ডাক্তারের রিপোর্ট হাতে পেয়ে,অঝোর ধারায় আমার দু’চোখ বেয়ে কান্না গড়িয়ে পড়ছে।আমি কাঁদছি না তবুও যেন কাঁদছি।
যে মেয়েটির সাথে সাত বছর রিলেশনের পর,জীবন সঙ্গী করে নিলাম;তার দু’টো কিডনি ডেমেজের কথা শুনে আমার কান্না ছাড়াহ আর কোনো উপায় যে নেই।মাথাটা মনে হচ্ছে,আমার ঘুরাচ্ছে।যে কোনো মুহুর্তেই আমার সাজানো পৃথিবী ভেঙে যেতে পারে।মানুষের ঠোঁট নাড়া দেখছি কেবল,অথচ আমি কিছুই শুনতে পারছি না।এমন কেন হলো আমার সাথে?নিশ্চয়ই আমি কোনো পাপী বান্দা,না হলে আমার সাথে এমন তো হওয়ার কথা না?
মনে পড়লো,মায়ের চোখের পানির কথা।মা’কে যখন বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসছিলাম,মায়ের চোখ দিয়ে পানিই পড়ছিল।আজ সেই পানি আমার চোখ দিয়েই পড়ছে।আমার তো কোনো দোষ ছিলনা?অঁধরায় বলে ছিলো,যদি মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে না রেখে আসি,সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।আমার একবছরের মেয়ের মা যদি, আমার আদরের মেয়েটি কে যদি একা রেখে যায়,সে ভয়ে মা’কে আমার বৃদ্ধাশ্রমে পাঁঠাতে হলো।আজ একসপ্তাহ না যেতেই,মা’য়ের চোখের পানির অভিশাপ যে লেগে যাবে, তা ভাবতেই পারিনি আমি।
যদি কয়েকদিনের মধ্যে অঁধরার কিডনি ট্রান্সপার করতে না পারি তাহলে তাকে চিরতরে আমাকে,হারাতে যে হবে!আমি বেঁচে থাকতে,আমি তা কখনোই হতে দিবো না।
বাসায় অনেক কষ্টে ফিরলাম।পারিবারিক ডাক্তার হওয়ায়,ইতিমধ্যেই অধরা,ডাক্তার আংকেলের কাছ থেকে তার কিডনি ডেমেজের কথা শুনে গেছে। আমি কলিংবেল দিতেই,সে ছুটে এসে দরজা খুলল।আমাকে জড়িয়ে ধরে,সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আর বলল,’আকাশ আমি বাঁচতে চাই’।
তার এই কথায় আমারও চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।চোখ মুছে বললামঃযেভাবে হোক আমি তোমাকে বাঁচাবোই।
রাত দুটো বাজে,অথচ আমার চোখে কোনো ঘুম নেই।আমি অধরাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি।চেয়েছিলাম,নিজের একটা কিডনি দিয়ে দিতে।কিন্তু আমার কিডনি ম্যাচ না হওয়াতে তাও আমার হলো না।
কখন যে ইজি চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়লাম,বুঝতেই পারিনি।
সকাল হতেই মাথায় স্পর্শের হাত পেতেই চোখ মেলে দেখি অঁধরা।সে বলল,’আকাশ,তুমি কি একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?
আমি মাথা নাড়িয়ে’ হ্যা’সুচক অব্যয় জানালে,সে বললঃতুমি আমাকে কতটুকু
ভালোবাসো?
আমি দু’হাত দিয়ে দেখালাম অনেক খানি।
সে বলল,’তুমি কি আমার জন্য,যা ইচ্ছা তা করতে পারো?
আমি বললাম-অবশ্যই।
—না মানে,আমি ডাক্তার আংকেলের সাথে কথা বলেছি।ডাক্তার আংকেল বলেছে,তোমার মায়ের সাথে নাকি আমার কিডনি ম্যাচ করেছে,তুমি যদি একটিবার তোমার মা’কে রিকোয়েস্ট করো যে, তার কিডনি আমাকে দান করেতেন,তাহলে…
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম–কি পাগল হয়েছো?যাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছো,তার কাছে এমন আশা করতে তোমার লজ্জা করে নাহ?
–না, আমার লজ্জা করে নাহ।কারণ,আমি মরতে চাই না, আমি বাঁচতে চাই।তোমার মায়ের তো জীবন যাচ্ছে নাহ!একটা কিডনি দিলে,কিছুই হয়না।
আমার মুখে ‘না’কথাটা শুনে,সে হাউমাউ করে আরো কান্না করে বলল– দেখো,আকাশ!আমি ওয়াদা করছি,আমি মা’কে কখনই খারাপ কিছু বলবো না,আমি পুরোজীবন উনার পায়ে পড়ে থাকবো।প্লিজ!
আমি বললাম–দেখো,আমি রিকোয়েস্ট করলেও মা কি আমার কথা রাখবেন?
–দরকার হলে,আমরা দুজন উনার পায়ে পড়ে থাকবো,উনি নির্দোয় হবেন নাহ!প্লিজ আকাশ,প্লিজ!
আমি কোনো উপায় না দেখে মা’কে বাসায় নিয়ে আসলাম।মা’কে আমি আর আমার বউ অধরা মিলে, খুব খাতির-যত্ন করলাম।অঁধরা,মা কে খাওয়ানো থেকে শুরু করে হাত-পা অবধি টিপে দিলো।।মা আমার অনেক খুশি।মাকে এমন খুশি কোনো দিনো দেখিনি।
রাতে মাকে অঁধরার বিষয়টা বলতে গেলাম।অঁধরা,দরজার আঁড়ালে কান পেতে থাকল।
মা কে কান্না করে বললাম–মা!অঁধরার দুটো কিডনিই ডেমেজ হয়ে গেছে।সে আর বেশি দিন বাঁচবেনা।
মা হাউমাউ করে কান্না করে উঠলো।
আর বলল–বাবাহ!কি বলিস এগুলা!
–মাগো..আমি ঠিকিই বলছি।অধরা কে কিডনির জন্য বুঝি বাঁচাতে পারলাম না।
‘মা’কান্না করতে করতে বললেন–বাবাহ!আমি তো বেশি দিন বাঁঁচবোনা!আমার একটা কিডনি বউমারে দিয়া দে!দয়া করে আমার এই কথাটা রাখ।বউমা কে বলবি,সে যদি না, “না”করে।দরকার হইলে,আমি তার হাত ধইরা কমু,দেখবি সে রাজি হইবোই।তয় মরণ পর্যন্ত আমাকে,তোদের কাছে থাকতে দিবি,আমি আর কিছু চাইনা।
কথাটা আড়াল থেকে অঁধরা শুনেই,মায়ের
পা টা ধরে কান্না করে উঠলো।আর বলল–মা! আমাকে মাফ করে দেন।আমি অনেক বড় অপরাধী।
মা,অধরা কে বুকে টেনে বলল–তুমি আমার মাইয়া!মায়ের কাছে,মেয়ের কি কোনো অপরাধ থাহে!আরে,পাগল!ছোট মানষের মতন কাঁদতাছ ক্যান!আমার যদি
একটা মাইয়া থাকতো,আর তার যদি এমন হতো,আমি কি তহন তারে কিডনি দিতাম না!আমার তো মাইয়া নাই,তুমি তো আমার মাইয়া!আর একটা কিডনি দিলে,মানুষের কিছুই হয় না। আমি জানি।আমি কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ,বুঝলা।
অধরা আরো জোরে,কান্না করে বলল–মা! মা!মাগো…আমি বুঝি আমার হারানো মা’কে খুঁজে পেলাম।
তাদের কান্না দেখে কখন যে আমিও কান্না করে দিলাম, বুঝতেই পারিনি।
কয়েকদিন পর অঁধরার আর আমার মায়ের কিডনি ট্রান্সপার হলো।অপারেশনও সাক্সেস হলো।
দু’জনেই ভালো আছে।অঁধরা একদম ই পরিবর্তন হয়ে গেল। অঁধরার কাছে এখন আমার মা ই পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস।সবাই একসাথে কত হাসি খুশি; এমন ফ্যামিলি ই তো আমি চেয়েছিলাম।
আল্লাহ,আমার সে আশাটা পুরণ করেছেন।আল্লাহর কাছে তাই লাখ লাখ শুকরিয়া।আল্লাহ যা করেন,সত্যিই ত তা ভালোর জন্যই করেন।আল্লাহ যদি আমার মায়ের কিডনি দুটো নষ্ট না করতেন,তাহলে মা’কে বৃদ্ধাশ্রমেই পুরোজীবন কাটাতে হতো!যেদিন বৃদ্ধাশ্রমের ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেছিল,আমার মা আর বেশীদিন বাঁঁচবেনা।সেদিনি আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।মনে হলো,আমার কিছুই নেই।বউ গেলে তো বউ পাওয়া যায় কিন্তু মা!
তা তো পাওয়া যায় না।আমি চেয়েছিলাম।আমার মেয়েটি দু’বছরের হলেই মা’কে নিয়ে আসবো।কিন্তু মা যে,আমাকে সে সময়টাও দিতে চাচ্ছিল না।কিন্তু হঠাৎ অধরার পেটের অসুস্থায় আল্লাহই আমাকে এই বুদ্ধিটা এনে দেন।অধরার কয়েকদিনের পেটেরর ব্যথার অসুস্থায়, এই নাটক টা করতে আমার জন্য সহজ হয়ে যায়।
আজ অঁধরার কিডনিতেই বেঁচে আছেন আমার মা,অথচ অঁধরা জানে আমার মায়ের কিডনি তে বেঁচে আছে সে।থাকুক না একটা কিডনি তে দুজনেই বেঁচে।সবাইকে নিয়ে সুখে থাকাটাই তো বড় সুখ।
সত্যিই অঁধরা ঠিকই বলেছিল,’একটা কিডনি তে মানুষ ঠিকই বাঁচে।