গারদের সেলে অজয় মুখ গুঁজে সর্বদা কাঁপতে থাকে । কুকুর – বিড়ালের মত খাবার খায় আর ভয়ঙ্কর আতঙ্কে দিনরাত এক করে শুধু গোঙানি তুলে যায় আর বলে যায় দুই হাত জোড় করে , ” ক্ষমা ক-করে দাও , স্মৃতি তুমি ক্ষমা করে দাও । ”
কে এই স্মৃতি ? আজকের পাগল অজয়ের স্মৃতিতে সব শেষ হয়ে গেলেও স্মৃতির কথা কী করে রয়ে গেলো ? এসব জানতে ফিরতে হবে ১৫ বছর আগে ।
কলেজের লাস্ট ইয়ার , অজয়ের লাম্পট্য তখন তুঙ্গে । মদ , সিগারেট , গাঁজা , নাইট ক্লাব আর মেয়েদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও তাদের জীবন শেষ করা এসব তখন অজয়ের বাঁহাতের খেল । কোটিপতি ব্যবসায়ী বাবা রণেশ পোদ্দারের ছেলে অজয় পোদ্দার । বাবার টাকা ওড়ায় ও কলেজে , রাস্তায় ফূর্তি করে বেড়ায় । বাবার ছত্রছায়ায় দু-তিনটে ক্রাইম করে ফেলেছে ইতিমধ্যে এবং তার পরেও রয়েছে নিশ্চিন্তে ।
কলেজ শেষ , লাম্পট্যের উর্ধ্বগগনে অজয় । এমন এক সময় অ্যাঞ্জেল প্রিয়ার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পায় । সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকসেপ্ট । প্রথম প্রথম সাধারণ কথাবার্তা । প্রোফাইলে ছবি না থাকায় একদিন অজয় বলে বসে , ” তোমার একটা ফটো কি দেওয়া যায় না ? ”
সঙ্গে সঙ্গে একটা ফটো কিন্তু মুখের নীচ থেকে । উল্টোদিক থেকে , ” তুমি যা চেয়েছিলে । ”
অজয় উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলো আর লিখলো , ” তোমার একটা দারুণ ভিডিও প্লিজ , প্লিজ ! ”
ফের উত্তর , ” সম্পর্ক ভালো করে স্থাপনের আগে একটু তো ভালো করে জানা দরকার পরস্পরকে । আমি কিন্তু সতী-সাধ্বি নারী নই । প্রতি রাতে ঠিক তোমার মতো একজনকে আমার চাই । কিন্তু তুমি তো মনে হয় ব্রহ্মচর্য পালন করো , তাই না? ও তোমার সাথে জমবে না আমার । ”
অজয় তাড়াতাড়ি জবাব দিল , ” আরে আরে , আমায় তোমার চিনতে ভুল হয়েছে । সুন্দরীরা আমার পায়ের কাছে লুটোয় আর যারা রাজি হয়না তাদের চেহারা … যা হোক ওসব ছাড়ো । ”
হঠাৎ মেসেঞ্জারে ভিডিও কল , একি ভিডিও কল , এরই মধ্যে ! অ্যাকসেপ্ট , ব্যাস । উল্টোদিকে সমস্ত লাস্য ঢেলে দিতে লাগলো মেয়েটি । উত্তেজনায় নাচতে ইচ্ছে করলো অজয়ের । এবার সে লিখলো , ” এবার তো মুখ দেখাও কিউটি পাই , আর পারছি না । ”
এবার উত্তর এলো যে , ” রোসো বৎস , ধীরে ধীরে । তা তুমি কী বলছিলে যেন চেহারা নিয়ে , কেউ না রাজি হলে ? ”
অজয় বললো , ” কিছু নয় , একটু অ্যাসিড দিয়ে করকে দিলাম । ”
এবার ক্রমে মুখটা প্রতিভাত হলো সামনে । অজয় আতঙ্কে আঁতকে উঠলো । ” কে কে তুমি ? ” হা হা করে চেঁচিয়ে উঠলো ।
মেয়েটি বললো , ” কেন চিনতে পারছো না ? দেখ এই অ্যাসিডে চোকলা ওঠা মুখটা দেখো ! ভালো লাগছে না ! ”
মোবাইলটা ছুঁড়ে দিলো অজয় । ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙ্গলো মোবাইলের । তখনও ভয়ে কাঁপছে সে । সন্ধ্যেবেলা বন্ধু রঞ্জিত না আসা পর্যন্ত শান্তি পেলো না । বেশ কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলার কারণে রঞ্জিত বললো , ” কি রে কী হলো ? তোকে এরকম বিধ্বস্ত লাগছে কেন ? ”
বছরদুয়েক আগে স্মৃতি বলে একটা মেয়ের যে সর্বনাশ করে পুলিশের থেকে বাবার হস্তক্ষেপের কারণে বেঁচে গেছিলো তার কথা বললো অজয় ও সাথে আজ যা ঘটেছে তার বর্ণনা দিলো । রঞ্জিত বললো , ” ওসব ছাড়তো , কেউ তোকে ছুঁতে পর্যন্ত পারবে না । চ ডিস্কে চল । মস্তি হবে মস্তি । ”
অনেক গরিমসি করার পর শেষে যেতে রাজি হলো । বাবা অধিকাংশ সময় বিদেশে , মায়ের সাথে বিচ্ছেদ । ফলে গুরুজন বলতে কেউ নেই ।
ডিস্কে নাচানাচি মদ্যপান করে যা ঘটেছে সব ভুলতে লাগলো । এবার খোঁজ একজন দামী এসকর্টের । মিলেও গেলো। রুমে গিয়ে একাত্ম হতে গিয়েই চিল চিৎকারে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো । ছুটে গেলো নেশা । একি তার ঘরে স্মৃতি এলো কী করে ? এদিকে এসকর্ট মেয়েটি টাকার জন্য তার পেছনে ছুটছে । রঞ্জিত বিল চুকিয়ে বেরিয়ে এলো আর বন্ধুকে ফলো করতে করতে এগিয়ে গেলো রাস্তার মোড়ে । একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো অজয় । এরপর ঘরে ফিরে এলো ঘোর জ্বর ও সাথে বিকার । পরদিন সকালে জ্বর ছাড়লো বটে তবে আতঙ্ক নয় । রঞ্জিত সারারাত ছিলো । সকালে গেলে পর বেলার দিকে সাহস করে অজয় রাস্তায় বেরোলো একটু । একটা চায়ের দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো । চা খাওয়ার সময় সে সবকিছু নিয়ে তোলপাড় করে ভাবতে লাগলো । এমন সময় সামনে দিয়ে একজন মহিলা হেঁটে যাচ্ছিলেন । ওনার ব্যাগ পড়ে যাওয়ায় ওনার সাথে সাথে অজয়ও নীচু হয় । তারপর মুখের দিকে তাকাতে চায়ের ভাঁড় ফেলে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে , ফের উঠে দৌড়ে বাড়ি অবধি গেলো। সেইদিনই তার বাবা ফিরলেন । ছেলের অবস্থা দেখে ভয়ানক চিন্তায় পড়লেন । পুলিশকে আদেশ দিলেন এলাকায় অ্যাসিডে পোড়া মুখ দেখলেই অ্যারেস্ট করতে । তবে পুলিশ পারলো না । হাজার চেষ্টাতেও খুঁজে পাওয়া গেলো না স্মৃতিকে ।
এদিকে অজয়ের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলো । দিনে রাতে হঠাৎ হঠাৎ চেঁচাতে লাগলো । ক্রমে অবস্থা এমন হলো যে তাকে হসপিটালে নিয়ে যেতেই হলো , মেন্টাল হসপিটাল । বেডে ছটফট করছে অজয় আর চিল চিৎকার স্মৃতির নাম ধরে । রণেশ বাবু অস্থির হয়ে পুলিশকে ফোন করে বললেন , ” কিছু খোঁজ পেলেন ? কী করছেনটা কী ? ”
ফোনে কথা বলছেন এমন সময় ঘোমটা দেওয়া একটি মেয়ে ঘরে এসে দাঁড়ালো । ঘরে এসে সে ঘোমটা সরিয়ে অজয়ের সামনে দাঁড়াতেই ফের সেই মর্মভেদী চিৎকার ও এবার তার সাথে প্রার্থনা , ” ক্ষমা করে দাও , স্মৃতি । ”
চিৎকার শুনে জানলার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রণেশবাবু বলেন , ” তোমার এত্ত বড়ো সাহস ! তুমি আমার সামনে দিয়ে এসে … কত টাকা চাও ? ব্ল্যাঙ্ক চেক দিচ্ছি ইচ্ছে মতো অঙ্ক বসিয়ে প্লাস্টিক সার্জারি করে নাও । ”
স্মৃতি প্রাণ খুলে হাসতে লাগলো আর পেছন থেকে কমিশনার স্বয়ং প্রবেশ করলেন । বললেন , ” আর চালাকি চলবে না মিস্টার পোদ্দার । এলাকার কোরাপ্ট পুলিশকে হাতে রাখতে পারেন কিন্তু আইন আছে তার নিজেরই জায়গায় । ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট অজয় । ”
অজয় তখন উত্তর দেবার অবস্থায় ছিলো না । সে শুধু হাত পা ছুঁড়ছিলো আর চিৎকারের সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করছিলো।
সেই থেকে নিয়ে অজয় আজও মানসিক চিকিৎসার অধীন কিন্তু ১৫ বছরে অবস্থা ক্রমে খারাপ হয়ে গেছে । সে এখনও প্রতিদিন পাপের জন্য অনুতাপ করে যায় প্রতিনিয়ত । স্মৃতি প্লাস্টিক সার্জারি ভয়েই করায় নি । ভয় হলো ফের যদি সুন্দর চেহারার জন্য …