রামলাল । কানে নিতেই
” গুড ইভনিং ইনফোডিল ”
“রণজয় সেন কে একটু দেওয়া যাবে?”
“কৌন? ইস নাম পে তো কোই নেহি হ্যা ”
প্রভাতী দেবী আরো কিছু বলবেন ভাবলেন কিন্তু এতো কিছু বাংলা ওপারের মেয়েটা বুঝবে বলে মনে হয় না তার চেয়ে সৌমিক কে চাইলে কেমন হয় ? একই সাথে ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরিটা পেয়েছিলো , বাবু কে না পেলে ওকেই ফোন করতেন আগে , দেরি নাকরে বললেন : “সৌমিক রায় ?” ওপাশ থেকে “জাস্ট হোল্ড অন ”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে “হ্যালো ”
প্রভাতী দেবী: “রণজয় কোথায় আছে সৌমিক?
ওপাশ থেকে : “রণজয় তো চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে আজ দুবছর হলো, ও খুব অসুস্থ ছিল তখন ”
আরও কিছু একটা বলতে গিয়েও : “আপনি কে ?”
প্রভাতী দেবী : “সৌমিক আমি রণের মা ”
ওপার থেকে : “ও হো সৌমিক একটা মিটিংয়ে আছে, আমি ওর কলিগ, কাল সকালে ফোন করুন ।”
পুরো কথাটার মধ্যে কিছু একটা গোপনীয়তা ছিল যেটা কেবল মা এর মনই বোঝে ।ধপ করে পাশের সোফাটায় বসে পড়লেন , রামলাল চেঁচিয়ে উঠলো “মা জি তাবিয়াত ঠিক লাগেজে না কি? ” গার্গী দিদি তাড়াতাড়ি আসেন মা জি কা তাবিয়াত ঠিক নেয় “।সবাই ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলো ডাক্তার এসে বললেন কাছের লোককে খবর দেওয়া উচিত, উনি মেন্টাল ট্রমার মধ্যে আছেন । গার্গী তাড়াতাড়ি রেজিস্টার খুলে নম্বর বের করে ফোন করলেন “তরী দেবী বলছেন ? ম্যাডাম একটু আসতে পারবেন প্রভাতী দেবী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।একটা ফোন করতে করতেই হঠাৎ ! না চিন্তার কিছু নেই আপনি আসুন । ”
রাত আটটায় তরী আসলো আশ্রমে, ঢোকার সাথে সাথে গার্গী একটা ফর্ম ধরিয়া দিলো , জিজ্ঞাসা করাতে বললো রাত আটটার পর ভিসিটর আসলে তার ফর্মালিটিজ। ঘরে ঢুকতেই তরীর দিকে এমন করে তাকালেন প্রভাতী দেবী তরী একটু নড়ে গেলো ভেতর থেকে । কোনো ভূমিকা ছাড়াই চিৎকার করে উঠলেন প্রভাতী দেবী “বাবুর কি হয়েছে?” তরী বললো “তুমিকি করে জানলে?”
প্রভাতী দেবী : “আমি ওর অফিস এ ফোন করেছিলাম”।
হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো তরী : ” মা গো আমি পারলাম না হেরে গেলাম , লিভার ক্যান্সার ,পাক্কা চার বছর ভুগলো, খরচ টানতে পারছিলাম না বলে তোমার ওই বাড়ি আমি বিক্রি করেছিলাম মা, ক্ষমা করো আমায়, কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে আরো একবছর অফিস করেছিল তারপর সেটাও বন্ধ ,কতবার চেয়েছিলাম তোমায় জানাতে ,আমায় দিব্বি দিয়েছিলো , আমি পারিনি মা ওর দিব্বিকে উপেক্ষা করতে ,এই জন্যই আমি তোমায় ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যেতে চাইনি “।
প্রভাতী দেবী পুরো নিশ্চল, চোখ শুষ্ক , খালি ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠছে “তাহলে ওই মানি অর্ডার ?”
তরী বললো ” মা আগস্টে ও চলে যাওয়ার পর আমি সেপ্টেম্বর এ কলকাতায় ফিরে এসে একটা স্কুলে চাকরি নি – ক্লারিক্যাল পোস্ট আর বাড়ি বিক্রির কিছু টাকা ব্যাংকে রেখে তার ইন্টারেস্ট ” এতে যা হয় ওখান থেকেই প্রতিমাসে সাতহাজার পাঠিয়ে দি সৌমিক দার একাউন্টে, উনি এখানে মানি অর্ডার করেন । স্থির হয়ে গেলেন প্রভাতী দেবী, তরী জোরে জোরে ধাক্কা দিতে থাকলো জরিয়ে ধরে বললো” মা গো তুমি এভাবে থেমে যেও না তাহলে আমার এই লড়াইও থেমে যাবে গো মা ” পায়ে লুটিয়ে পড়লো , প্রভাতী দেবীর বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো , নিজের ছেলের থেকে বেশি কষ্ট লাগতে থাকলো পায়ে আঁকড়ে থাকা পরের মেয়েটির ওপর , কেন ওর জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে কখনোতো কোনো হৃদ্যতাই গড়ে ওঠে নি ওর সাথে । নিজের ছেলে হারানোর শোকটুকুকে স্পর্শ করতে চাইলেও কেন পারছে না অথচ দিনের পর দিন বাবুর সব খারাপ কাজের জন্য পরোক্ষ ভাবে হলেও এই মেয়েটাকেই দায়ী করে এসেছেন তিনি । হায় রে পোঁড়া মন তোকে বুঝবে কার সাদ্ধি ! দুহাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন তরীকে ।মুখে খালি বললেন “মা রে ” , তরীও জড়িয়ে ধরলো ” মা গো ” বলে। বুকের সব কঠিন ব্যথা বেরিয়ে এলো তরল হয়ে ।
আজ দুজনই দুজনের মা
কেউ নামে তো কেউ দায়িত্বে,
এতো কষ্ট বুকে রেখে
তুই ই আজ জিতে গেলি মাতৃত্বে —